কুরবানির ইতিহাস ও ঈদুল আজহা

 

কুরবানির ইতিহাস ও ঈদুল আজহা

কুরবানির ইতিহাস ও ঈদুল আজহা

কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করেছেন ‘ফাছাল্লি লিরাব্বিকা ওয়ান হার’ অর্থাৎ- (হে রাসূল) আপনার রবের জন্য সালাত আদায় করুন এবং কুরবানি করুন (সূরা কাউসার-২)। উল্লেখিত আয়াতে রাব্বুল আলামীন আল্লাহ শরীয়তে মুহাম্মদীতে কুরবানির বিধান চালু করার আদেশ দেন।

কুরবানির ইতিহাস: কুরআন সুন্নাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হজরত আদম (আ.)-এর সময় থেকেই কুরবানির প্রথা চালু ছিলো। কিন্তু হজরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের অপূর্ব ত্যাগের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যই মূলত কুরবানির প্রথা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর হাবীব হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)’র মাধ্যমে চালু রেখেছেন। যা আজ মুসলিম সমাজে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

হজরত ইব্রাহীম (আ.)’র প্রতি আল্লাহর আদেশ : মহান আল্লাহ হজরত ইব্রাহীম (আ.)কে যে কয়টি বড় পরীক্ষা করেছিলেন এর মধ্যে স্বীয় পুত্র ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর রাহে কুরবানি করার আদেশ ছিল তাঁর জন্য মহাপরীক্ষা। এই দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমে ঘোষণা করেন অর্থাৎ- তিনি (হজরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম) বললেন হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি? ‘‘সে বলল (ইসমাইল) হে আমার আব্বা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সুরা-আস্-সাফফাত আয়াত-১০২)।

হজরত ইব্রাহীম (আ.) স্বীয় পুত্রের এ সাহসিকতাপূর্ণ উত্তর পেয়ে খুবই খুশি হলেন। তাই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তাঁর একমাত্র পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)কে জবেহ করার জন্য মিনার ময়দানে নিয়ে গেলেন। জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে হজরত ইব্রাহীম (আ.) স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কুরবানির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অভিশপ্ত শয়তান পিতা-পুত্রের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল তিনটি স্থানে। তারা উভয়ে শয়তানের বিতৃষ্ণায় শয়তানের প্রতি পাথর নিপে করেছিলেন মিনায়। মহান আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও নিষ্টার প্রতি সম্মান দেখিয়ে আজও হাজীরা উল্লিখিত তিনটি স্থানে পাথর নিপে করেন শয়তানের উদ্দেশ্যে।

প্রিয় পাঠক; হজরত ইব্রাহীম (আ.) স্বীয় পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জবেহ করার উদ্দেশ্যে পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন। মহান আল্লাহ তাঁর এই আত্মত্যাগে খুশি হয়ে গেলেন’ সাথে সাথে মহান আল্লাহ বললেন- অর্থাৎ তখন তাঁকে আহ্বান করে বললাম : হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যিই পালন করলে। “হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কুরবানি করলেন হজরত ইব্রাহীম (আ.), যা বেহেশ্ত থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর হুকুমে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে পশু কুরবানির প্রথা চালু হয়েছে।

হাদীসের আলোকে কুরবানির ফাজায়িল: কুরবানি করার মধ্যে অনেক ফজীলত রয়েছে। প্রিয় নবী রাসূলে (সা.) হাদীসে পাকে ঘোষণা করেছেন : কুরবানির দিন আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে পশু কুরবানি করা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ঘোষণা করেছেন যে, কুরবানির পশুর যত পশম থাকে প্রত্যেক পশম বা লোমের পরিবর্তে এক একটি নেকী বা সওয়াব লেখা হয়। (মুসনাদে আহমদ)

যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ : যে সকল পশু দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ তা হলো, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু। গরু, মহিষ এবং উট এক হতে সাতজন পর্যন্ত কুরবানি দাতা শরীক হয়ে কুরবানি করতে পারবেন।

কুরবানির পশুর বয়স : যে সকল পশুর দ্বারা কুরবানি করা হবে সেগুলোর বয়সের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তে হুকুম হলো ছাগলের বয়স কমপক্ষে এক বছর হতে হবে। গরু ও মহিষ এর বয়স কমপক্ষে দুই বৎসর হতে হবে। উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বৎসর হতে হবে। দুম্বা ও ভেড়া কমপক্ষে এক বছর হতে হবে।

মাসআলা : ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি এরূপ মোটা-তাজা হয় যে, এক বছরের অনেকগুলো দুম্বার মধ্যে ছেড়ে দিলে চেনা না যায়, তবে সেরূপ দুম্বার বাচ্চা দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ কিন্তু ছাগলের বাচ্চা এরূপ মোটা তাজা হলেও এক বছর পূর্ণ না হলে কুরবানি জায়েজ হবে না।

কোন দিন কুরবানি করবেন : জিলহজ্বের ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ পর্যন্ত তিনদিন কুরবানি করা জায়েজ। এ তিন দিনের যেকোনো একদিন কুরবানি করা জায়েজ হবে। তবে উত্তম হলো প্রথম দিন এরপর দ্বিতীয় দিন এরপর তৃতীয় দিন এরপর চতুর্থ দিন।

মাসআলা : কুরবানির পশু ত্রুটিমুক্ত হওয়া আবশ্যক। যদি সামান্য ত্রুটি থাকে, যেমন কান ছিড়া বা কানে ছিদ্র থাকা ঐ পশু দিয়ে কুরবানি করলে তা মাকরূহ হবে। আর বেশি ত্রুটি থাকলে কুরবানি হবে না। (দুররুল মুখতার ৯ম খণ্ড)

মাসআলা: পশুর জন্ম থেকে শিং না থাকলে ঐ পশু দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে। তবে জন্মগতভাবে কান না থাকলে বা এক কান  থাকলে এর দ্বারা কুরবানি করা জায়েজ হবে না। (আলমগীরী)

মাসআলা: গাভী কুরবানির পর যদি পেট থেকে জীবিত বাচ্চা পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবেহ করে দিবে এবং সেটা খাওয়া যাবে। আর মৃত বাচ্চা হলে তা ফেলে দিবে।

মাসআলা: জবেহ করার সময় ৪টি রগ কাটতে হবে বা কমপক্ষে তিনটি রগ কাটতে হবে। এর চেয়ে বেশি কাটবে না।

শরীক হয়ে কুরবানি করা: একাধিক ব্যক্তি মিলে এক সাথে গরু, মহিষ, উট দিয়ে কুরবানি করা জায়েজ হবে। উল্লিখিত পশুতে সর্বোচ্চ সাতজন ব্যক্তি শরীক হতে পারবে। তবে গোস্ত বণ্টনের ক্ষেত্রে অনুমান করে বণ্টন করা যাবেনা। অবশ্যই ওজন করে গোস্ত বণ্টন করতে হবে।

কুরবানির গুরুত্ব: কুরবানির মাধ্যমে ত্যাগ ও উৎসর্গের দ্বারা মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করাই কুরবানি দাতার মূল উদ্দেশ্য হওয়া চাই। কে কত টাকা খরচ করে পশু ক্রয় করেছে, কার পশু কত বড়- মহান আল্লাহ সেটা দেখবেন না। এজন্য আল্লাহ কুরআনে বলেন-‘কখনই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এগুলোর গোস্ত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া’ (সূরা আল-হাজ্ব)। তাই সকল কুরবানিদাতার এই নিয়্যত হওয়া উচিত, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাকওয়ার সাথে কুরবানি করা।

কুরবানির দোআ ও নিয়ম: ইন্নি ওয়াজ জাহতু ওয়াজ হিয়া লিল্লাজি ফাতারাস্ ছামা ওয়াতি ওয়াল আর দ্বা হানিফাও ওমা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না ছলাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ ইয়া ইয়া ওমামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। লা-শারীকা লাহু ওয়া বি জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। উল্লিখিত দুআ পড়ে পশুর গর্দানের নিকটবর্তী হয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে আল্লাহুম্মা লাকা মিনকা বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবেহ করবে।

মাসআলা: কুরবানি যদি নিজের পক্ষ থেকে হয় তাহলে জবেহ করার পর এই দুআ পড়বে ‘আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন খালিলিকা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ওয়া হাবিবিকা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর যদি অন্য কারো পক্ষ থেকে কুরবানির পশু জবেহ করা হয় তাহলে জবেহকারী ‘মিন্নির স্থলে মিন’ বলে যার কুরবানি করছে তার নাম উচ্চারণ করবে।

মাসআলা: নিজের কুরবানির পশু নিজে জবেহ করা উত্তম। নিজে না পারলে জবেহ করার নিয়ম জানেন এমন ব্যক্তি দ্বারা পশু জবেহ করাবেন।

চামড়া: কুরবানির পশুর চামড়া কুরবানি দাতা জায়নামাজ অথবা পানির মশক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। এছাড়া উক্ত চামড়া বিক্রি করে গরিব, মিসকিন, এতিমদের মধ্যে বণ্টন করে দিবেন।

মাসআলা: কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা মসজিদ, মাদরাসা, খানকায় দেয়া যাবে না।

কুরবানির শিক্ষা : কুরবানির মূল শিক্ষা হলো আত্মত্যাগ। পাশাপাশি বনের পশুর সাথে মনের পশুকে কুরবানি করাই হচ্ছে কুরবানির শিক্ষা। আমাদের মনে পশুত্বসুলভ যে স্বভাবগুলো রয়েছে কুরবানির সাথে সাথে যদি সেগুলোকে কুরবানি করতে পারি তা হলেই আমাদের কুরবানি সার্থক হবে।

Related Post