আমরা কোন স্তরের বিশ্বাসী ও কোন প্রকৃতির মুসলমান?

আমর কেমন মুসলমান?

আমর কেমন মুসলমান?

(পর্ব: ১)

১। সূচনা: সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও দয়াময় প্রতিপালক বলছেন: “কাল প্রবাহে মানুষের উপর এমন এক সময় এসেছিল, যখন সে (মানুষ) উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না। আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি (এক জোড়া নর-নারীর) মিলিত শুক্র বিন্দু হতে তাকে পরীক্ষা করবার জন্যে। এই জন্যে আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন। আমি তাকে (আমার কর্তৃক প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে পবিত্র আসমানী কিতাব মোতাবেক যে, পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে (সেই পথে চলে) কৃতজ্ঞ হবে, নতুবা সে (অভিশপ্ত শয়তান ইবলীস ও তার অনুসারীদের দেখানো অসত্য ও অকল্যাণের পথে চলে) অকৃতজ্ঞ হবে। আমি মুসলমান নামধারী (মুনাফিক, মুরতাদ, নাস্তিক, মূর্তিপূজক ও অগ্নিপূজক মুশরিকসহ) কাফিরদের জন্যে প্রস্তুত রেখেছি শৃখল, বেড়ি ও লেলিহান অগ্নি। সৎকর্মীশীল (মুহসিন ও সালেহীন বান্দা)গণ পান করবে এমন পানীয় যার মিশ্রণ হবে কাফুর (কর্পুর)।” (সুরা দাহর : ১-৪)

পবিত্র হাদীসের বর্ণনা: “আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, যে এক বেদুইন রাসূল সা.-কে জিজ্ঞেস করল: কিয়ামত কখন হবে? তিনি বললেন: এর জন্যে তুমি কি প্রস্তুত করেছ? সে (বেদুইন লোকটি) বললো: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহব্বত। তিনি (রাসূল সা.) বললেন, যাকে ভালবাস তুমি তার সাথেই থাকবে।” (বুখারী : ৬১৭১ ও মুসলিম ২৬৩৯)

২। ভূমিকা : আমরা অনেকেই অতি সহজেই নিজেকে মুসলমান বলে প্রচার করি। কিন্তু মুসলমানের মত কাজ করি না। আর মুসলমান শব্দের বাংলা অর্থটুকুও আমরা অনেকেই জানি না। আমরা যাকে মুসলমান বলি এটি ইসলামী জীবন বিধান মেনে জীবন-যাপনকারীগণের মধ্যে দ্বিতীয় স্তর। যার প্রথম হচ্ছে মুমিন। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষাভাষীগণ পরেরটা আগে এবং আগের শব্দকে পরে বলে থাকি। আর ইসলামের অনুসারীগণ একাধিক স্তরে বিন্যাস্ত সেকথাও আমরা অনেকেই জানি না। তাই আমরা আল-কুরআন ও হাদীসের আলোকে সেই স্তরগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করতে মনস্থ করছি। ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ।

৩। বিশ্বাস ও আমল অনুযায়ী ইসলামের অনুসারীগণের শ্রেণী বিন্যাস: পবিত্র আল-কুরআনের বর্ণনা মোতাবেক বিশ্বাস এবং কাজ (আমল) এর সমন্বয় সাধনের মাত্রানুযায়ী ইসলামের অনুসারীগণ নিম্নবর্ণিত স্তরে বিন্যস্ত যথাক্রমেঃ-

১ম স্তর: মুমিন – প্রাথমিক ভাবে বিশ্বাস স্থাপনকারী।

২য় স্তর: মুসলিম – আত্মসমর্পণকারী।

৩য় স্তর: মুত্তাকী – ধর্মভীরু পরহেজগার।

৪র্থ স্তর: মুহসিন – সৎকর্মশীল।

৫ম স্তর: সালেহীন – সৎকর্মপরায়ণ।

৪। মুমিনঃ (ঈমানদার বা বিশ্বাস স্থাপনকারী) ঃ

পবিত্র ইসলামের অনুসারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মুমিন হচ্ছে ১ম স্তর। অর্থাৎ ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয় আছে সেগুলিকে…

(ক) বিশুদ্ধ অন্তকরণে বিশ্বাস করা।

(খ) সেই বিশ্বাসকে নিজের মুখের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করা এবং

(গ) সেই বিশ্বাসের চাহিদানুযায়ী বাস্তবে কর্মকান্ড করা।

এই তিন বিষয়ের সমন্বয় সাধনকারীকেই বলা হয় মুমিন ঈমানদার বা বিশ্বাস স্থাপনকারী।

আর সেই বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়গুলো হচ্ছে যথাক্রমে:

(১) আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস করা।

(২) তাঁর ফেরেশতাগণের উপর বিশ্বাস করা।

(৩) তাঁর নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহের উপর বিশ্বাস করা।

(৪) আল্লাহর প্রেরিত সমস্ত নবী ও রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস করা।

(৫) ভাগ্যের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস করা।

(৬) মৃত্যুর পর পূণর্জীবিত হওয়ার উপর বিশ্বাস করা এবং আখেরাতের বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস করা। (সুরা বাকারা : ৪, ২৮ ও ২৮৫ এবং নিসা ১৩৬)  কোন মানব সন্তান যখন উপরোক্ত মৌলিক বিষয় সম্পর্কে তার বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে বিশ্বাস করবে এবং তা মুখের দ্বারা স্বীকৃতি প্রদান করবে, অতঃপর সেগুলোর চাহিদানুযায়ী বাস্তব জীবনে কাজের মাধ্যমে প্রতিফলন ঘটাবে, তখন তাকে বলা হবে মুমিন বা ঈমানদার বা প্রাথমিক স্তরের বিশ্বাসী।

মুমিনের বৈশিষ্ট্যঃ

আমরা সাধারণভাবে জানি যে, যখন কোন একজন ব্যক্তি কোন একটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার নিয়োগ প্রাপ্ত হন, তখন মূলতঃ সে ব্যক্তি সেই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মালিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন যে, তিনি সেই সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে ভাল কাজে শ্রম দিবেন যার ফলে মালিক তাকে বিনিময় প্রদান করবেন। এই চুক্তি মোতাবেক কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার লোক নিয়োগ করা হয়।

তদ্রুপ এরকজন মানব সন্তান যখন ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকে বিশ্বাস করে ইসলাম গ্রহণ করেন বা ইসলামের সীমায় পদার্পন করেন, তখনই মূলতঃ ইসলাম নামক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহসুবহানহুওয়া তায়ালার সাথে যে কোন সৎকর্ম করার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন। এ ব্যাপারে দয়াময় প্রতিপালকের ঘোষণা ঃ

“যারা ঈমান এনেছে (মুমিন হয়েছে) ও ভাল কাজ (সৎকর্ম) করেছে তাদেরকে আল্লাহ প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন যে, তাদের জন্যে বিনিময় স্বরূপ) ক্ষমা ও মহান পুরস্কার রয়েছে। (মায়িদা-৯)

অর্থাৎ শুধু মুখে মুখে ঈমান আনার ঘোষণা দিলেও আল্লাহর নিকট সে পুরস্কৃত হতে পারবে না। পুরস্কার বা প্রতিদানের বিষয়টি সৎকর্ম বা ভাল কজাজ করার সাথে জড়িত।

তাই সুমহান প্রতিপালক মুমেিনর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলছেন এভাবে ঃ

“অবশ্যই সফলকাম হয়েছে বা (মুক্তিপ্রাপ্ত বা পুরস্কারপ্রাপ্ত) হয়েছে সেই সকল মুমিনগণ। যারা বিনয় ণগ্ন নিজেদের নামাযে। যারা আমার ক্রিয়াকলাপ হতে বিরত থাকে। যারা যাকাত দানে সক্রিয়। যারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে। নিজের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত এতে তারা নিন্দনীয় হবে না (বর্তমানে দাসী প্রথা বিলুপ্ত) সুতরাং কেউ এদেরকে ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালংঘণকারী। এবং যারা আমানত ও প্রতিশ্র“তি রক্ষা করে আর যারা নিজেদের নামাযে যতœবান থাকে, তারাই হবে জান্নাতুল ফেরদৌসের সৌভাগ্যবান উত্তরাধিকারী যাতে তারা স্থায়ী হবে। (মুমিনুন: ১-১১)

এখন যদি কোন ব্যক্তি বলে যে আমি ঈমানদার বা মুসলমান কিন্তু উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখিত মৌলিক কার্যক্রমগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করলো না, তিনি কি মু’মিনের বা মুসলমানের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন? বা তিনি উপরোক্ত আয়াতগুলোর বিপরীত কাজগুলো করে, তিনি কি মুমনি বা মুসলিম হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন? আল-কুরআনের আলোকে জবাবটা কি হবে? বুঝে দেখুন।

আল্লাহর সাথে মুমিন ব্যক্তির চুক্তি ভিত্তিক মূল কাজ ঃ

দয়াময় সৃষ্টিকর্তা মানব জাতিকে একটি পবিত্র কাজ সম্পাদন করার জন্যে এ দুনিয়অতে পাঠিয়েছেন। আর সে কাজটি আল্লাহর কাজ মুমিনগণ হচ্ছেন আল্লাহ সুমহানওয়া তায়ালার প্রতিনিধি বা খলিফা। আর সেই কাজের দায়িত্ব দিয়েই দয়াময় প্রতিপালক বলছেন:

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে (তাঁর) বিধান সমূহ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠাকারী ও ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হয়ে যাও। কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের শত্র“তা যেন তোমাদেরকে এর প্রতি উদ্ধৃত না করে যে, তোমরা ন্যায় বিচার করবে না। তোমরা (সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে) ন্যায় বিচার কর। এটা নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল।” (মায়িদা :৮)

এখন বুঝে দেখুন যারা নিজেকে মুসলমান বা ঈমানদার বলে দাবী করছি সেই মুসলমানরাই নিজের উপর আল্লাহর প্রদত্ত দায়িত্বতো পালনই করছি না, উপরিক্ত যে সমস্ত মুমিন বান্দা বান্দীগণ আল্লাহর সাথে কৃত চুক্তি মোতাবেক আল্লাহর বিধান সমূহ প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছি বা বাধা সৃষ্টি করার বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছি এবং সেই সকল মুমিন মুজাহিদগণকে  দা-কুড়াল, লাঠি-সোটা, পিস্তল-বন্দুকসহ নানা প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করছি বা আহত করছি বা পঙ্গু করছি। আবার যারা সেই সকল পৈশাচিক অপকর্মগুলোকে সমর্থন করে নর-পিশাচদের পক্ষাবলম্বন করছি, তারা কি মুসলমান?

এব্যাপারে পবিত্র হাদীসের বাণী :

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুসলমান হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার মুখ ও হাতের ক্ষতি থেকে অন্যান্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির হলো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিস পরিহার করে চলে।” (বুখারী ও মুসলিম)

হাদীসে আরো একটি বর্ণনাঃ

“হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্যে দেয়াল স্বরূপ। এর এক অংশ অপর অংশকে শক্তি যোগায়। (বুখারী ও মুসলিম)

অন্য একটি হাদীসে বর্ণনাঃ

“হযরত নু‘মান ইবনে বশীর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পারস্পরিক ভালবাসা, দয়া-মায়া ও স্নেহ মমতার দিক থেকে গোটা দুনিয়ার মুসলিম সমাজে একটি দেহের সমতূল্য। যদি দেহের কোন বিশেষ অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গেরও তা অনুভূত হয়; সেটা জান্নাত অবস্থায়ই হোক কিংবা ভারাক্রান্ত অবস্থায়।” (বুখারী ও মুসলিম)

 

Related Post