‘ইমাম’ শব্দটি আরবি, তার বাংলা অর্থ হচ্ছেÑ নেতা, প্রধান, নামাজের ইমাম, অগ্রণী, দিকনির্দেশক, আদর্শ নমুনা ইত্যাদি। সাধারণত ইমাম বলা হয় যাকে অনুসরণ করা হয়। কর্মের মাঝে যিনি সবার আগে থাকেন। যেমন নবী করিম সা: হলেন নবীদের ইমাম, খলিফা মুসলমানদের ইমাম, সেনাপতি সৈন্যদের ইমাম। নামাজের ইমাম বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যিনি মুসল্লিদের মাঝে সবার আগে থাকেন, নামাজের ক্রিয়াগুলোতে যাকে পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়। (লিসানুল আরব, আল-মুজামুল ওয়াফি)। নামাজের ইমামতি হচ্ছে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ শরয়ি দায়িত্ব। যেমন মহানবী সা: বলেছেন, ‘জাতির ইমাম হবে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর কিতাব অধিক ভালো পড়তে পারেন।’ এতে প্রতীয়মান হয় ইমামতের মর্যাদা সবার ওপরে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা ফুরকানে মুমিনের ১৩টি গুণের বর্ণনা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি গুণ হলো মুমিনেরা আল্লাহর দরবারে এই বলে প্রার্থনা করবেন যে, ‘হে প্রভু, আমাদেরকে মুত্তাকিনদের ইমাম বানিয়ে দিন।’ সুতরাং একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্যই হলো ইমামতের আকাক্সা পোষণ করা। ইমামত হচ্ছে আল্লাহর দেয়া এক বিশেষ পুরস্কার বা নেয়ামত। যেমন আল্লাহ তায়ালা সূরা সিজদার ২৪ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘আমি তাদেরকেই ইমামত দান করেছি, যারা আমার আদেশের ওপর ধৈর্য ধারণ করেছে এবং আমার নিদর্শনাবলির ওপর দৃঢ়বিশ্বাস রাখে।’ নবী করিম সা: স্বয়ং ইমাম ও মুয়াজ্জিনের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘ইমাম হলো জিম্মাদার আর মুয়াজ্জিন হলো আমানতদার। হে আল্লাহ, আপনি ইমামদের সুপথে পরিচালিত করুন এবং মুয়াজ্জিনদের মা করে দিন’ (আবু দাউদ-৫১৭, তিরমিজি-২০৭)। ইমামত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব, যা পালন করেছেন হজরত মুহাম্মদ সা: নিজেই। তাঁর পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদিন। তাদের পরবর্তী মুসলমানদের সর্বোত্তম পর্যায়ের ব্যক্তিরা নামাজের ইমামতি করেছেন। নবী করিম সা: ইমামদের মর্যাদাকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সাথে সাথে এই মহান দায়িত্ব পালনে ইমামদের সতর্কও করেছেন। হজরত উকবাহ বিন আমের রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:কে বলতে শুনেছি, ‘যদি কোনো ইমাম সময়মতো নামাজের ইমামতি করেন, তবে তার সাওয়াব ইমাম ও মোক্তাদি উভয়ের ওপর বর্তাবে। আর যদি এতে কোনো ত্র“টি হয়, সেটির দায়ভার হবে ইমামের ওপর, মোক্তাদির ওপর বর্তাবে না।’ (আবু দাউদ, কিতাবুস সালাত, বাবু জামায়িল ইমামতি৫৮০)
হজরত সাহাল বিন সাদ রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা: কে বলতে শুনেছি, ‘ইমাম হলো জিম্মাদার, সে যদি উত্তমভাবে কাজ করে তবে তার পুণ্য ইমাম ও মোক্তাদি উভয়ে পাবে। আর যদি এতে কোনো ত্র“টি হয় তবে তা হবে ইমামের ওপর, মোক্তাদির ওপর বর্তাবে না’ (ইবনে মাজাহ, কিতাবুস সালাত- ৯৮১)। এই ইমামতির ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। মানবসৃষ্টির সূচনা থেকে আল্লাহ পাক মানবজাতিকে সুপথে পরিচালনা ও মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুগে যুগে তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে নবী মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত সব নবী-রাসূলগণই জনসাধারণকে হেদায়াতের বাণী শুনিয়েছেন এবং ইমামতি করেছেন। নবী সা: এই গুরুদায়িত্ব পালনে পুরো জীবন উৎসর্গ করেছেন। নবী সা:-এর ইন্তেকাল-পরবর্তী তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি সাহাবায়ে কেরাম রা: এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। মহানবী সা:-এর রেখে যাওয়া এই গুরুদায়িত্ব বর্তমানে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন আজকের ইমাম সমাজ। তারা হলেন, রাসূল সা:-এর যোগ্য উত্তরসূরি। কারণ, রাসূল সা: বলেছেন, ‘আলেমগণই হলেন নবীদের ওয়ারিশ’ আর আলেম ছাড়া কোনো ইমামের কল্পনা করা যায় না। ইমামগণ নামাজের ইমামতি ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রকে অনেক নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান করছেন, যা রাষ্ট্র অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে পাচ্ছে না। সরেজমিনে পর্যবেণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মসজিদের ইমামই মসজিদ কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইমামগণ অনেক েেত্র ব্যক্তি স্বাধীনতা কিংবা সত্য বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত। মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি কিংবা অন্য কোনো সদস্যের সাথে ইমামের মনোমালিন্য হলেই ইমামকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কারণে-অকারণে ইমামদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর জন্য কমিটি কোনো নীতিমালার অনুসরণ করে না এবং মসজিদ কমিটিকে কারো কাছে জবাবদিহিও করতে হয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচ লাখের ওপরে মসজিদ রয়েছে (সরকারি জরিপ মতে) আর প্রতি মসজিদে একজন ইমাম ও একজন মোয়াজ্জিন মিলে পুরো দেশে ১০ লাখের মতো বিশাল এক জনগোষ্ঠী ওই পেশায় নিয়োজিত থেকে দেশের মুসলিম জনসাধারণকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিশাল এই ইমাম সমাজের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও নিরাপত্তায় সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো কার্যকর পদপে ল করা যাচ্ছে না। গুটিকয়েক মসজিদ ছাড়া প্রায় সব মসজিদে ইমাম ও মোয়াজ্জিনের বেতনভাতা নির্ধারণ করা হয় তিন হাজার থেকে সাত হাজার টাকা, যা উল্লেখ করতেও লজ্জা হয়। অথচ বর্তমানে একজন সাধারণ শ্রমিকও মাসে ১০ হাজার টাকা মজুরি পান। এটি বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত লজ্জা ও পরিতাপের বিষয়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতির এই যুগে এত অল্প পারিশ্রমিক নিয়ে ইমামগণ কিভাবে তাদের পরিবারের ব্যয়ভার বহন করবেন। বিবেকবান প্রত্যেক মুসলিম নাগরিকের ভাবা উচিত। ইমামদের বেতনভাতাসহ সংশ্লিষ্ট সব সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইমাম পরিষদ ও ইমাম সমিতিসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরো বেশি তৎপর ও আন্তরিক হতে হবে। কোনো ইমামকে নিয়োগ দেয়া ও চাকরি থেকে বরখাস্তের বিষয়ে মসজিদ পরিচালনা কমিটির জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করার ল্েয সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তথাপি ইমাম নিয়োগ ও বাতিলের জন্য শরিয়াহ সম্মত নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি। বর্তমানে এ মহৎ পেশাটিকে অবহেলার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো ইমামদের মাঝে ঐক্যের ঘাটতি। চাকরির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়া। ইমামকে আল্লাহ পাক যে মর্যাদা দান করেছেন সে সম্পর্কে সচেতন না হওয়া। সবচেয়ে বেশি দুর্ভাগ্যজনক হলো ইমামদের মাঝে অনেকে পবিত্র কুরআন শরিফকে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে ফেলেন, যা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী। ইমামতি ধর্মের অত্যন্ত