কুরবানীর আহকাম ও তাৎপর্য

কুরবানীর আহকাম ও তাৎপর্য

কুরবানীর আহকাম ও তাৎপর্য

কুরবানী বলা হয় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন ও তার এবাদতের জন্য পশু জবেহ করা। তাই কুরবানী বলা হয় ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করা।

কুরবানীর উদ্দেশ্য: কুরবানী সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন,
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ.
অর্থাৎ-আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের মাংস এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্ম পালনকারীদের।(সুরাঃ আল হাজ্বঃ৩৭)
পশু কুরবানি করা হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ . لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ.
অর্থাৎ- বল আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বজাহানের প্রতিপালক কেবল আল্লাহর জন্য। তার কোন অংশিদার নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর আমিই প্রথম মুসলিম। (সূরা আল আনআম: ১৪২-১৪৩)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন: فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
অর্থাৎ- তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে তুমি সালাত আদায় কর ও কুরবানি কর।(সূরা আল কাউছার:২)
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে কিংবা অন্য কারো নামে পশু কুরবানি করা হারাম। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন:
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ذَلِكُمْ فِسْقٌ (المائدة : ৩)
অর্থাৎ- তোমাদের জন্য মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস ও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে জবেহকৃত পশু। (সূরা আল মায়েদা: ৩)
নবী করিম সা. এরশাদ করেন:
لَعَنَ اللهُ مَنْ لَعَنَ وَالِدَهُ ، وَلَعَنَ اللهُ مَنْ ذَبَحَ لِغَيْرِ اللهِ ، وَلَعَنَ اللهُ مَنْ آوَى مُحْدِثًا ، وَلَعَنَ اللهُ مَنْ غَيَّرَ مَنَارَ الْأَرْضِ
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি তার পিতামাতাকে অভিশাপ দেয়, আল্লাহ তাকে অভিসম্পাদ করেন । যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে কিংবা অন্য কারো উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করে, আল্লাহ তাকে অভিসম্পাদ করেন। আর আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর অভিসম্পাদ করেন যে দ্বীনের মধ্যে নব্য বিষয় আবিস্কার করেন। যে ব্যক্তি জমির সীমানা পরিবর্তন করেন আল্লাহ তাকেও অভিসম্পাদ করেন। (সহীহ মুসলিম. হযরত আলী ইবনে আবু তালেব সূত্রে বর্নিত)
কুরবানীর ফজিলত:
কুরবানির অসংখ্য ফজিলতের কথা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হুজুর (সা:) বলেছেন কুরবানীর পশুর প্রতিটি লোমের পরিবর্তে একটি করে নেকী পাবে। (ইবনে মাজাহ)
হযরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, কুরবানির দিনে কুরবানির চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয় কোন আমল নেই। যেহেতু কুরবানির পশুকে কিয়ামতের দিনে শিং, পশম, খুর ইত্যাদি সহ কিয়ামতের মাঠে হাজির করা হবে এবং নেকীর পাল্লায় ওজন করা হবে। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলার দরবারে কবুল হয়ে যায়। (তিরমিজী)
মহানবী সা. কর্তৃক পশু যবেহকরণ:
রাসূল সা. নিজ হাত মুবারকে দুটি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কুরবানী করেছেন। তখন তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলেছেন। তিনি তার পা মুবারক দ্বারা পশু দুটির কাঁধ চেপে ধরেন। তবে বুখারীর অন্য বর্ণনায় সাদা-কালো রঙ্গের পরিবর্তে শিংওয়ালা পশুর উল্লেখ রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম, হযরত আনাস রা. এর সূত্রে বর্ণিত)
কুরবানীর দিন, সময় ও যবেহ করার পদ্ধতি
কুরবানির সময়কাল হলো যিলহজ্বের ১০ তারিখ হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। এই তিন দিনের যে কোন দিন কুরবানি করা জায়িয। তবে প্রথম দিন কুরবানি করা সর্বাপেক্ষা উত্তম্ তারপর দ্বিতীয় দিন, তারপর তৃতীয় দিন। যিলহজ্বের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পর কুরবানী করা দুরস্ত নয়। (ফাতওয়া -ই- আলমগিরী,) অনুরূপভাবে ঈদুল আযহার সালাতের পূর্বে কুরবানী করা বৈধ নয়।
নিজের কুরবানি নিজ হাতে যবেহ করা মুস্তাহাব। যদি নিজে যবেহ করতে না পারে তবে অন্যের দ্বারা যবেহ করাবে। এমতাবস্থায় নিজে পশুর সামনে দাড়িয়ে থাকা উত্তম। (ফাতওয়া-ই- শামী,)
তবে মুখে দোয়া পড়া উত্তম। কুরবানির পশুকে কিবলামূখী করে শোয়াবে। (ফাতওয়া-ই- শামী,)
যবহে করার সময় রাসূল (সা:) যে দু’আ পড়েছেলিনেঃ
“বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বাল মিন মুহাম্মদ ওয়া আলি মুহাম্মদ ওয়ামিন উম্মাতি মুহাম্মদ ছুম্মা দাহ্হা বিহী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।” অর্থাৎ আল্লাহর নামে; হে আল্লাহ!তুমি এই কুরবানী মুহাম্মদ, মুহাম্মদের পরিবার ও তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল কর।” অত:পর তিনি কুরবানী করলেন। (আবুদাউদ হা:নং-২৭৯২)
কুরবানির জন্তুকে পশ্চিমমুখী করে শুয়ায়ে দেওয়ার পর যে দু‘আ পড়া সুন্নাত: “ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজী ফাতারাসসামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাঁও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না সলাতী ওয়ানুসুকী ওয়া মাহ্য়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহী রাব্বিল আলামীন। লা-শারীকা লাহু ওয়া বিজালিকা উমিরতু ওয়া আনা আওয়ালুল মুসলিমীন।”(মিশকাত)
কুরবানীর বিধান:
কুরবানী মূলত হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর সুন্নাত। প্রত্যেক জ্ঞানবান, পূর্ণ বয়স্ক, মুকীম (মুসাফির নয়) মুসলমানের উপর কুরবানি ওয়াজিব; যে নেছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। (শামী:৫ম খন্ড- । অধিকংশ ইমাম ও ফকীহগণের মতে কুরবানী উয়াজিব।
কুরবানীর মাসায়েল:
১. কুরবানির মাংস নিজে খাবে, পরিবারবর্গকে খাওয়াবে, আত্মীয়স্বজনকে হাদিয়া দিবে এবং গরীব মিসকিনকে সাদকা করবে।
২. মাংস বিতরণের মুস্তাহাব পদ্ধতি হলো: তিনভাগের একভাগ পরিবার পরিজনের জন্য ব্যয় করবে এবং বাকী দু’ভাগের একভাগ বন্ধু-বান্ধবকে আর একভাগ গরীব মিসকিনকে দান করবে। (ফাতওয়া-ই- শামী,)
৩. চুল-নখ না কাটা : উম্মে সালামাহ (রাঃ)হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার এরাদা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হ’তে কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হ’তে বিরত থাকে’। ( মুসলিম, মিশকাত: ১৪৫৯; নাসাঈ: ১৪৭৪)] কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তিগণ কুরবানির নিয়তে তা করলে এটাই আল্লাহর নিকটে পূর্ণাঙ্গ কুরবানির হিসাবে গৃহীত হবে।(আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত : ১৪৭৯)
৪. যেহেতু সব শরিকের পক্ষ থেকে একটি পশু যবেহ করা হচ্ছে তাই সবার নিয়ত ও উপার্জন শুদ্ধ হওয়া জরুরি। ইসলামী ফিকহ বিশারদরা বলেছেন, কোনো শরিকের পুরা বা অধিকাংশ উপার্জন হারাম হলে কিংবা কেউ শুধু গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্যে শরিক হলে কারও কোরবানি সহীহ হবে না। (আলমগিরি ৫/৩৪২; আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫০৩)
৫. কুরবানির মাংস অমুসলিমকে হাদীয়া-উপহার প্রদান করা জায়িয। কিন্তু মজুরী বাবদ দেওয়া বৈধ নয়। অবশ্য মুসলিমকে দেওয়াই উত্তম। (ফাতওয়া -ই- আলমগিরী,)
৬. কসাইকে মাংস বানানোর মজুরীস্বরূপ মাংস, চামড়া, রশি, প্রভৃতি প্রদান করা বৈধ নয়। তার পারিশ্রমিক ভিন্নভাবে আদায় করতে হবে।
৭. কুরবানির মাংস তিন দিনের অধিক সময় জমা করে রাখাও জায়িয আছে। (হিদায়া, খ-:৪ পৃষ্ঠা:৪৫০)
৮. পশুর চামড়া পশু থেকে সম্পূর্ণ পৃথক না করে বিক্রয় করা বৈধ নয়। চামড়া সম্পূর্ণ পৃথক হওয়ার পূর্বে দর কসাকসি কিংবা দরদাম চূড়ান্ত করা কিছুই জায়িয নয়।
৯. শরীকানা কুরবানির ক্ষেত্রে পশুর মাংস পাল্লা দ্বারা যথাযথভাবে পরিমাপ করতে হবে। অনুমানের ভিত্তিকে পরিমাপ করা বৈধ নয়। (ফাতওয়া-ই- শামী,)
১০. মান্নত ও অসিয়্যতের কুরবানির পশুর সমস্ত মাংস এবং চামড়া গরীব, মিসকিনদের সাদকা করে দিতে হবে। এর মাংস নিজে খেতে পারবে না এবং কোন ধনী ব্যক্তিকেও খাওয়াতে পারবে না। (ফাতওয়া-ই শামী),
মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানি:
কুরবানি মূলত জীবিত মানুষের পক্ষ থেকে করতে হয়। যেমন আমরা দেখি রাসূল সা. ও তার সাহাবীগণ নিজেদের পক্ষ থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানি করেছেন। রাসূল সা. তার সাহাবীগণ কিংবা তাবেঈগণের যুগেও জীবিতগণ তাদের মৃত ব্যক্তিদের পক্ষে কুরবানী করেছেন মর্মে তেমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি তারা নবী করিম সা. এর ওফাতের পর স্বয়ং রাসূলের পক্ষে কুরবানী করছেন মর্মেও কোন প্রমাণ নেই। মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানী না করাই উত্তম। তবে কেউ করতে চাইলে মৃত ব্যক্তিদের পক্ষেও কুরবানী করতে পারবে।
কুরবানীর সাথে একই পশুতে আকিকাহ দেওয়ার বিধান:
আকীকা করা সুন্নাহ বা মুস্তাহাব। আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনায়, তাঁর দেওয়া নিয়ামাত সন্তান লাভকরার শুকরিয়া আদায় স্বরুপ এবং বৈধ সন্তান পরিচয় করার মানষিকতায় আকীকা করা সুন্নাহ বা মুস্তাহাব। আকীকা সপ্তম দিনে হওয়া সুন্না্হ ও মুস্তাহাব। সপ্তম দিনে না করতে পারলে চৌদ্দদিনের দিন, তাও না পারলে একুশ দিনের দিন আকীকা করা যেতে পারে। তাও সম্ভব নাহলে জীবনের কোন এক সময় করা যেতে পারে।
পক্ষান্তরে কুরবাণী করা উয়াজিব। এর জন্য সুনির্দিষ্ট দিন ও মাস রয়েছে। উভয়ের হুকুম ভিন্ন হওয়ায় ইসলামী স্কলারগণ কুরবাণীর সাথে একই পশুতে আকিকাহর অংশ মিলানো বৈধ নয় বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হানাফী মাযহাবে কুরবানীর সাথে আকিকাহ এক সাথে দেওয়া বৈধ বলা হয়েছে। (ফতোয়াই আলমগিরী)
ঈদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বিনিময় করা :
জুবাইর বিন নুফাইর (রহ.) বলেছেন, ঈদের দিন রাসূল সা. এর সাহাবীগণ যখন পরস্পর মিলিত হতেন, তখন একজন অপরজনকে বলতেন: ‘আল্লাহ আমার ও তোমার ঈদ কবুল করুন’। (ফিকহুস সুন্নাহ )

Related Post