আমার এই সিয়াম কবুল হবে কি?

আমার এই সিয়াম কবুল হবে কি؟

আমার এই সিয়াম কবুল হবে কি؟

ভূমিকাঃ

রমযান এবং সিয়ামের উপর হাজার হাজার লেখা আছে। আর লিখেছেন আমার চেয়ে লক্ষগুন বেশি ভালো এবং বিজ্ঞ লেখকেরা। তাই এই বিষয় নিয়ে আমার লেখার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু নিম্নোক্ত হাদীসটি আমাকে লিখতে বাধ্য করেছে। “তোমাদের সামনে যদি কোন পাপ বা অন্যায় সংঘটিত হয় তাহলে হাত দিয়ে ঠেকাও। (মানে ক্ষমতা দিয়ে পাপ কাজটি বন্ধ করে দাও) তা না পারলে মুখে বল। তাও না পারলে মনে মনে ঘৃণা করো। এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।”
সারা মাস রোযার পরে এমন কি রোযার মধ্যেই ঈদের আনন্দের নামে যে পাপের মহড়া চলে তা বন্ধ করার ক্ষমতা আমার নেই কিন্তু তার বিরুদ্ধে বলতে এবং লিখতে তো পারি। সে তৌফিক তো আল্লাহ সুবহানাহু  আমাকে দিয়েছেন।
আর লেখাটা শেষ হওয়ার পর মনে হয়েছে মহান রমযান ও রোযা সম্পর্কে যারা যুগে যুগে লিখেছেন সেই সব মুজাহিদদের মিছিল তো অনেক বড়। আমি যত ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ হই না কেন, থাকনা আমার নামটাও সেই মিছিলে।
আমি লিখেছি আমার ক্ষদ্র ইলম আর আমার আবেগ থেকে এর মধ্যে ত্রুটি বিচ্যুতি কিছু থাকতেই পারে। বিজ্ঞ পাঠকের দৃষ্টিতে ধরা পড়লে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। আল্লাহপাক  যেনো তাঁর এই নগন্য বান্দীর দোষত্র“টি মার্জনা করে কবুল করে নেন।  আমীন। সুুম্মা আমীন।

আমার এই সিয়াম কবুল হবে কি?

প্রতি বছর মাহে রমযান আসে আবার চলেও যায় অতিদ্রুত। কুল মুসলিমীন এক মাস সিয়াম সাধনা করে, ভক্তিও নিষ্ঠার সাথে। যা পাওয়ার ছিল তা পায় কিনা জানি না। এই এক মাস সেমিনার, সাধারণ সভা, ইফতার মাহফিল, রমযানের আলোচনা, বিভিন্ন নামে রমাযানের বিভিন্ন দিক নিয়ে অগণিত আলোচনা এবং প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। পত্র পত্রিকায় লেখা হয় রমযান ও রোযা সম্পর্কে অসংখ্য লেখা। ছোট বড় কত যে বই লিখেছেন বিজ্ঞ ব্যক্তি বর্গ। এই এক মাস কতোভাবে কতো আঙ্গিকে যে রমযানের চর্চা হয় অথচ পরবর্তী এগার মাসে তার প্রভাব কি থাকে আমাদের ব্যক্তি এবং জাতীয় চরিত্রে ?
জানি উত্তর নেতিবাচক হবে। কিন্তু কেন?
এর উত্তরে অনেকেই বলবেন হয়ত আমাদের রোযা কবুল হয় না।
কিন্তু কেন কবুল হয় না?
এর উত্তরে হয়ত কেউ বলবেন “আল্লাহর ইচ্ছা।”
সত্যি কি তাই? বান্দা কষ্ট করে রোযা রাখবে আর আল্লাহ বিনা কারণে কবুল করবেন না তা কি হয় ? হয় না। কখনো হয় না। মহান আল্লাহ কখনো তাঁর বান্দার উপর জুলুম করেন না।
আমাদের রোযা কবুল হয় না আমাদের দোষে। আমাদের কর্ম ফলে। প্রতিটি কাজেরই তো একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য ছাড়া কি কাজ হয়?
চাকরি করি ব্যবসা করি এমন আর্থিক সচ্ছলতা প্রাপ্তির জন্য যাতে জীবন ধারন উপকরণসমূহ সহজে পাওয়া যায়। পায়ে হাটি, গাড়িতে চড়ি নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। রান্না করি খাওয়ার জন্য। এমনকি কেউ আছে যে চাকরি করে কিন্তু বেতনের আশা করেনা। ব্যবসা করে- লাভ চায় না। কোনো গন্তব্যস্থল নেই এমনি ই গাড়িতে চড়ে। রান্না করে ফেলে দেয়, খায় না। এমন কোনো মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যাবে? আসলে মানুষের প্রত্যেকটা কাজের পেছনেই উদ্দেশ্য আছে।
চাকরি কিংবা ব্যবসা করে যদি সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করতে পারি তাহলে আমার চাকরি করা কিংবা ব্যবসা করা সফল। গাড়িতে চড়ে আমার নির্দিষ্ট স্থানে যদি যেতে পারি তাহলে আমার জার্নি করা সফল। তেমনি যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের জন্য এক মাস সিয়াম বা রোযা ফরজ করেছেন সেই উদ্দেশ্য বা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলেই সিয়াম সাধনা বা রোযা পালন সফল হবে। রোযা কবুল হবে।
একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যাবে-রমযানের একমাসের যে কর্মসূচী আল্লাহ গ্রহণ করেছেন তা হলো ভালো মানুষ তৈরীর কর্মসূচী।
আর রাসূল (সাঃ) সেই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। আমরাও যদি রাসূল (সাঃ) এর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী রমযান মাসে চলি। বলি এবং কাজ করি তাহলে আমার দৃঢ বিশ্বাস আমাদের রোযাও দয়াময় প্রেমময় রহমানুর রহিম কবুল করে নেবেন।
মহান আল্লাহর ভাষায় “তোমাদের প্রতি সিয়াম ফরজ করা হয়েছে। তোমাদের পূর্ববর্তী বান্দাদের উপরও ফরজ করা হয়েছিল সম্ভবত তোমরা মুত্তাকি হতে পারবে।” (সূরা বাকারা-১৮৩)
অর্থাৎ আমরা যাতে মুত্তাকি হতে পারি এই জন্যই আল্লাহ পাক আমাদের উপর সিয়াম ফরজ করেছেন। তাহলে হিসাব তো অতি সহজ যদি মুত্তাকি হতে পারি তো রোযা কবুল হয়েছে আর যদি মুত্তাকি হতে না পারি তাহলে রোযা কবুল হয় নি।
আমরা সবাই জানি মুত্তাকি মানে আল্লাহর ভয়ে ভীত ব্যক্তি। আসলে এই কথাটি পুরাপুরি ঠিক হল না। উপন্যাসিক শরৎ চন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন “ভুত আর ভগবান আমার কাছে একই রকম। ভুতকে না দেখে ভয় পাই, ভগবাকেও না দেখে ভয় পাই।”(!?)
মহান আল্লাহর প্রতি মুমিন মুসলমানের ভয় ভুত বা ভগবানকে ভয় করার মতো নয়। আল্লাহর প্রতি মুমিন বান্দার অন্তরে যেমন ভয় ুথাকবে, তেমনি থাকবে ভালোবাসা। এই ভীতি এবং প্রীতি যে বান্দার অন্তরে থাকবে তার নাম মুত্তাকি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন চান এই এক মাস সিয়াম পালনের মাধ্যমে বান্দা তার প্রতি ভালোবাসা মিশ্রিত ভয় কিংবা ভয় মিশ্রিত ভালোবাসা পোষণ করুক। এবং খাটি খলিফাতুল্লাহ হয়ে উঠুক।
রাসূল (সাঃ) বাস্তব কুরআন – আল্লাহ তা‘য়ালা আল কুরআনে যা কিছু বলেছেন রাসূল (সাঃ) সেই কাজটি বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। মুুত্তাকির পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ সূরা বাকারার ২নং আয়াতে বলেছেন ১. তারা গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন

২. সালাত কায়েম করবে

৩. আল্লাহর দেওয়া রিজিক থেকে খরচ করবে

৪. শেষ নবী মুহাম্মাদ সা. প্রতি নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি বিশ্বাস করবে

৫. পূর্ববর্তী কিতাবের প্রতি ও বিশ্বাস করবে এবং আখেরাতের প্রতি থাকবে দৃঢ় বিশ্বাস।

এই সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে মুত্তাকির বিস্তারিত গুণাবলী বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে মুত্তাকিরা ১. “আল্লাহ, আখেরাত, ফেরেশতা, কিতাব এবং নবী রাসূলদের প্রতি যথাযথভাবে বিশ্বাস স্থাপন করবে। ২. আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার তাগিদে নিকট আত্মীয়, গরীব দুঃখীদের সাহায্য করবে। ৩. সালাত কায়েম করবে যাকাত আদায় করবে। ৪. ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি পুরণ করবে এবং ৫. সবর করবে।
উপর্যুক্ত প্রতিটি কাজ রাসূল (সাঃ) করেছেন এবং সাহাবীদের ও পরবর্তী উম্মতদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে কাজ গুলো করতে হবে। আর এই রমযান মাসে কিভাবে ঐ সব গুণাবলী অর্জন করা যায় তাও দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন।
  ১.  হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)  হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করীম (সাঃ) শাবান মাসের শেষ দিন আমাদের সম্ভোধন করে ভাষণ দেন।
তাতে তিনি বলেন, “হে জনগণ! এক মহা পবিত্র ও বরকতের মাস তোমাদের উপর ছায়া বিস্তার করেছে। এ মাসের একটি রাত বরকত, ফযীলত ও মর্যাদার দিক দিয়ে সহগ্র মাস অপেক্ষা উত্তম। এ মাসের রোযা আল্লাহ তা‘য়ালা ফরজ করেছেন। যে লোক এ মাসে আল্লাহর সন্তোষ ও তার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে কোনো সুন্নত বা নফল ইবাদত করবে তাকে অন্যান্য সময়ের ফরজ ইবাদতের সমান সওয়াব দেওয়া হবে। আর যে লোক এ মাসে একটি ফরজ ইবাদাত করবে সে অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সওয়াব পাবেন। এটি  ধৈর্য ও তিতীক্ষার মাস। আর সবরের প্রতিফল আল্লাহর নিকট পাওয়া যাবে জান্নাত রূপে। এ হচ্ছে পরস্পর সহৃদয়তা ও সৌজন্য প্রদর্শনের মাস। এ মাসে মুমিনের রিযিক প্রশস্ত করে দেয়া হয়।
এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোযাদার কে ইফতার করাবে, তার ফল সরুপ তাকে মাফ করে দেয়া হবে ও জাহান্নাম থেকে নিস্কৃতি দেয়া হবে।
আর তাকে আসল রোযাদারের সমপরিমান সওয়াব দেওয়া হবে।
এতে আসল রোযাদারের সওয়াব কম করা হবেনা।
আমরা নিবেদন করলাম  ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে অনেকেই রোযাদারকে ইফতার করাবার সমর্থ রাখে না। (এ দরিদ্র লোকেরা কিভাবে সওয়াব পেতে পারে?) যে লোক রোযাদারকে একটা খেজুর বা দুধ বা এক গ্লাস সাদা পানি দ্বারাও ইফতার করাবে তাকেও আল্লাহ তা‘য়ালা একই সওয়াব দান করবেন। আর যে লোক একজন রোযাদারকে পূর্ণমাত্রায় পরিতৃপ্ত করবে আল্লাহ তা‘য়াল তাকে আমার ‘হাওজ’ হতে এমন পানীয় পান করাবেন যাতে জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে পিপাসার্ত হবে না। এটি এমন এক মাস যে, এর প্রথম দশ দিন রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় দশ দিন ক্ষমা ও মার্জনার জন্য ও শেষ দশ দিন জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভের উপায়।
আর যে লোক এ মাসে নিজের অধীন লোকদের শ্রম-মেহনত হ্রাস করে দেবে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে দোযখ থেকে নিস্কৃতি দেবেন। (বায়হাকী শুরাবিল ঈমান)
২. হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)  হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলে করীম সা. বলেছেন, আদম সন্তানের প্রত্যেকটি নেক আমলের সওয়াব দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু রোযা এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন  ‘রোযা একান্তভাবে আমারই জন্য। আমিই তার প্রতিফল দেব। রোযা পালনে আমার বান্দাহ আমারই সন্তোষ লাভের জন্য স্বীয় ইচ্ছ বাসনা ও পানাহার বন্ধ রাখে।’

 রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ:

প্রথটিা ইফতার করার সময়  দ্বিতীয়টি তার মালিক আল্লাহর সাথে সাক্ষাত লাভের সময় পাবে। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি থেকেও উত্তম।
আর রোযা ঢাল সরূপ। তোমাদের একজন যখন রোযা রাখে তখন সে যেনো বেহুদা ও অশ্লীল কথা না বলে এবং চিৎকার ও হট্টগোল না করে। অন্য কেউ যদি তাকে গালাগাল করে কিংবা তার সাথে ঝগড়া বিবাদ করতে আসে, তখন সে যেনো বলে আমি রোযাদার।” (সহীহ বুখারী)
৩. আনাস ইবনে মালেক (রাঃ)  থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রমযান মাস শুরু হলে রাসূল (সাঃ) বলেন, “তোমাদের নিকট এই মাস সমুপস্থিত। এতে রয়েছে এমন এক রাত যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ থেকে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হলো সে সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। (সহীহ বুখারী)
৪. হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)  থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “ যে লোক মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কাজ পরিত্যাগ করতে না পারল তার খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনোই প্রয়োজন নাই।”  (সহীহ বুখারী)
৫.  রাসূল (সাঃ) বলেছেন “যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় ঈমানসহ রমযানের রোযা রাখবে তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।
রমযান ও রোযা সম্পর্কিত আরও অনেক হাদীস আছে। উপরে বর্নীত এই পাঁচটি হাদীস থেকে আমরা রমযানের শিক্ষা কী? কিভাবে তা কাজে পরিণত করতে হবে উপলব্ধি করতে পারব। (চলবে…)

* মাসুদা সুলতানা রুমী

Related Post