মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে অসংখ্য-অগণিত নেয়ামত দিয়ে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতগুলোর মধ্যে জিহ্বা বা জবান হচ্ছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি নেয়ামত। জবানের যথাযথ রণাবেণ, সঠিক কাজে জবানের ব্যবহার, অন্যায়, অসত্য ও হারাম থেকে জবানকে বিরত রাখা আল্লাহপ্রাপ্তির সহজ উপায়। এক কথায়, জবানের হেফাজত মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআনের ১৮তম পারায় সূরা মুমিনুনের শুরুতে মহান আল্লাহ তায়ালা খাঁটি মুমিন মুসলমানের সাতটি গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে দ্বিতীয় গুণ হচ্ছে, যারা মুমিন তারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত। আয়াতে ‘লাগউন’ শব্দের অর্থ অনর্থক কথা অথবা কাজ, যাতে ধর্মীয় কোনো ফায়দা নেই। এর অর্থ উচ্চস্তরের গুনাহ যাতে ধর্মীয় ফায়দা তো নেই, বরং তি বিদ্যমান। এ থেকে বিরত থাকা, বেঁচে থাকা ওয়াজিব। একে বর্জন করা ন্যূনপে উত্তম ও প্রশংসনীয়। প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেছেন, মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন তার ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে পারে। এ কারণেই আয়াতে একে কামেল মুমিনের বিশেষ গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। ওই সময়ে সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে’ (সূরা কাফ : ১৭-১৮)। অর্থাৎ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই পরিদর্শক ফেরেশতা রেকর্ড করে নেয়। হজরত হাসান বসরি ও হজরত কাতাদাহ রহ: বলেন, এই ফেরেশতা মানুষের প্রতিটি বাক্য রেকর্ড করে। তাতে কোনো গুনাহ অথবা নেকি থাকুক বা না থাকুক। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, ‘কেবল সেসব বাক্য লিখিত হয়, যেগুলো সাওয়াব বা শাস্তিযোগ্য। অবশ্যই তোমাদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। আমল লেখক সম্মানিত ফেরেশতাগণ’ (সূরা ইনফিতর : ১০-১১)। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, তার উচিত সে যেন প্রতিবেশী ও মেহমানকে সম্মান করে এবং উত্তম কথা বলে, না হয় চুপ থাকে’ (বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)
ভালো কথা বলা, কম কথা বলা ও নীরব থাকাই হচ্ছে আল্লাহ প্রেমিকদের স্বভাব। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘চারটি গুণ মুমিন ছাড়া কারো মাঝে পাওয়া যায় না ১. নীরব থাকা, ২. বিনয়াবনত হওয়া, ৩. আল্লাহর জিকির করা ও ৪. কারো ক্ষতি না করা।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, চতুর্থ খণ্ড)। নিজ জবানকে হেফাজত করতে পারলে মানুষের চিরশক্র শয়তানকে পরাভূত করা সহজ হয়ে যায়। হজরত আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর নিকট এসে আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা: আমাকে কিছু উপদেশ দিন। প্রিয়নবী সা: বললেন, ‘তাকওয়া অবলম্বন করবে। কারণ, তা সব কল্যাণের মূল। জিহাদে যাবে। কারণ, তা মুসলমানদের জন্য বৈরাগ্য। আল্লাহর জিকির করবে এবং কুরআন তেলাওয়াত করবে। কারণ, তা পৃথিবীতে তোমার জন্য আলো আর আকাশে তোমার আলোচনার বিষয়। কল্যাণের বিষয় ছাড়া সর্বেক্ষেত্র তোমার জবানকে হেফাজত করবে। তাহলে তুমি তা দ্বারা শয়তানকে পরাজিত করতে পারবে’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, চতুর্থ খণ্ড)
মহান আল্লাহ তায়ালার একটি গুণবাচক নাম হলো ‘সাত্তার’, অর্থাৎ গোপনকারী। যে ব্যক্তি তার জবানকে হেফাজত করবে এবং মানুষের দোষত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ তায়ালা উভয় জগতে তার দোষ গোপন রাখবেন। হজরত উমর রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে অন্যায়ভাবে তার গোলামকে চড় দিলো, তার কাফফারা হলো গোলামটিকে আজাদ করে দেয়া’ (মুসলিম)। আর যে তার জবানকে হেফাজত করল, আল্লাহ তার লজ্জাকর বিষয়গুলো গোপন করে রাখবেন। আর যে তার ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করবে, আল্লাহ তাকে আজাব থেকে রক্ষা করবেন। আর যে তার প্রভুর নিকট বিনয়ী ও নম্র হয়ে ওজর পেশ করবে, আল্লাহ তার ওজর কবুল করবেন’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, দশম খণ্ড)। হজরত লোকমান হাকিম নিজ পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘হে সন্তান! যে ব্যক্তি খারাপ লোকের সংস্পর্শ গ্রহণ করবে, সে তার খারাবি থেকে মুক্ত থাকতে পারবে না। যে ব্যক্তি খারাপ স্থানে গমন করবে, সে অপবাদের পাত্র হবে। আর যে ব্যক্তি জবানকে সংযত না রাখবে, সে লজ্জিত হবে। জবান হেফাজত করতে না পারলে এর থেকে বহু বিপদ সৃষ্টি হয়। আর নীরবতাই হচ্ছে এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। তাই তো বুজুর্গগণ বলেছেন, যার আহার, নিদ্রা ও বাক্য আবশ্যক অভাব মোচনের জন্যই হয়ে থাকে, তিনি আবদাল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘সাধারণ লোকের বেশির ভাগ গুপ্ত পরামর্শে মঙ্গল নেই। হ্যাঁ, তবে যে ব্যক্তি এরূপ যে দান অথবা কোনো সৎ কাজে বা লোকের মধ্যে পরস্পর সন্ধি করে দেয়ার উৎসাহ প্রদান করে। এতে মঙ্গল আছে’ (সূরা নিসা : ১১৪)। প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যারা নিজ জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পরিবার-পরিজনকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখে ও নিজের অপরাধের জন্য ক্রন্দন করে, তাদের জন্য সুসংবাদ’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, দশম খণ্ড)। মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি চুপ রয়েছে, সে মুক্তি পেয়েছে। হজরত হাসান বসরি রহ: বলেন, যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে, তার বেশি ভুলত্রুটি হয়। যার বেশি সম্পদ হয়, তার গুনাহ বেশি হয়। যার চরিত্র খারাপ হয়, সে কষ্টে বেশি নিপতিত হয়, (তাম্বিহুল গাফেলিন)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মুয়াজ ইবনে জাবাল রা:কে ইয়ামেনে পাঠানোর আগে মুয়াজ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা:! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: জিহ্বার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘জবানের হেফাজত করবে।’ তখন যেন মুয়াজ রাসূলের কথাকে একটু হালকা মনে করলেন। তাই প্রিয়নবী সা: বললেন, ‘তোমার মা সন্তানহারা হোক (অতি আদরের কারণে এ কথা বলা হয়)। মানুষকে তার জিহ্বার ফসলই তো জাহান্নামে উপুড় করে নিপে করে’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)। সর্বত্র জবানের হেফাজত করা মুমিন-মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। বাসায় পরিবার-পরিজনের সাথে, অফিস-আদালতে অধীনস্থদের সাথে, ছাত্র-শিক্ষকের সাথে, রাজনৈতিক ক্ষেত্র নেতাকর্মীদের সাথে জবানের হেফাজত করা একান্ত জরুরি। ইদানীং দেখা যায়, মসজিদে প্রবেশ করে জবানকে হেফাজত করা যাচ্ছে না। আল্লাহর ঘরে প্রবেশ করেই একদল লোক নামাজ না পড়ে, তাসবিহ-তাহলিলে রত না থেকে অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত হচ্ছে। এটা আদৌ উচিত নয়। মসজিদ আল্লাহর ঘর। সবচেয়ে উত্তম স্থান। অতএব, বেহুদা কথা বলে এর পবিত্রতা বিনষ্ট করা কারো উচিত নয়। প্রিয় নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘জবানই মানুষের বেশির ভাগ পাপের উৎস।’ একবার তিনি লোকদেরকে লক্ষ করে বললেন, ‘সহজতম ইবাদত তোমাদের শিক্ষা দিচ্ছি তা হলো নীরব জবান ও সৎ স্বভাব।’ হজরত ঈসা আ: বলেন, ইবাদতের দশটি অংশ। নীরবতার মধ্যে এর ৯টি অংশ এবং বাকি একটি লোক সংসর্গ পরিত্যাগ করে নির্জনবাসে রয়েছে। মহানবী সা: আরো ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বেশি কথা বলে, তার কথায় বেশি অপরাধ ও বেশি ভুল হয়। সে বড় পাপী, দোজখের অগ্নিই তার জন্য প্রকৃষ্ট স্থান।’ এ কারণেই হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: মুখে পাথর দিয়ে থাকতেন, যেন কথা বলতে না পারেন। হজরত ইউনুস ইবনে ওবায়েদ রা: বলেন, আমি যাদেরকে জবান হেফাজত করতে দেখেছি, দেখলাম তাদের সব কাজই সুফল ও সুন্দর হয়ে থাকে। জবান থেকে বহু বিপদ উৎপন্ন হয়। সর্বদা নিরর্থক কথাই বের হয়। বলা খুব সহজ। কিন্তু কোন কথা ভালো, আর কোন কথা মন্দ এটা বোঝা বড় দুষ্কর। এ জন্যই মৌনব্রত পালনে এত উপকার রয়েছে। নির্বাক থেকে ভালো-মন্দ সমস্যা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। মানসিক শান্তি অটুট থাকে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ধ্যানের বেশি সময় ও সুযোগ মেলে। জবানকে হেফাজতকারী ব্যক্তি অতি সহজেই মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য অর্জন করতে পারে। তাই আসুন, কম কথা বলে এবং জবানকে হেফাজতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সর্বদা সচেষ্ট থাকি। সমাপ্ত