পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুম মেনে চলার মধ্যেই মানব পরিচয়ের সার্থকতা। কিন্তু মানুষের পক্ষে প্রায়শই সেটা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে তিনটি শক্ত প্রতিপক্ষ মানুষকে বাঁধা প্রদান করে। সেগুলো হলো ১. নিজের প্রবৃত্তি,২. পার্থিব মোহ ও ৩. শয়তানের প্রতারণা।
এই তিনটি কঠিন প্রতিকূলতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্বসমূহ সঠিকভাবে পালন করতে মানুষের প্রয়োজন ইস্পাতকঠিন মানসিক শক্তি। কারণ শয়তান সর্বদা মানুষকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে চলতে প্ররোচিত করে। তার নিজের প্রবৃত্তি সব সময় আকর্ষণীয় বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু হালাল হারামের কোনো বাছ-বিচার সে করে না। আর পৃথিবীর যাবতীয় চিত্তাকর্ষক বিষয় মানুষকে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচারণে উদ্বুদ্ধ করে। চলমান জীবনের বাস্তবতায় বজ্রকঠিন মানসিক শক্তি ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে আল্লাহর বিধানের ওপর টিকে থাকা সম্ভব নয়। মানুষকে সেই মানসিক শক্তি যোগায় তাকওয়া নামক তার আত্মার এক সুকোমল বৃত্তি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর সামনে (হাশরের ময়দানে) দন্ডয়মান হওয়াকে ভয় করবে আর প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে জান্নাত হবে তার ঠিকানা।’
মানুষের মাঝে তাকওয়ার মহৎ গুণটি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহতায়ালা তার মুমিন বান্দার ওপর মাহে রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। এ বিষয়ে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’(সুরা বাকারা : ১৮৩)
তাকওয়া আরবি শব্দটির আভিধানিক অর্থ ভয় করা। পরিভাষায় তাকওয়া বলতে মানব মনের এমন এক প্রবৃত্তিকে বোঝায় যা মুমিন ব্যাক্তিকে সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত রাখে। সে সদা সর্বদা এই ভয়ে ভীত থাকে যে জীবনের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কোনো কাজেও যদি আল্লাহর হুকুম অমান্য করা হয়, তা হলেও কিয়ামতের দিন সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই মুমিন ব্যাক্তি সবসময় নিজের আত্মার বাধ্যবাধকতায় নিজ জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ড খোদায়ি বিধাণের আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতএব বলা যায়, তাকওয়ার অর্থ হলো জীবনকে আত্মনিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। অন্যভাবে বললে, মুমিনের আচরণ নিয়ন্ত্রণে আইন, প্রশাসন বা সামাজিক দন্ডের কোনো প্রয়োজন হয় না। তার আত্মার শক্তি অর্থাৎ তাকওয়াই তার সমুদয় আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই তাকওয়াই হলো রোজার প্রধান শিক্ষা। একজন রোজাদার যদি লোক চক্ষুর আড়ালে খায় বা পান করে অথবা যৌনাচারে লিপ্ত হয় তা হলে তাকে কেউই বাঁধা দিতে পারে না। কিন্তু সে শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে এসব তা করা থেকে বিরত থাকে। এভাবে দীর্ঘ একমাস মহান আল্লাহর আদেশে দিনের বেলায় হালাল খাদ্য, পানীয় ও বৈধ বিবাহিত স্ত্রীর একান্ত সান্নিধ্য বর্জন করার মাধ্যমে প্রত্যেক মুমিন তার জীবনে সমস্ত নিষিদ্ধ বিষয় থেকে আত্মরক্ষার স্থায়ী অভ্যাস গড়ে তুলবে অর্থাৎ তাকওয়া অর্জন করবে এটাই রোজার প্রধান শিক্ষা।
তাকওয়া সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা সকল মুমিন-মুসলমানের স্মরণ রাখা দরকার। তাকওয়া না থাকলে ঈমান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মানুষের পক্ষে যে কোনো পাপ কাজ করা স্বাভাবিক হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না; যতক্ষণ না সে গুনাহে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কায় ওই সমস্ত কাজও বর্জন না করে যে সব কাজ সন্দেহপূর্ণ। যাতে কোনো গুনাহ নাই। (তিরমিজি
তাকওয়া ঈমানকে পরিপূর্ণ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করে এবং তার শাস্তি থেকে আত্মরক্ষা করে তারাই হলো সফলকাম।’ [সূরা নূর : ২৪
তাকওয়া মুমিনের সম্মান বৃদ্ধি করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানব সকল! আমি তোমাদেরকে একজন মাত্র নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিতি অর্জন করতে পার। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সব থেকে বেশি সম্মানিত ওই ব্যক্তি যে বেশি মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত। সূরা হুজরাত : ১৩
তাকওয়ার স্থান অন্তরে। হজরত আবু হুরায়রা রা. একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না, তাকে অসহায় অবস্থায় পরিত্যাগ করবে না এবং তাকে তুচ্ছজ্ঞান করবে না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. নিজের বুকের দিকে ইশারা করে বলেন, তাকওয়া এখানে।’ মুসলিম
তাকওয়া অর্জন করা মহান আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া প্রসঙ্গে বলতেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হেদায়েত, তাকওয়া, পবিত্রতা ও অমুখাপেক্ষিতা প্রার্থনা করছি। সহিহ মুসলিম
রমজান মাস তাকওয়ার অনুশীলনের মাস। তাই বাহ্যিক অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে মহান আল্লাহর দরবারে তাকওয়ার জন্য দোয়া করাও আবশ্যক।