ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে সর্বাবস্থায় উৎসাহিত করা হয়েছে। জ্ঞান অর্জনকে ইবাদত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে ইসলামী বিধানে। আমরা মুসলমান, ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ, ইসলামী শিক্ষাই বর্বর মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করতে পারে। মূলতঃ যে জ্ঞানের সাহায্যে সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত কুরআনের বিশেষ জ্ঞান সম্পর্কে জানা যায় এবং যে শিক্ষালব্ধ জ্ঞানের দ্বারা মানুষ স্বীয় আত্মাকে ও মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলাকে জানতে, বুঝতে ও চিনতে পারে তাই হলো ইসলামী শিক্ষা। মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ সাধনপূর্বক আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করার জন্য ইসলামী শিক্ষা অত্যন্ত আবশ্যক। ইসলামী শিক্ষা তথা শিক্ষার সর্বাত্মক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কারণেই আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্ট প্রথম মানবকে সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেছেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : এবং তিনি আদমকে যাবতীয় বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন…। (সূরা বাকারাহ-৩১) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে হেরা গুহায় প্রথম যে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন তাও ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়ো, দিয়ে আরম্ভ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ যার দ্বারা কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দ্বীনের জ্ঞানদান করেন। (বুখারী ও মুসলিম) আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে, এবং যাদের (অতিন্দ্রীয়) জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ্ তাদের (উপযুক্ত) মর্যদায় উন্নীত করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ্ সে সম্বন্ধে সম্যক অবগত। (সূরা মুজাদালা-১১)
জ্ঞান মানবীয় কল্যাণের যাদুকাঠি। জ্ঞানের সংস্পর্শে এসে মানুষ সার্বিক কল্যাণের অধিকারী হতে পারে। জ্ঞান মানুষকে প্রকৃত চিন্তাশীল ও সার্বিক নির্ধারক হিসেবে তৈরি করে। জ্ঞান অম্বেষণের ফলে মানুষের বিশ্বাসের ভিত মজবুত হয়। জ্ঞানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ আর নেই। এই জ্ঞান প্রজ্ঞার জোরেই মানুষ পশুত্বের স্তর থেকে মনুষ্যত্বের স্তরে উঠে এসেছে। জ্ঞান অর্জিত হয় শিক্ষার মাধ্যমে। ইসলাম এজন্যই জ্ঞান অর্জনকে ফরয ঘোষণা করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য। (ইবনে মাজাহ) ইসলাম শিক্ষার প্রতি এতই গুরুত্ব দিয়েছে যে, সে তার ওহীর প্রথম বাক্যে বলেছে ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়ো। এখানেই শিক্ষার মাহাত্ম্য লুকায়িত। স্রষ্টা এবং সৃষ্টিকে বোঝার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। একজন জ্ঞানী ব্যক্তিই আল্লাহর মহত্ত্ব বুঝতে সক্ষম। আর সে কারণেই তিনি প্রকৃত ঈমানদার হতে পারেন। কেননা প্রকৃত ঈমানের জন্য দরকার সুদৃঢ় বিশ্বাসের। তাই ঈমানদার হওয়ার জন্য জ্ঞান আবশ্যক। এই বিশ্বচরাচরে আল্লাহর যে সৃষ্টির বিস্ময় বিরাজ করছে তা অনুধাবনের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজন। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে সুপথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। জিবরীল (আঃ)-এর মাধ্যমে নবী-রাসূলদের কাছে আল্লাহর বাণী তথা কিতাব এসেছে। এই কিতাবের সাহায্যে মানুষকে শিক্ষাদানের কাজটা ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব হলো আল-কুরআন। এই কুরআনের প্রথম অবতীর্ণ বাণী হলো :- পড়ো! তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন; সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ো! এবং তোমার প্রভু সুন্দরতম,-যিনি কলমের (ব্যবহার) শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না। (সূরা আলাক-১/২) এখানে শিক্ষার আহবান যেমন জানানো হয়েছে তেমনি আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল নিয়েও ভাবতে বলা হয়েছে। ইসলামের প্রথম বাণী অবতীর্ণ হওয়ার পর অশিক্ষিত-কুসংস্কারচ্ছন্ন আরব জাতির মাঝে এক অসাধারণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। তারা একবার জানার চেষ্টা করল-এই আহবান তো তারা এর আগে আর কখনো শোনেনি। অসংখ্য অন্ধ বিশ্বাসী আরব পৌত্তলিকেরা ইসলামের এ আহবান শুনে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল এবং ভাবতে লাগল যে, সত্যই তো আল্লাহ একবিন্দু রক্ত থেকে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তাদের এই ভাবনা থেকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হলো। আর আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল এবং ওহীর শিক্ষা নিয়ে অতি অল্প দিনে পৃথিবীর সেরা জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল। পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। আর সেই জ্ঞান দ্বারা সে ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারে। তাই জ্ঞান অর্জনের তাগিদ নিয়ে আল-কুরআনে অসংখ্য বাণী অবতীর্ণ হয়েছে। জ্ঞানী ব্যক্তিদের সর্বত্র উচ্চ মর্যাদার কথা উল্লেখ করে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে যারা জ্ঞানবান। (সূরা যুমার-৯)
জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সত্যকে জানা, উপলব্ধি করা ও উদঘাটন করা যায়। মানুষের জন্যে আল্লাহর অবদানের শ্রেষ্ঠ দান হলো জ্ঞান। কিন্তু এই জ্ঞানকে কাজে না লাগালে তার কোনো মূল্যই থাকে না। আল-কুরআনের সূরা ফাতিরের ২৮নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে : আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শুধু জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। এই আয়াতের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে জ্ঞানী সে যেহেতু আল্লাহর কুদরত সম্পর্কে অভিহিত সেহেতু সে আল্লাহকে ভয় করা বা তার প্রতি অনুগত থাকাকে করণীয় কর্তব্য বলে ভাবে। ইসলামে যে জ্ঞান অর্জনের তাগিদ দেয়া হয়েছে তার লক্ষ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনে পথ চলে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথে নিয়ে যান; ফেরেস্তাগণ আনন্দে তার জন্য পাখা বিছিয়ে দেন। আকাশ ও পৃথিবীবাসীগণ, এমনকি পানির মৎস্যসমূহও তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। নক্ষত্ররাজির মধ্যে পূর্ণচন্দ্র যেমন শ্রেষ্ঠ, আবেদদের মাঝেও আলেমগণ তেমনই শ্রেষ্ঠ। বিদ্বানগণ নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীগণ ধন-দৌলতের অধিকারী ছিলেন না, তারা বিদ্যার অধিকারী ছিলেন। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে বড় অংশ নিয়েছে। (আবু দাউদ,তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
মানুষ যতই শিক্ষা অর্জন করে তার আকাঙ্খা যেন আরো বেড়ে যায়। এজন্য আল্লাহ তা’আলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ঈমানদারদের জ্ঞান প্রার্থনার কথা বলেছেন : হে প্রভু আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও। (সূরা তোহা-১১৪) এই প্রার্থনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, জ্ঞান অর্জনের মন-মানসিকতাকে জাগ্রত করা এবং জ্ঞানের ক্রম-প্রসার বৃদ্ধি করা। তবে আমাদের শিক্ষা হতে হবে সর্বদিক দিয়ে মানব-কল্যাণমুখী ও সত্যাশ্রয়ী। যদি তা না হয় তাহলে মানুষ কুশিক্ষা ও কুসংস্কারকে গ্রহণ করে নীতি ও জ্ঞানশূন্য এবং বিবেকবর্জিত ব্যক্তিতে পরিণত হবে। এর ফলে দিন দিন ভালো কাজের সংখ্যা কমে যাবে এবং খারাপ কাজ বৃদ্ধি পাবে। আর তখনই মানুষের পদস্খলন ঘটবে। সুতরাং সৎশিক্ষা ও সঠিক জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। ইসলাম অবশ্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষায় বিরোধী নয়। বরং ইসলামী জ্ঞান তথা কুরআন হাদীস যেমন শিক্ষণীয়, তদ্রুপ আধুনিক জ্ঞান অর্জন করাও দরকার। এই দুটির কোনো একটিকে বাদ দিলে চলবে না। ইসলামের স্বর্ণযুগে মসজিদে কুরআন, হাদীস ও ফেকাহর ওপর আলোচনার পাশাপাশি রসায়ণ, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভেষজ বিজ্ঞান এবং জ্যোতি বিজ্ঞানের উপরও আলোচনা হতো। কেননা ইসলামের স্বর্ণযুগে মসজিদই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। ইসলাম আধুনিক শিক্ষা বিস্তারেও এক কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছে ইতিহাস যার আজো সাক্ষী। ইসলাম জ্ঞান অর্জন করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তদ্রুপ জ্ঞান বিতরণ করতেও কখানো পিছপা হয়নি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাঁর থেকে সাহাবীরা শিক্ষা গ্রহণ করে পৃথিবীর দিকবিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। কুরআন এমন একটি আসমানী মহাগ্রন্থ, যা মানবজাতির জ্ঞানের সকল তৃষ্ণাকে মেটাতে পারে। অতএব, কুরআন থেকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের বহু জটিল সমস্যার সমাধান পেতে পারি, এ ছাড়া একটি উন্নত ও কল্যাণমুখী সমাজ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারি।
ইসলামী বিধান অনুযায়ী আমাদের জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইহলৌকিক কল্যাণের পাশাপাশি পরলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্জিত জ্ঞানকে মানুষসহ আল্লাহর সকল সৃষ্টির কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। সকল প্রকার অকল্যাণ ও অশান্তির কাজে যাতে অর্জিত জ্ঞান ব্যবহৃত না হয়, সে দিকে আমাদের লক্ষ্য একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করে, জ্ঞান মোতাবিক আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন…