আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)

আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)

আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)

নাম আলী, লকব আসাদুল্লাহ, হায়দার ও মুরতাজা, কুনিয়াত আবুল হাসান ও আবু তুরাব। পিতা আবু তালিব আবদু মান্নাফ, মাতা ফাতিমা। পিতা-মাতা উভয়ে কুরাইশ বংশের হাশিমী শাখার সন্তান। আলী রাসূল (সা) আপন চাচাতো ভাই।

রাসূল’র (সা) নবুওয়াত প্রাপ্তির দশ বছর পূর্বে তাঁর জন্ম। আবু তালিব ছিলেন ছাপোষা মানুষ। চাচাকে একটু সাহায্য করার উদ্দেশ্যে রাসূল (সা) নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেন আলীকে। এভাবে নবী পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে তিনি বেড়ে উঠেন। রাসূল (সাঃ) যখন নবুওয়াত লাভ করেন, আলীর বয়স তখন নয় থেকে এগার বছরের মধ্যে। একদিন ঘরে দেখলেন, রাসূলে কারীম (সাঃ) ও উম্মুল মূ’মেনীন হযরত খাদীজা (রাঃ) সিজদাবনত। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এ কি? উত্তর পেলেন, এক আল্লাহর ইবাদত করছি। তোমাকেও এর দাওয়াত দিচ্ছি। আলী বিনা দ্বিধায় কবুল করেন এবং মুসলমান হয়ে যান। কুফর, শিরক ও জাহিলিয়্যাতের কোন অপকর্ম তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ইসলাম পূর্বযুগে কোন প্রকারের শিরক ও কুফরী কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকার কারণে তিনি কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহ উপাধিতে ভূষিত হন।

রাসূল’র (সাঃ) সাথে সর্ব প্রথম হযরত খাদীজা (রাঃ) নামায আদায় করেন। এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। অবশ্য আবু বকর, আলী ও যায়িদ বিন হারিসা-এ তিন জনের মধ্যে কে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। (তাবাকাত ঃ ৩/১১)। ইবনে আব্বাস ও সালমান ফারসী (রা.)-এর বর্ণনা মতে, উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা.) পর আলী (রা.) সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে এ সম্পর্কে সবাই একমত যে, মহিলাদের মধ্যে খাদীজা, বয়স্ক আযাদ পুরুষদের মধ্যে আবু বকর, দাসদের মধ্যে যায়িদ বিন হারিসা ও কিশোরদের মধ্যে আলী (রা.) প্রথম মুসলমান।

নবুওয়াতের তৃতীয় বছরে রাসূলে কারীম (সা) হুকুম দিলেন আলীকে, কিছু লোকের আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর। আব্দুল মুত্তালিব খান্দানের সব মানুষ উপস্থিত হল। আহার পর্ব শেষ হলে রাসূল (সা) তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন ঃ আমি এমন এক জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন দুনিয়া উভয়ের জন্য কল্যাণকর। আপনাদের মধ্যে কে আমার সঙ্গী হবেন? সকলেই নিরব। হঠাৎ আলী (রা.) বলে উঠলেন ঃ যদিও আমি অল্প বয়স্ক, চোখের রোগে আক্রান্ত, দুর্বল দেহ, আমি সাহায্য করবো আপনাকে।

হিজরতের সময় হল। অধিকাংশ মুসলমান মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে গেছেন। রাসূলে কারীম (সা) আল্লাহর হুকুমের প্রতীক্ষায় আছেন। এ দিকে মক্কার ইসলাম-বিরোধী শক্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাসূলে কারীমকে (সা) দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে (সা) এ খবর জানিয়ে দেন। তিনি মদীনায় হিজরাতের অনুমতি লাভ করেন। কাফিরদের সন্দেহ না হয়, এজন্য আলীকে রাসূল (সা) নিজের বিছানায় ঘুমাবার নির্দেশ দেন এবং সিদ্দীকে আকবরকে সঙ্গে করে রাতের অন্ধকারে মদীনা রওয়ানা হন। আলী (রা.) রাসূল (সা)-এর চাদর মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে অত্যন্ত আনন্দ সহকারে ঘুমালেন। তিনি জানতেন, এ অবস্থায় তার জীবন চলে যেতে পারে। কিন্তু তাঁর প্রত্যয় ছিল, এ ভাবে জীবন গেলে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছু হবে না। সুবহে সাদিকের সময় মক্কার পাষ-রা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যে ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পেল, রাসূল (সা)-এর স্থানে তাঁরই এক ভক্ত জীবন কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হয়ে শুয়ে আছে। তারা ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহ তা’য়ালা আলীকে (রা.) হিফাজত করেন।

এ হিজরত প্রসঙ্গে আলী (রা.) বলেন ঃ রাসূল (সাঃ) মদীনা রওয়ানার পূর্বে আমাকে নির্দেশ দিলেন, আমি মক্কায় থেকে যাওয়ার জন্য এবং লোকদের যে সব আমানত তাঁর কাছে আছে তা ফেরত দেওয়ার জন্য। এ জন্যেই তো তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলা হতো। আমি তিনদিন মক্কায় থাকলাম। তারপর রাসূলর (সা.) পথ ধরে মদীনার দিকে বেরিয়ে পড়লাম। অবশেষে বনী আমর ইবন আওফ- যেখানে রাসূল (সা.) অবস্থান করছিলেন, আমি উপস্থিত হলাম। কুলসুম ইবন হিদামের বাড়ীতে আমার আশ্রয় হল। অন্য একটি বর্ণনায়, আলী (রা.) রবিউল আউয়াল মাসের মাঝামাঝি কুবায় উপস্থিত হন। রাসূল (সা.) তখনও কুবায় ছিলেন। (তাবাকাত ঃ ৩/২২)

মাদানী জীবনের সূচনাতে রাসূল (সা.) যখন মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে ‘উখ্যুওয়াত’ বা দ্বীনি-ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করছিলেন, তিনি নিজের একটি হাত আলীর (রা.) কাঁধে রেখে বলেছিলেন, আলী তুমি আমার ভাই। তুমি হবে আমার এবং আমি হব তোমার উত্তরাধিকারী। পরে রাসূল (সা.) আলী ও সাহল বিন হুনাইফের মধ্যে ভ্রাতৃ সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন। (তাবাকাত ঃ ৩/২২)।

হিজরী দ্বিতীয় সনে আলী (রা.) রাসূলর (সা.) জামাই হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। রাসূলর (সা.) প্রিয়তমা কন্যা খাতুনে জান্নাত ফাতিমার (রা.) সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

ইসলামের জন্য আলী (রা.) অবদান অবিস্বরণীয়। রাসূলর (সা.) যুগের সকল যুদ্ধে সব চেয়ে বেশি সাহসিকতার ও বীরত্বের পরিচয় তিনিই দেন। এ কারণে হুজুর (সা.) তাঁকে ‘হায়দার’ উপাধিসহ ‘যুল-ফিকার’ নামক একখানি তরবারি দান করেন।

একমাত্র তাবুক অভিযান ছাড়া সকল যুদ্ধেই তিনি অংশ গ্রহণ করেন। বদরে তাঁর সাদা পশমী রুমালের জন্য তিনি ছিলেন চিহ্নিত। কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, বদরসহ  প্রতিটি যুদ্ধে আলী ছিলেন রাসূল’র (সা.) পতাকাবাহী, (তাবাকাত ঃ ৩/২৩)। ওহুদে যখন অন্য সব মুজাহিদ পরাজিত হয়ে পালিয়েছিলেন, তখন যে ক’জন মুষ্টিমেয় সৈনিক রাসূলকে (সা.) কেন্দ্র করে ব্যুহ রচনা করেছিলেন, আলী (রা.) ছিলেন তাঁদের একজন। অবশ্য পলায়নকারীদের প্রতি আল্লাহর ক্ষমা ষোষিত হয়েছে।

ইবন ইসহাক থেকে বর্ণিত, খন্দকের দিনে ‘আমর ইবন আবদে উদ্দ বর্ম পরে বের হল। সে হুঙ্কার ছেড়ে বলল ঃ কে আমার সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে? আলী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ঃ হে আল্লাহর নবী, আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা.) বললেন ঃ এ হচ্ছে ‘আমর’ তুমি বস।’ ‘আমর আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল ঃ আমার সাথে লড়বার মত কেউ নেই? তোমাদের সেই জান্নাত এখন কোথায়, যাতে তোমাদের নিহতরা প্রবেশ করবে বলে তোমাদের ধারণা? তোমাদের কেউ এখন আমার সাথে লড়তে সাহসী নয়? আলী (রা.) উঠে দাঁড়ালেন। বললেন ঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা.) বললেন ঃ বস। তৃতীয় বারের মত আহবান জানিয়ে ‘আমর তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো। আলী (রা.) আবার উঠে দাঁড়িয়ে আরজ করলেন ঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি প্রস্তুত। রাসূল (সা.) বললেন ঃ সে তো ‘আমর। আলী (রা.) বললেন ঃ তা হোক। এবার আলী (রা.) অনুমতি পেলেন। আলী (রা.) তাঁর একটি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমর জিজ্ঞেস করলো ঃ তুমি কে? বললেনঃ আলী। সে বললো ঃ আবদে মান্নাফের ছেলে? আলী (রা.) বললেন আমি আবু তালিবের ছেলে আলী। সে বললো ঃ ভাতিজা, তোমার রক্ত ঝরানো আমি পসন্দ করিনা। আলী বললেন ঃ আল্লাহর কসম, তোমার রক্ত ঝরানো আমি অপসন্দ করিনা। একথা শুনে আমর ক্ষেপে গেল। নিচে নেমে এসে তরবারী টেনে বের করে ফেললো। সে তরবারী যেন আগুনের শিখা। সে এগিয়ে আলীর ঢালে আঘাত করে ফেঁড়ে ফেলল। আলী পাল্টা এক আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ফেললেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা.) তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠেন। তারপর আলী নিজের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রাসূল (সা.) কাছে ফিরে আসেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ঃ ইবনে কাসীর ৪/১০৬)

সপ্তম হিজরীতে খাইবার অভিযান চালানো হয়। সেখানে ইয়াহুদীদের কয়েকটি সুদৃঢ় কিল্ল¬া ছিল। প্রথমে সিদ্দীকে আকবর, পরে ফারুকে আজমকে কিল্ল¬াগুলি পদানত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউ সফলকাম হতে পারলেন না। নবী (সাঃ) ঘোষনা করলেন ঃ ‘কাল আমি এমন এক বীরের হাতে ঝান্ডা তুলে দেব যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রিয়পাত্র। তারই হাতে কিল্ল¬াগুলির পতন হবে।’ পরদিন সকালে সাহাবীদের সকলেই আশা করছিলেন এই গৌরবটি অর্জন করার। হঠাৎ আলীর ডাক পড়লো। তাঁরই হাতে খাইবারের সেই দুর্জয় কিল্লাগুলির পতন হয়।

তাবুক অভিযানে রওয়ানা হওয়ার সময় রাসূল (সাঃ) আলীকে (রাঃ) মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। আলী (রাঃ) আরজ করলেন ঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যাচ্ছেন, আর আমাকে নারী ও শিশুদের কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন? উত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন ঃ হারুন যেমন ছিলেন মুসার তেমনি তুমি হচ্ছো আমার প্রতিনিধি। তবে আমার পরে কোন নবী নেই। (তাবাকাত ৩/২৪)

নবম হিজরীতে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে প্রথম ইসলামী হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) ছিলেন ‘আমীরুল হজ্ব’ তবে কাফিরদের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি বাতিল ঘোষণার জন্য রাসূল (সাঃ) আলীকে (রাঃ) বিশেষ দূত হিসেবে প্রেরণ করেন।

দশম হিজরীতে ইয়ামানে ইসলাম প্রচারের জন্য খালিদ সাইফুল্ল¬াহকে পাঠানো হয়। ছ’মাস চেষ্টার পরও তিনি সফলকাম হতে পারলেন না। ফিরে এলেন। রাসূল (সাঃ) আলীকে (রাঃ) পাঠানোর কথা ঘোষণা করলেন। আলী (রাঃ) রাসূল’র (সাঃ) কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন ঃ আপনি আমাকে এমন লোকদের কাছে পাঠাচ্ছেন যেখানে নতুন নতুন ঘটনা ঘটবে অথচ বিচারের ক্ষেত্রে আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। উত্তরে রাসূল (সাঃ) বললেন ঃ আল্লাহ তোমাকে সঠিক রায় এবং তোমার অন্তরে শক্তিদান করবেন। তিনি আলীর (রাঃ) মুখে হাত রাখলেন। আলী বলেন ঃ ‘অতঃপর আমি কক্ষণো কোন বিচারে দ্বিধাগ্রস্ত হইনি’। যাওয়ার আগে রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে আলীর (রাঃ) মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দু’আ করেন। আলী ইয়ামানে পৌঁছে তাবলীগ শুরু করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে সকল ইয়ামানবাসী ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং হামাদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে যায়। রাসূল (সাঃ) আলীকে (রাঃ) দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন। তিনি দু’আ করেন ঃ আল্লাহ, আলীকে না দেখে যেন আমার মৃত্যু না হয়। আলী (রাঃ) বিদায় হজ্জের সময় ইয়ামান থেকে হাজির হয়ে যান।

রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর তাঁর নিকট-আত্মীয়রাই কাফন দাফনের দায়িত্ব পালন করেন। আলী (রাঃ) গোসল দেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। মুহাজির ও আনসারগণ তখন দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।

আবু বকর, উমর ও উসমানের (রাঃ) খিলাফত মেনে নিয়ে তাঁদের হাতে বাইয়াত করেন এবং তাঁদের যুগের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে শরীক থাকেন। অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতেও উসমানকে (রাঃ) পরামর্শ দিয়েছেন। যেভাবে আবু বকরকে ‘সিদ্দীক’, উমারকে ‘ফারুক’ এবং উসমানকে ‘গনী’ বলা হয়, তেমনিভাবে তাঁকেও ‘আলী মুরতাজা’ বলা হয়। আবু বকর ও উমারের যুগে তিনি মন্ত্রী ও উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। উসমানও সব সময় তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। (মারুজুজ জাহাব ঃ ২/২)। বিদ্রোহীদের দ্বারা উসমান (রাঃ) ঘেরাও হলে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে আলীই (রাঃ) সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেন। সেই ঘেরাও অবস্থায় উসমান (রাঃ) বাড়ির নিরাপত্তার জন্য তিনি তাঁর দু’পুত্র হাসান ও হোসাইনকে নিয়োগ করেন। (আল-ফিতনাতুল কুবরা ঃ ডাঃ ত্বাহা হোসাইন)

উমার (রাঃ) ইনতিকালের পূর্বে ছ’জন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম উল্লেখ করে তাঁদের মধ্য থেকে কাউকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের অসীয়াত করে যান। আলীও ছিলেন তাদের একজন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আলীর (রাঃ) সম্পর্কে মন্তব্য করেন ঃ লোকেরা যদি আলী (রাঃ)-কে খলিফা বানায়, তবে সে তাদেরকে ঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে পারবে। (আল-ফিতনাতুল কুবরা)। উমার (রাঃ) বাইতুল মাকদিস সফরের সময় আলীকে (রাঃ) মদীনায় নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যান।

উসমানের (রাঃ) শাহাদাতের পর বিদ্রোহীরা তালহা, যুবাইর ও আলীকে (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ দেয়। প্রত্যেকেই অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, আলী (রাঃ) বার বার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। অবশেষে মদীনাবাসীরা আলীর (রাঃ) কাছে গিয়ে বলে, খিলাফতের এ পদ এভাবে শূন্য থাকতে পারে না। বর্তমানে এ পদের জন্য আপনার চেয়ে অধিক উপযুক্ত কোন ব্যক্তি নেই। আপনিই এর হকদার। মানুষের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি খিলাফতের দাযিত্ব গ্রহণে সম্মত হন। তবে শর্তারোপ করেন যে, আমার বাইয়াত গোপনে হতে পারবে না। এ জন্য সর্ব শ্রেণীর মুসলমানের সম্মতি প্রয়োজন। মসজিদে নববীতে সাধারণ সভা হলো। মাত্র ষোল অথবা সতর জন সাহাবা ছাড়া সকল মুহাজির ও আনসার আলীর (রাঃ) হাতে বাইয়াত করেন।

অত্যন্ত জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে আলী (রাঃ) খিলাফতের সূচনা হয়। খলিফা হওয়ার পর তাঁর প্রথম কাজ ছিল উসমান (রাঃ) হত্যাকারীদের শাস্তির বিধান করা। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না। প্রথমতঃ হত্যাকারীদের কেউ চিনতে পারেনি। উসমানের স্ত্রী নায়িলা হত্যাকারীদের দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের কাউকে চিনতে পারেননি। মুহাম্মাদ বিন আবু বকর হত্যার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু উসমানের এক ক্ষোভ-উক্তির মুখে তিনি পিছটান দেন। মুহাম্মাদ বিন আবু বকরও হত্যাকারীদের চিনতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ মদীনা তখন হাজার হাজার বিদ্রোহীদের কব্জায়। তারা আলীর (রাঃ) সেনাবাহিনীর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তাঁর এই অসহায় অবস্থা তৎকালীন অনেক মুসলমানই উপলব্দি করেননি। তারা হযরত আলীর (রাঃ) নিকট তক্ষুণি উসমানের ‘কিসাস’ দাবী করেন। এই দাবী উত্থাপনকারীদের মধ্যে উম্মুল মু’মেনীন আয়িশা (রাঃ)-সহ তালহা ও যুবাইরের (রাঃ) মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও ছিলেন। তাঁরা আয়িশার (রাঃ) নেতৃত্বে সেনাবাহিনীসহ মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন। সেখানে তাঁদের সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বেশি। আলীও (রাঃ) তাঁর বাহিনীসহ সেখানে পৌঁছেন। বসরার উপকন্ঠে বিরোধী দুই শিবির মুখোমুখি হয়। আয়িশা (রাঃ) আলীর (রাঃ) কাছে তাঁর দাবী পেশ করেন। আলীও (রাঃ) তাঁর সমস্যাসমূহ তুলে ধরেন। যেহেতু উভয় পক্ষেই ছিল সততা ও নিষ্ঠা তাই নিস্পত্তি হয়ে যায়। তালহা ও যুবাইর (রাঃ) ফিরে চললেন। আয়িশাও ফেরার প্রস্তুতি শুরু করলেন। কিন্তু হাঙ্গামাও অশান্তি সৃষ্টিকারীরা উভয় বাহিনীতে ছিল। তাই আপোষ মীমাংসায় তারা ভীত হয়ে পড়ে। তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাতে অন্ধকারে এক পক্ষ অন্য পক্ষের শিবিরে হামলা চালিয়ে দেয়। ফল এই দাড়ায়, উভয় পক্ষের মনে এই ধারনা জন্মালো যে, আপোষ মীমাংসার নামে ধোঁকা দিয়ে প্রতিপক্ষ তাঁদের উপর হামলা করে বসেছে। পরিপূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আলীর (রাঃ) জয় হয়। তিনি বিষয়টি আয়েশাকে (রাঃ) বুঝাতে সক্ষম হন। আয়িশা (রাঃ) বসরা থেকে মদীনায় ফিরে যান।

যুদ্ধের সময় আয়িশা উটের উপর সওয়ার ছিলেন। ইতিহাসে তাই এ যুদ্ধ ‘উটের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। হিজরী ৩৬ সনের জামাদি-উস-সানী মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আশারায়ে মুবাশ্শারার সদস্য তালহা ও যুবাইর (রাঃ) সহ উভয় পক্ষে মোট ১৩,০০০ মুসলমান শহীদ হন। আলী (রাঃ) ১৫ দিন বসরায় অবস্থানের পর কুফায় চলে যান। রাজধানী মদীনা হতে কুফায় স্থানান্তরিত হয়।

এই উটের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের প্রথম আত্মঘাতী সংঘর্ষ। অনেক সাহাবী এ যুদ্ধে কোন পক্ষেই যোগদান করেন নি। এই আত্মঘাতি সংঘর্ষের জন্য তাঁরাও ব্যথিত হয়েছিলেন। আলীর (রাঃ) বাহিনী যখন মদীনা হতে রওয়ানা হয়, মদীনাবাসীরা তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

আয়িশার (রাঃ) সাথে তো একটা আপোষ রফায় আসা গেল। কিন্তু সিরিয়ার গভর্ণর মুয়াবিয়ার (রাঃ) সঙ্গে কোন মীমাংসায় পৌঁছা গেল না। আলী (রাঃ) তাকে সিরিয়ার গভর্ণর পদ থেকে বরখাস্ত করেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) বেঁকে বসলেন। আলীর (রাঃ) নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন। তাঁর বক্তব্যের মূল কথা ছিল, ‘উসমান হত্যার কিসাস না হওয়া পর্যন্ত তিনি আলীকে খলিফা মানবেন না।

হিজরী ৩৭ সনের সফর মাসে ‘সিফ্ফীন’ নামক স্থানে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) বাহিনীর মধ্যে এক সংঘর্ষ ঘটে যায়। এ সংঘর্ষ ছিল উটের যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ। উভয় পক্ষের ৯০,০০০ (নব্বই হাজার) মুসলমান শাহাদাৎ বরণ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহাবী ‘আম্মার বিন ইয়াসীর, খুযাইমা ইবন সাবিত ও আবু আম্মারা আল-মাযিনীও (রাঃ) ছিলেন। তাঁরা সকলেই আলীর (রাঃ) পক্ষে মুয়াবিয়ার (রাঃ) বাহিনীর হাতে শহীদ হন। উল্লেখ্য যে, আম্মার বিন ইয়াসীর সম্পর্কে রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন ঃ ‘আফসুস, একটি বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে।’ (সহীহ বুখারী) সাতাশজন প্রখ্যাত সাহাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুয়াবিয়াও হাদীসটির একজন বর্ণনাকারী। অবশ্য মুয়াবিয়া (রাঃ) হাদীসটির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এতকিছুর পরও বিষয়টির ফায়সালা হলো না।

সিফ্ফীনের সর্বশেষ সংঘর্ষে, যাকে লাইলাতুল হার’ বলা হয়, আলীর (রাঃ) জয় হতে চলছিল। মুয়াবিয়া (রাঃ) পরাজয়ের ভাব বুঝতে পেরে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মীমাংসার আহবান জানালেন। তার সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে উঁচু করে ধরে বলতে থাকে, এই কুরআন আমাদের এ দ্বন্দ্বের ফায়সালা করবে। যুদ্ধ বিরতী ঘোষিত হলো। আলীর পক্ষে আবু মুসা আশয়ারী  এবং মুয়াবিয়ার পক্ষে আমর ইবনুল আস (রাঃ) হাকাম বা সালিশ নিযুক্ত হলেন। সিদ্ধান্ত হলো, এই দু’জনের সম্মিলিত ফায়সালা বিরোধী দু’পক্ষই মেনে নেবেন। ‘দুম্মাতুল জান্দাল’ নামক স্থানে মুসলমানদের বড় আকারের এক সম্মেলন হয়। কিন্তু সব ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করলে যে সিদ্ধান্তটি পাওয়া যায় তাহলো, ‘আমর ইবনুল আস’ ‘আবু মুসা আশআরীর’ (রাঃ) সঙ্গে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা থেকে সরে আসায় এ সালিশী বোর্ড শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। দুম্মাতুল জান্দাল থেকে হতাশ হয়ে মুসলমানরা ফিরে গেল। অতঃপর আলী ও মুয়াবিয়া (রাঃ) অনর্থক রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে সন্ধি করলেন। এ দিন থেকে মূলতঃ মুসলিম খিলাফত দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল।

এ সময় ‘খারেজী’ নামে নতুন একটি দলের জন্ম হয়। প্রথমে তারা ছিল আলীর সমর্থক। কিন্তু পরে তারা এ বিশ্বাস প্রচার করতে থাকে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কোন মানুষকে ‘হাকাম’ বা সালিশ নিযুক্ত করা কুফরী কাজ। আলী (রাঃ) আবু মুসা আশআরীকে (রাঃ) হাকাম মেনে নিয়ে কুরআনের খেলাফ কাজ করেছেন। সুতরাং আলী তাঁর আনুগত্য দাবী করার বৈধতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা আলী (রাঃ) থেকে পৃথক হয়ে যায়। তারা ছিল চরমপন্থী। তাদের সাথে আলীর (রাঃ) একটি যুদ্ধ হয় এবং তাতে বহু হতাহত হয়।

এই খারেজী সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তি আব্দুর রহমান ইবন মুলজিম, আল বারাক ইবন আবদিল্লাহ ও আরম ইবন বকর আত-তামীমী, নাহরওয়ানের যুদ্ধের পর এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মুসলিম উম্মার অন্তর্কলহের জন্য দায়ী মূলতঃ আলী, মুয়াবিয়া ও আমর ইবলুল আস (রাঃ)। সুতরাং এ তিন ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সিদ্ধান্ত মুতাবিক ইবন মুলজিম দায়িত্ব নিল আলী (রাঃ) এবং আল-বারাক ও আমার দায়িত্ব নিল যথাক্রমে মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসের (রাঃ)। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, মারবে, নয়তো মরবে। হিজরী ৪০ সনের ১৭ রমজান ফজরের নামাযের সময়টি এ কাজের জন্য নির্ধারিত হয়। অতঃপর ইবন মুলজিম কুফা, আল-বারাক দিমাশ্ক ও আমর মিসরে চলে যায়।

হিজরী ৪০ সনের ১৬ রমজান শুক্রবার দিবাগত রাতে আততায়ীরা আপন আপন স্থানে ওত পেতে থাকে। ফজরের সময় আলী (রাঃ) অভ্যাসমত আস-সালাত বলে মানুষকে নামাযের জন্য ডাকতে ডাকতে যখন মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, পাপাত্মা ইবন মুলজিম শাণিত তরবারী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে আহত করে। আহত অবস্থায় আততয়ীকে ধরার নির্দেশ দিলেন। সন্তানদের ডেকে অসীয়াত করলেন। চার বছর নয় মাস খিলাফত পরিচালনার পর ১৭ রমজান ৪০ হিজরী শনিবার কুফায় শাহাদাত বরণ করেন।

একই দিন একই সময় মুয়াবিয়া (রাঃ) যখন মসজিদের যাচ্ছিলেন, তাঁরও উপর হামলা হয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তিনি সামান্য আহত হন। অন্য দিকে ‘আমর ইবনুল আস অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদে যান নি। তার পরিবর্তে পুলিশ বাহিনীর প্রধান খারেজা ইবন হুজাফা ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন। তাঁকেই ‘আমর ইবন আস মনে করে শহীদ করা হয়। এভাবে মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস (রাঃ) প্রাণে রক্ষা পান। (তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাঃ খিদরী বেক)

আলীর (রাঃ) নামাযে জানাযার ইমামতি করেন হাসান ইবন আলী (রাঃ)। কুফা জামে মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে নাজফে আশরাফে তাঁকে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। আততায়ী ইবন মুলজিমকে ধরে আনা হলে আলী (রাঃ) নির্দেশ দেন ঃ ‘সে কায়েদী। তার থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা কর। আমি বেঁচে গেলে তাঁকে হত্যা অথবা ক্ষমা করতে পারি। যদি আমি মারা যাই, তোমরা তাকে ঠিক ততটুকু আঘাত করবে যতটুকু সে আমাকে করেছে। তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। যারা বাড়াবড়ি করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না।’ (তাবাকাত ঃ ৩/৩৫)

আলী (রাঃ) প্রায় পাঁচ বছর খিলাফত পরিচালনা করেন। একমাত্র সিরিয়া ও মিসর ছাড়া মক্কা ও মদীনাসহ সব এলাকা তাঁর অধীনে ছিল। তাঁর সময়টি যেহেতু গৃহযুদ্ধে অতিবাহিত হয়েছে, এ কারণে নতুন অঞ্চল বিজিত হয়নি।

আলী (রা.) তাঁর পরে অন্য কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যান নি। লোকেরা যখন তাঁর পুত্র হাসানকে (রা.) খলিফা নির্বাচিত করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিল। তিনি বলেছিলেন, এ ব্যাপারে তোমাদের নির্দেশ অথবা নিষেধ কোনটাই করছি না। অন্য এক ব্যক্তি যখন জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি আপনার প্রতিনিধি নির্বাচন করে যাচ্ছেন না কেন? বললেন: আমি মুসলিম উম্মাহকে এমনভাবে ছেড়ে যেতে চাই যেমন গিয়েছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা)।

আলীর (রা.) ওফাতের পর ‘দারুল খিলাফা’-রাজধানী কুফার জনগণ হযরত হাসানকে (রা.) খলিফা নির্বাচন করে। তিনি মুসলিম উম্মার আন্তঃকলহ ও রক্তপাত পছন্দ করলেন না। একারণে, মুয়াবিয়া (রা.) ইরাক আক্রমণ করলে তিনি যুদ্ধের পরিবর্তে মুয়াবিয়ার হাতে খিলাফতের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া সমীচীন মনে করলেন। এ ভাবে হাসানের (রা.) নজিরবিহীন কুরবানী মুসলিম জাতিকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে মুক্তি দেয়। খিলাফত থেকে তাঁর পদত্যাগের বছরকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আমুল জামায়াহ’- ঐক্য ও সংহতির বছর নামে অভিহিত করা হয়। পদত্যাগের পর হাসান কুফা ত্যাগ করে মদীনা চলে আসেন এবং নয় বছর পর হিজরী পঞ্চাশ সনে মদীনায় ইনতিকাল করেন। মাত্র ছয় মাস তিনি খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন।

উমার (রা.) আলী (রা.) সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ফায়সালাকারী আলী’। এমনকি রাসূল (সা) বলেছিলেন, ‘আকদাহুম আলী’- তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিচারক আলী।’ তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত লক্ষ্য করে উমার (রা.) একাধিকবার বলেছেন : ‘লাওলা আলী লাহালাকা উমার- আলী না হলে ‘উমার হালাক হয়ে যেত।’

আলী (রা.) নিজেকে একজন সাধারণ মুসলমানের সমান মনে করতেন এবং যে কোন ভুলের কৈফিয়তের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। একবার এক ইয়াহুদি তাঁর বর্ম চুরি করে নেয়। আলী বাজারে বর্মটি বিক্রি করতে দেখে চিনে ফেলেন। তিনি ইচ্ছা করলে জোর করে নিতে পারতেন। কিন্তু তা করেন নি। আইন অনুযায়ী ইয়াহুদির বিরুদ্ধে কাযীর আদালতে মামলা দায়ের করেন। কাজীও ছিলেন কঠোর ন্যায় বিচারক। তিনি আলী (রা.) দাবীর সমর্থনে প্রমাণ চাইলেন। আলী (রা.) তা দিতে পারলেন না, তিনি তার পুত্র হাসানকে (রা.) সাক্ষী হিসাবে নিয়ে আসলে বিচারক তার (পুত্রের) সাক্ষ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। কাজী ইয়াহুদির পক্ষে মামলার রায় দিলেন। এই ফায়সালার প্রভাব ইয়াহুদির উপর এতখানি পড়েছিল যে, সে মুসলমান হয়ে যায়। সে মন্তব্য করেছিল, ‘এতো নবীদের ইনসাফ। আলী (রা.) আমীরুল মো’মেনীন হয়ে আমাকেও কাজীর সামনে উপস্থিত করেছেন এবং তাঁরই নিযুক্ত কাজী তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।’ আলী (রা.) বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলে কারীম (সা) পরিবারের সাথেই থাকতেন। বিয়ের পর পৃথক বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। জীবিকার প্রয়োজন দেখা দিল, কিন্তু পুঁজি ও উপকরণ কোথায়? গতর খেটে এবং গণীমতের হিস্যা থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন। উমারের (রা.) যুগে ভাতা হলে তাঁর ভাতা নির্ধারিত হয় বছরে পাঁচ হাজার দিরহাম। হাসান (রা.) বলেন, মৃত্যুকালে একটি গোলাম খরীদ করার জন্য জমা করা মাত্র সাতশত দিরহাম রেখে যান। (তাবাকাত ঃ ৩/৩৯)।

জীবিকার অনটন আলীর (রা.) ভাগ্য থেকে কোন দিন দূর হয় নি। একবার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) সময়ে ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বেধে থেকেছি। (হায়াতুস সাহাবা ঃ ৩/৩১২)। খলিফা হওয়ার পরেও ক্ষুধা ও দারিদ্রের সাথে তাকে লড়তে হয়েছে। তবে তাঁর অন্তরটি ছিল অত্যন্ত প্রশস্ত। কোন অভাবীকে তিনি ফেরাতেন না। এ জন্য তাঁকে অনেক সময় সপরিবারে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। তিনি ছিলেন দারুন বিনয়ী। নিজের হাতেই ঘর-গৃস্থালীয় সব কাজ করতেন। সর্বদা মোটা পোশাক পরতেন। তাও ছেঁড়া, তালি লাগানো। তিনি ছিলেন জ্ঞানের দরযা। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁর কাছে এসে দেখতে পেত তিনি উটের রাখালী করছেন, ভূমি কুপিয়ে ক্ষেত তৈরী করছেন। তিনি এতই অনাড়ম্বর ছিলেন যে, সময় সময় মাটির উপর শুয়ে যেতেন। একবার তাঁকে রাসূল (সা) এ অবস্থায় দেখে সম্বোধন করেছিলেন, ‘ইয়া আবা তুরাব’- হে মাটির অধিবাসী প্রাকৃতজন। তাই তিনি পেয়েছিলেন, ‘আবু তোরাব’ লকবটি। খলিফা হওয়ার পরও তাঁর এ সরল জীবন অব্যাহত থাকে। উমারের (রা.) মত সব সময় একটি দুররা বা ছড়ি হাতে নিয়ে চলতেন, লোকদের উপদেশ দিতেন। (আল-ফিতনাতুল কুবরা)

আলী (রা.) ছিলেন নবী খান্দানের সদস্য যিনি নবীর (সা) প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানে শিক্ষা লাভ করেন। রাসূল (সা) বলেছেন ঃ ‘আনা মাদীনাতুল ইলম ওয়া আলী বাবুহা’- ‘আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী সে নগরীর প্রবেশদ্বার। (তিরমিযি)। তিনি ছিলেন কুরআনের হাফিজ এবং একজন শ্রেষ্ঠ মুফাসসির। কিন্তু হাদীসও সংগ্রহ করেছিলেন। তবে হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। কেউ তাঁর কাছে কোন হাদীস বর্ণনা করলে, বর্ণনাকারীর নিকট থেকে শপথ নিতেন। (তাজকিয়াতুল হুফফাজ ঃ ১/১০)। তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর থেকে বহু বিখ্যাত সাহাবী এবং তাবে’ঈ হাদীস বর্ণনা করেছেন। পূর্ববতী খলিফাদের যুগে মহাজিরদের তিনজন ও আনসারদের তিনজন ফাতওয়া দিতেন। যথা ঃ উমার, উসমান, আলী, উবাই বিন কা’ব, মুয়াজ বিন জাবাল ও যায়িদ বিন সাবিত। মাসরুক থেকে অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীদের মধ্যে ফাতওয়া দিতেন ঃ আলী, ইবন মাসউদ, যায়িদ, উবাই বিন কা’ব, আবু মুসা আশয়ারী। (তাবাকাত ঃ ৪/১৬৭, ১৭৫)

আলী ছিলেন একজন সুবক্তা ও ভালো কবি। (কিতাবুল উমদা ঃ ইবন রশীক ১/২১) তাঁর কবিতার একটি ‘দিওয়ান’ (যা দিওয়ানে আলী নামে পরিচিত) আমরা পেয়ে থাকি। তাতে অনেকগুলি কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেকগুলি কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবী কাব্য জগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল, তাতে প-িতদের কোন সংশয় নেই। নাহজুল বালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সঙ্কলন আছে যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মীতার স্বাক্ষর বহন করে চলছে। (তারীখুল আদাব আল-আরাবী ঃ ডঃ উমার ফাররুখঃ ১/৩০৯)

খাতুনে জান্নাত নবী কন্যা ফাতিমার (রা.) সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। যতদিন ফাতিমা জীবিত ছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। ফাতিমার মৃত্যুর পর একাধিক বিয়ে করেছেন। তাবারীর বর্ণনা মতে, তাঁর চৌদ্দটি ছেলে ও সতেরটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ফাতিমার (রা.) গর্ভে তিন পুত্র হাসান, হুসাইন, মুহসিন এবং দু’কন্যা যয়নাব ও উম্মুকুলসুম জন্ম লাভ করেন। শৈশবেই মুহসীন মারা যায়। ওয়াকিদীর বর্ননা মতে, মাত্র পাঁচ ছেলে হাসান, হুসাইন মুহাম্মদ (ইবনুল হানাফিয়্যা), আব্বাস এবং উমার থেকে তাঁর বংশ ধারা চলছে।

ইমাম আহমদ (র) বলেন, আলীর (রা.) মর্যাদা ও ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) থেকে যত কথা বর্ণিত হয়েছে, অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে তা হয় নি। (আল-ইসাবা ঃ ২/৫০৮)। ইতিহাসে তাঁর যত গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, এ সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে তার কিয়দাংশও তুলে ধরা সম্ভব নয়। রাসূল (সা) অসংখ্যবার তাঁর জন্যও তাঁর সন্তানদের জন্য দুআ করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন ’ একমাত্র মুমিনরা ছাড়া তোমাকে কেউ ভালবাসবে না এবং মুনাফিকরা ছাড়া কেউ তোমাকে হিংসা করবে না।

আলীর (রা.) এক সাথী দুরার ইবন দামরা আল কিনানী একদিন মুয়াবিয়ার (রা.) কাছে এলেন। মুয়াবিয়া তাকে আলীর গুণাবলী বর্ণনা করতে অনুরোধ করেন। প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার চাপাচাপিতে দীর্ঘ এক বর্ণনা দান করেন। তাতে আলী (রা.) গুণাবলী চমৎকারভাবে ফুটে উঠে। ঐতিহাসিকরা বলেছেন এ বর্ণনা শুনে মুয়াবিয়াসহ (রা.) তার সাথে বৈঠকে উপস্থিত সকলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অতঃপর মুয়াবিয়া (রা.) মন্তব্য করেন ঃ ‘আল্লাহর কসম, আবু হাসান এমনই ছিলেন।’ (আল-ইসতিয়াব ঃ ৩/৪৪)।  সমাপ্ত

Related Post