প্রতিটি যুগেই যুদ্ধবিগ্রহ কোন না কোন আকারে দুনিয়ার বুকে বিরাজমান ছিল, এখনও আছে এবং আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে। আধুনিক বিশ্বে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা একটি জটিল ও ব্যাপক বিষয়। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে ক্ষীণ, শুধু ধারণা দেয়ার চেষ্টা মাত্র। প্রতিরক্ষার আওতায় রয়েছে সামরিকবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্তনীতি, আন্তর্জাতিক ও ভৌগলিকসহ প্রভৃতি বিষয়। একবিংশ শতাব্দীর বর্তমানকালে তথ্য প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে একটি বিশ্ববন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বায়ন নামের এই বন্ধনও বিশ্বকে যুদ্ধমুক্ত করতে পারেনি। উল্টো যুদ্ধংদেহি পরাশক্তি জোটের আগ্রাসীনীতির কারণে বিপদের সম্মুখীন করেছে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ও নিরীহ রাষ্ট্রসমূহকে। পুঁজিবাদ, সাম্ররাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের শোষণমূলক মনোভাবের মাধ্যমে কতিপয় মোড়ল রাষ্ট্র তাদের হীনস্বার্থ হাসিলে গোটা মানবজাতিকে মহাবিপদের মধ্যে ফেলেছে। বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে এই পৃথিবীর অস্তিত্বকে। জলবায়ূর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেক দেশের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য যাবতীয় ধ্বংসলীলা অবসানের ব্যানারে মানবতার কল্যাণে গঠিত হলো আজকের জাতি সংঘ। শান্তির অন্বেষায় মুসলিমরাও হুমড়ি খেয়ে পড়লো জাতি সংঘের অধিনে। কিন্তু তথাকথিত জাতি সংঘ কি রক্তপাত বন্ধ করতে পেরেছে? সাম্প্রতি বিশ্বের রক্তাক্ত ইতিহাসতো সে কথা বলে না? বলদর্পি আমেরিকাকে কেউ আক্রমণ করেনি, বরং বিগত দিনে আমেরিকা বিশ্বের কমপক্ষে পঞ্চাশটি দেশে আক্রমণ চালিয়েছে এবং এখনও একাধিক দেশে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মূলে রয়েছে অস্ত্রের ব্যবসা, সম্পদ দখল, খনিজসম্পদ লুন্ঠন, প্রতিপক্ষীয় দর্শন ও আদর্শকে হত্যার মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা। যার প্রধানতম শিকার আজকের মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ও দেশসমূহ। এক্ষেত্রে জাতি সংঘের ভূমিকা খুবই গৌণ, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কিত। যার ফলে জাতি সংঘের অধিনে বিশ্ব আজ হুমকীর সম্মুখীন। অথচ যুদ্ধের পিছনে খরচ হচ্ছে অপরিসীম অর্থ, যা মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানো হলে বিশ্ব ও মানুষ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতো। আসলে জাতি সংঘ ঘঠনেও রয়েছে পুঁজিবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী মতলব যা কোন দিনও মানবতার কল্যাণে কাজ করবেনা। এক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
মানবতার ইতিহাসে মুসলিমগণই প্রথম স্পষ্ট করে যে, মাজলুমের পক্ষে কিভাবে শক্তি প্রদর্শন করতে হয়। নিছক আত্মরক্ষার জন্য নয়, বিশ্বমানবতার ন্যায্য অধিকার রক্ষায় আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। প্রথাগত অর্থে মুসলমানরা যুদ্ধ করেনা, তারা জিহাদ করে। প্রচলিত যুদ্ধ বলতে যা বোঝায়, জিহাদের সঙ্গে তার রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। যুদ্ধের মূলে রয়েছে পররাজ্য গ্রাসের লিপ্সা ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার তীব্র আকাঙ্খা। অন্য দিকে, জিহাদের উদ্দেশ্য হলো দ্বীন প্রতিষ্ঠায় আত্মরক্ষার তাগিদে অন্যায়ের মূলৎপাটনে ন্যায়, নিরাপত্তা, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণেই প্রচলিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও ইসলামের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য। পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম জীবনের সকল বিষয়ের মতো প্রতিরক্ষা বিষয়েও সুস্পষ্ট বিধানাবলী এবং ধারণা দিয়েছে।
ইসলামে সমরনীতির অন্যতম দিক হলো:
ক. ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দুনিয়ার সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভের সাথে পারলৌকিক সাফল্য নিশ্চিত করে।
খ. সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব অক্ষুন্ন রাখে।
গ. জুলুম-নিপীড়ন বন্ধে দুর্বল ও মাজলুমদের সাহাযার্থে ইসলাম যুদ্ধের অনুমতি দেয়।
ঘ. ইসলামে সশস্ত্র যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ নয়, সে অন্তরের, মুখের এবং অস্ত্রের ধারাবাহিক ও সময়োপযোগী ব্যবহার প্রাধান্য দেয়। ইসলামের লড়াই যেমন চলবে চিন্তার ময়দানে, তেমনি চলবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ময়দানে এবং সর্বশেষ রণাঙ্গনেও। যাতে অন্য কোন জাতিকে জুলুমের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দিতে না পারে।
ইসলামে যুদ্ধ যেহেতু মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সেহেতু যুদ্ধ ক্ষেত্রে কিছু নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। যেমন, অপরাপর কোন ধর্মের উপাসনালয় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এমনিভাবে অন্য ধর্মের পীর-পুরোহীত, বুজর্গ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে, যাতে মুজাহিদ বাহিনী জুলুম অবসানের জোশে সীমা অতিক্রম না করে। যুদ্ধে মনোবল অটুট রাখার তাকিদ দেয়া হয়েছে। “যখন তোমরা যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের মোকাবেলা করবে তখন পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না। যে কেউ লড়াইয়ের ময়দানে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে তার ওপর আল্লাহর গজব পতিত হবে সেই সাথে তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।”
জুলুম প্রতিরোধে জিহাদকে জীবন বলা হয়েছে: “হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম মেনে চলো, যে সময় তোমাদেরকে সেই কর্মের দিকে আহ্বান করা হয় যার ভিতর রয়েছে তোমাদের জীবন।” বিজয় ও সাফল্যের জন্য আল্লাহর ইচ্ছাকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে: “যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করতে থাক তবে আল্লাহ পাক তোমাদের ফয়সালার বস্তু প্রদান করবেন এবং তোমাদের পাপরাশি দূরীভত করবেন, তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।”
জিহাদ কতদিন চলবে তাও বলে দেয়া হয়েছে: “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত লড়াই করতে থাকো, যতদিন বাতেলের প্রাধান্য বিলুপ্ত না হয়, শিরক ও ফেতনা ফাসাদ নির্মূলের মাধ্যমে সমস্ত দিন আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।” নিজেদের মধ্যে ঐক্য অটুট রাখার নির্দেশনা স্বরূপ সূরা আনফালে পরিষ্কার আহকাম নাযিল হয়েছে: বলা হয়েছে, “আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মান্য করো, পরস্পর ঝগড়া বিবাদ করো না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে আর তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট হয়ে যাবে।” আরো বলা হয়েছে: “শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য যথাসাধ্য সমরাস্ত্র ও সিপাহিসুলভ শক্তি সদাসর্বদা প্রস্তুত রেখো, যেন দুশমনের ওপর তোমাদের ভীতিকর প্রভাব কায়েম থাকে।” ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার পয়গামবাহী এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ। কাজেই কুরআনের নির্দেশ রয়েছে: “দুশমন যদি সন্ধির প্রস্তাব করে তবে তোমরা তাতে সাড়া দেবে এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে। এমনটি যেন না হয় যে, তোমরা শক্তির মোহে সীমা অতিক্রম করো এবং দুশমনের আগ্রহ সত্ত্বেও তোমরা সন্ধি স্থাপনে বিরত থাকো।” এরই আওতায় জায়েয-নাজায়েয সীমারেখা পরিষ্কাররূপে নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা ও অনিচ্ছা চর্চার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। খুলে দিয়েছে সকলের জন্য কল্যাণের পথ। এগুলো কুরআনুল কারীমের প্রকাশ্য হুকুম-আহকাম। যার ওপর ভিত্তি করে ইসলাম প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইসলামের এই উন্নত নীতিমালার কারণে তৎকালীন আরবরা পশুত্ব থেকে মনুষ্যত্বে এবং নৈতিক চরিত্রবান মানুষ থেকে আরও উন্নততর আল্লাহওয়ালা মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) আল্লাহর দেয়া প্রতিরক্ষা নীতি ও বিধানের সঙ্গে মুজাহিদ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশ্বজয়ী অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। এই নীতিমালা অনুসৃত প্রশিক্ষণই মুষ্টিমেয় মরুবাসী মুসলিমকে এমনই শক্তি, একতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেন যে, সমকালীন অপরাপর শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহর জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন মুজাহিদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর অগণিত দুশমনের বিরুদ্ধে অধিকতর কঠিন ও বিজয়ী হয়ে দাঁড়ান। যুদ্ধরত বাহিনীর জন্য সমরোপকরণ ও মারণাস্ত্র নি:সন্দেহে অত্যন্ত আবশ্যকীয়। এসব ছাড়া যুদ্ধের কল্পনা করা যায় না। কিন্তু উত্তম কর্ম ও চারিত্রিক সৌন্দর্য ব্যতীত বিপুল সমরাস্ত্রও কাজে আসে না। রাসূল (সা.)-এর পাশে যারা সমবেত হয়েছিলেন, তাদেরকে তিনি সূফী ও দরবেশ বানিয়ে দেননি। যোগী-সন্নাসী রূপে গড়ে তোলেননি। তাদের মধ্যে দুষ্কৃতি থেকে কেবল নিজেকে রক্ষা করা, বাতিল শক্তির ভয়ে ভীত থাকা এবং ক্ষমতাধর ও বিত্তশালীদের দেখে ভড়কে যাওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করেননি। তারা ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী, সচেতন ও প্রাজ্ঞ, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন, সুচতুর ও কর্মঠসহ সব ধরনের সদগুণাবলী ও যোগ্যতার অধিকারী। এই স্বভাবের মানুষগুলো উৎকৃষ্টতম প্রশিক্ষণ পেয়ে, সর্বোত্তম নেতৃত্বের অধীনে সমবেত হয়ে এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিণত হন। ইসলামের এই গৌরবময় সমরনীতির মাধ্যমে মুসলিম সৈনিকেরা বিশ্বেবাসীকে যে শান্তির পথ দেখায়েছেন , মুসলিমগণ তা বিশ্বের দরবারে গৌরবের সাথে তুলে ধরতে পারেন।
নৈতিক শক্তির মাধ্যমে মুসলিমরা প্রমাণ করেছে যে, ইসলামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এতই উন্নতমানের ও অগ্রসর যে তৎকালীন পৃথিবীর প্রায় সকল পরাশক্তি ইসলামের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিলো এবং এরই ভিত্তিতে ইসলাম তার আদর্শ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধমে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নিরাপত্তা দিতে সমর্থ হয়েছিলো।
রাসূল (সা.)এর যুদ্ধনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ন্যূনতম ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে মানবসমাজকে নিরাপদ করা। কোনরূপ ধ্বংস বা অশান্তি সৃষ্টি করা কখনই তাঁর ইচ্ছা ছিলনা। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম যুদ্ধকে কখনো উৎসাহিত করে না। যুদ্ধ অপরিহার্য হলে কেবল তখনই রাসূল (সা.) যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। তবে সে ক্ষেত্রেও আল্লাহর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা অনুসরণ করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রদর্শিত যুদ্ধনীতি অনুসরণ করার মধ্যেই মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।
রাসূল (সা.)-এর যুদ্ধনীতির মধ্যে অন্যতম মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক হচ্ছে: প্রথমত; আক্রান্ত হওয়ার পর আক্রমণ করা। দ্বিতীয়ত; আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজের যাবতীয় ফেৎনা-ফাসাদ দূর করা। তৃতীয়ত; শত্রু পক্ষের নারী,শিশু,রুগ্ন ও নিরহী সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কোনরূপ ক্ষতিসাধন না করা। চতুর্থত; যুদ্ধাহত ও যুদ্ধবন্দীদের সাথে কোনরূপ অমানবিক আচরণ না করা । প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম কখনও কারো নৈতিক বিশ্বাস ও অধিকারের ওপর আগাম হস্তক্ষেপ করেনি। মানুষের বিবেককে গলাটিপে হত্যার জন্য কিংবা বিরোধী ধর্মমত নিপাতের জন্য ইসলাম কোন মারণাস্ত্র আবিস্কার ও ব্যবহার করেনি। কখনও ধর্মীয় নির্যাতন করেনি, যেমনটি করেছে ইহুদী ও খ্রিস্টানরা। খ্রিস্টানরা যখন জেরুজালেম দখল করেছিলো তখন মুসলিম শিশুদের মাথা দেয়ালে আছড়ে ঘিলু বের করে দিত। কচি শিশুদের নগরীর উঁচু দেয়াল থেকে নিচে নিক্ষেপ করে হত্যা করতো। পরাজিত লোকদের ধরে জীবন্ত আগুনে ফেলে হত্যা করতো। সোনা গিলে পেটে রেখেছে কি না, সেটা দেখার জন্য জীবিত মহিলাদের পেট চিরে হত্যা করতো। প্রায় সত্তর হাজার মানুষকে তারা নির্বিচারে হত্যা করেছিলো। এমনকি এসব কাজে মান্যবর গীর্জার পাদ্রীরাও অংশগ্রহণ করেছিলো। অথচ গাজী সালাহউদ্দিন আয়ূবী যখন জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন তখন ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে উল্লেখিত অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেন। তাদেরকে অর্থ ও খাদ্য দান করেন এবং তাদের ইজ্জত সম্মানের সাথে পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করে দেন।
শুরুতেই যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখা যায়, তা হলো ইসলাম আবির্ভাবের পর মুহাম্মাদ (সা.)-এর দাওয়াত ও প্রশিক্ষণের ফলে মুসলিম ও ঈমানদারগণ একদিকে আর কাফের ও সত্যদ্রোহী দল অপর দিকে। মুসলিমদের মধ্যে কোনরূপ ভেদাবেদ ছিলনা। সবাই ভাই ভাই ও সকলেরই লাভ-ক্ষতি, বিপদাপদ একাকার হয়ে যায়। সকলের চিন্তা-চেতনা, কর্ম ও নীতিপদ্ধতি এক ও অভিন্ন। তাদের মধ্যে এই একতা ও শৃঙ্খলা সুসংহত হওয়ার ফলে তাদের ভিতরকার শক্তি মজবুত হয়। এর মাধ্যমে সম্মিলিত মানবগোষ্ঠীর সামনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়। ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সম্পর্ক, চিন্তা ও কর্মের সকল যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে মুসলিম ও কাফের-মুশরিক দু‘টি পৃথক জাতি সত্তায় দাঁড়িয়ে যায়। সত্যের পতাকা সমুন্নত হওয়ার ফলে জালেমদের জুলুমের হাত সঙ্কুচিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই জালেমদের পক্ষে সত্যকে মেনে নেয়া কখনই সম্ভব নয়। ফলে তারা তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য সত্যকে উৎখাতে প্রবল প্রতিরোধে আত্মনিয়োগ করলো। যার ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠলো।
রাসূল (সা.)-এর হিজরতের মাত্র দু‘বছর পর ৬২৪ সালে সংঘটিত ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর থেকে শুরু করে ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয় পর্যন্ত ছোট বড় শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক যুদ্ধ পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাই যে, যুদ্ধের এক পক্ষ ছিল নবাগত মুসলিম শক্তি আর অপর দিকে প্রতিষ্ঠিত সম্মিলিত শক্তি। মুসলিমদের মধ্যে ছিল তাওহীদে বিশ্বাসী নানা গোত্রের লোক যেমন, আরব, বারবার, তুর্কি, ইরানি, হাবশি, কুর্দি, আফগানসহ বহুদেশের মানুষ। মুসলিমগণ প্রমাণ করতে পেরেছে তাদের নৈতিক, আদর্শিক ও আল্লাহ প্রেমের উপযুক্ততা। সকলে সীসাঢালা প্রাচিরের নায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই তারা বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। তখনকার মুসলিমদের মনে প্রতিরক্ষা চেতনা ছিলো খুবই প্রবল ও স্পষ্ট। শাহাদতের তামান্নাই তাদেরকে উন্নতমানের যোদ্ধা ও শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তিতে পরিণত করেছিলো।
কিন্তু কালের বিবর্তনে গোটা পরিস্থিতি আজ ভিন্নরূপ ধারণ করলো। সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় এককালে ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেধ সৃষ্টি করলো। তারা আরাম প্রিয় ও বিলাসীতায় নিমগ্ন হলো। ফলে তারা বিভক্ত হয়ে গেল আরব, অনারব, উত্তর আরব, দক্ষিণ আরব প্রভৃতি দল উপদলে। আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কলহের ফলে স্বীয় মান মর্যাদা, স্বাধীনতা সংরক্ষণে তাদের সুউচ্চ চেতনাগত মনোভাবেরও তিরোধান ঘটলো। ক্রমান্বয় মুসলিম শাসকগণ শাসিতে আর স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পরাধীনে পরিণত হতে লাগলো। সে বিপর্যয়ের ধারা আজও অব্যাহত গতিতে চলছে। আজ বিশ্ব মুসলিমের ওপর যে নির্যাতন-নিপীড়ন ও জুলুমের ষ্টিম রোলার চলছে তার অন্যতম কারণ হলো মুসলিম উম্মাহ ইসলামের সঠিক আদর্শের বিপরীতে অবস্থান করছে। জিহাদের মত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদতকে নিজেরাই জঙ্গিবাদী, মৌলবাদী বলে তা নির্মূলে উঠে-পড়ে লেগেছে। যার ফলে সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি ভূখন্ডের মুসলিম জাতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে এবং সাম্ররাজ্যবাদীদের ভয়ে মুসলমানদের আতঙ্কে দিন কাটছে। এই অবস্থায় মুসলমানদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে বিশ্ব মুসলিমকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে রাসূল (সা.)-এর জীবনীর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতে হবে।