জাকাত দিলে সম্পদ কমে না

images[4]

জাকাত ইসলামের অন্যতম মৌলিক একটি ইবাদত। দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে জাকাতএকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা। কিন্তু অনেকেই জাকাতের প্রধাননীতিমালা সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন ।

পবিত্র কুরআনের বহুসংখ্যক আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণকরেছেন। কুরআন শরিফের বহু আয়াতে সালাত বা নামাজের নির্দেশের পাশাপাশি জাকাত আদায়েরকথা বর্ণিত হয়েছে। সূরা বাকারায় বর্ণিত হয়েছে‘মুসলিম নর ও নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়, সালাত কায়েম করে, জাকাত আদায় করেএবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। যারা জাকাত আদায় করে না আল্লাহ তাদেরকেকঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ।

জাকাত ফরজ কার ওপর : জাকাত ফরজ হয়েছে কয়েকটি শর্ত সামনে রেখে। এগুলো হলো সম্পদেরমালিকানা সম্পর্কিত এবং অন্য কয়েকটি আবার মালিকানাধীন সম্পত্তি বিষয়ক। যেমন১.মুক্ত বা স্বাধীন মানুষ, অর্থাৎ ক্রীতদাস নয়; ২. সম্পত্তির মালিককে অবশ্যই একজনমুসলমান হতে হবে; ৩. জাকাত এমন ব্যক্তির ওপর ফরজ হয়, যিনি সুস্থমস্তিষ্ক এবং নিজস্বধীশক্তির ওপর যার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। জাকাত কোনো অপ্রকৃতিস্থ মানুষের ওপর ফরজহয় না; ৪. জাকাত সেসব সম্পদশালীর ওপর ফরজ হয়, যারা প্রাপ্তবয়স্ক; ৫. মালিককে তারসম্পদের পূর্ণ মালিকানা ও দখলের অধিকারী হতে হবে; ৬. সম্পদের প্রকৃত বা অনুমিতবৃদ্ধি হতে হবে। সম্পদের বৃদ্ধি বলতে মূল্যবৃদ্ধিকে বুঝায় যেমনস্বর্ণ, রৌপ্য বানগদ অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ হলে মূল্যমান বৃদ্ধি হতে পারে। ৭. অত্যাবশ্যকীয় চাহিদাপূরণের পর অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হতে হবে। অর্থাৎ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যেসবসম্পদ যেমনবসতবাড়ি, কাজের যন্ত্রপাতি, কারখানার মেশিনারি, যাতায়াতের বাহন, আসবাবপত্র, পরিধেয় ইত্যাদির ওপর জাকাত দিতে হবে না; ৮. জাকাত দাতাকে ঋণদায় থেকেমুক্ত হতে হবে ।

নিসাব : নিসাব হলো ন্যূনতম সেই পরিমাণ সম্পদ, যার মালিকানার কারণে সংশ্লিষ্টব্যক্তির ওপর জাকাত ফরজ হয়। কোনো ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্যরে ভিত্তিতেই ওই ব্যক্তিরওপর ট্যাক্স আরোপিত হয় এবং তদনুসারেই এর পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। অনুরূপভাবে ইসলামীআইনে কোনো ব্যক্তির মালিকানাধীন সম্পদের পরিমাণের ভিত্তিতেই ওই ব্যক্তির জাকাতনিরূপিত হয়। কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত একটি ন্যূনতম নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদেরমালিক না হন, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ব্যক্তির ওপর জাকাত আদায়যোগ্য নয়। শরিয়া আইনে ওইন্যূনতম নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদকে নিসাব বলা হয়। ওই ন্যূনতম নির্ধারিত বা ততোধিকপরিমাণ সম্পদের মালিককে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে তার সম্পদ গরিব ও দুঃখীদের সাথেভাগাভাগি করে নেয়ার উপযুক্ত সম্পদশালী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়।

বিভিন্ন সম্পদের জাকাত : জাকাত প্রযোজ্য হয় এমন সম্পদ হলোসোনা, রুপা, গবাদিপশু, সব ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য (ঃৎধফব মড়ড়ফং) ও খনি থেকে আহরিত বা গুপ্তধন। সোনা ও রুপাসম্পর্কিত বিধিবিধান হলো১. স্বর্ণ : এক বছরের জন্য কমপক্ষে ৮২.০৫ গ্রাম সোনা বাএর সমমূল্যের নগদ টাকার মালিকানার জন্য সংশ্লিষ্ট মালিকের ওপর ২.৫ শতাংশ হারে জাকাতআদায় করা ফরজ। ২. রুপা বা রৌপ্য : এক বছরের জন্য ন্যূনতম ৫৯৫.৩৫ গ্রাম রুপা বা এরসমমূল্যের নগদ টাকার মালিকানার জন্য সংশিষ্ট মালিকের ওপর ২.৫ শতাংশ হারে জাকাত আদায়করা ফরজ। অলঙ্কার, তৈজসপত্র বা অন্য যে আকার বা প্রকারেই থাকুক, তার ওজন ন্যূনতমনির্দিষ্ট পরিমাণ অতিক্রম করলে এবং এসবের মালিকানা একটি পূর্ণ চান্দ্র বছর ধরে বহালথাকলে ওই সোনা ও রুপার জন্য মালিকের ওপর জাকাত ফরজ হয়ে যায়। ৩. কারেন্সি নোট : কোনোব্যক্তির কাছে যদি কারেন্সি নোটরূপে নিসাব পরিমাণ সোনা বা রূপা ক্রয়ের মতো যথেষ্টটাকা থাকে, তবে প্রতি ১২ মাস পরপর তার জাকাত আদায় করতে হবে। ৪. বাণিজ্য পণ্যেরজাকাত : ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে রক্ষিত দ্রব্যসামগ্রীর পুঁজির জন্য জাকাত আদায়করতে হবে। ৫. শেয়ার সার্টিফিকেটের জাকাত : শেয়ার সার্টিফিকেটের জাকাত বার্ষিকভিত্তিতে নির্ণয় করতে হবে এসব শেয়ারের নগদে রূপান্তরযোগ্য বাজারমূল্য অনুসারে। এরূপবাজারমূল্য অবশ্যই পুঁজির অন্তর্ভুক্ত হবে এবং ইসলামের অনুশাসন অনুযায়ী এরূপ মোটমূল্যের জন্য জাকাত আদায় করতে হবে। ৬. কেবল মাঠে সঞ্চরণশীল পশুর মালিকানার জন্য ওইরূপ মালিকদের ওপর জাকাত আদায়যোগ্য। আস্তাবল, গোশালা, খাঁচা বা অনুরূপ বেষ্টনীতেআবদ্ধ যেসব পশু চরে বেড়ায় না, তাদের জন্য জাকাত আদায় করতে হবে না। অল্প বয়সের পশুরজন্য জাকাত একেবারেই আদায়যোগ্য নয়। এ ছাড়া শৌখিন অশ্বারোহণ, চাষবাস অথবা উপার্জন বাপেশাগত কাজে ব্যবহৃত পশুদের মালিকানার জন্যও যাকাত আদায় করতে হয় না। তা ছাড়া সম্পদপরিবৃদ্ধির আরো যেসব খাত রয়েছে, তা জাকাতযোগ্য, যা এত স্বল্পপরিসরে আলোচনার সুযোগ কম ।

ঋণ দেয়া অর্থের জাকাত : কোনো ব্যক্তি অন্যকে টাকা ধার দিলেও ওই পরিমাণ টাকার ওপরতার মালিকানা বহাল থাকে। তবে ওই খাতক ওই টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত তিনি ওই পরিমাণঅর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য উপভোগ করেন না। ইসলামী আইন অনুসারে ধার ও ঋণকে তিন ভাগেভাগ করা হয়। সাধারণভাবে এগুলো হলো১. কাভি বা নিশ্চয়তাসম্পন্ন ঋণ;এরূপ ক্ষেত্রেএমনকি পূর্ণ মেয়াদের জন্য ওই টাকা মহাজনের কাছে পরিশোধিত না হয়ে থাকলেও বা তাখাতকের হাতে রয়ে গেলেও ওই অর্থের মালিকের ওপর জাকাত আদায় করা বিধেয়। ২. মুতাওয়াসসিথবা দুর্বল নিশ্চয়তাসম্পন্ন; বাণিজ্যিক পণ্য কেনাবেচা বা নগদ টাকা ধার দেয়া ছাড়াঅন্যান্য লেনদেন এ প্রকৃতির ধার বা ঋণের অন্তর্ভুক্ত। এ রকম অর্থের মধ্যে পূর্ণনিসাব পরিমাণ টাকা উদ্ধার হলেই জাকাত আদায়যোগ্য। ৩. জায়িফ বা নিশ্চয়তাবিহীন। এ রকমক্ষেত্রে ওই রূপ দানের গ্রহীতা ওই দান প্রকৃত হাতে পাওয়ার পর ১২ মাস ধরে তা তারঅধিকারে থাকলেই এই সম্পত্তির জন্য তার (গ্রহীতার) ওপর জাকাত আদায়যোগ্য হবে। তারঅধিকারের বাইরে ওই সম্পত্তি যত দিন ছিল তত দিনের জন্য এর ওপর জাকাত হবে না ।হীরা, মুক্তা, রতেœর জাকাত : মূল্যবান পাথর তথা হীরা, মুক্তা ও মূল্যবান রতœরাজি বাপাথর যদি ব্যবসায় বা বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত না হয় তাহলে সেসবের জন্য জাকাত আদায়করতে হবে না। তবে ব্যবসায় বা বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত মূল্যবান রতœরাজির জন্যএসবের মালিকের ওপর জাকাত আদায় করার বাধ্যবাধকতা আছে।

বাড়িভাড়ার জাকাত : কারো যদি নিজের বা বৈধ নির্ভরশীলদের বসবাসের জন্য ব্যতীত অন্যগৃহ থাকে এবং তিনি তা অন্যকে ভাড়ায় দেন তাহলে ওই ভাড়া বাবদ প্রাপ্ত নিট আয়ের জন্যতাকে জাকাত আদায় করতে হবে। তবে সে রকম আয়ের পরিমাণ অবশ্যই নিসাব পরিমাণ হতে হবে এবংতা তার কাছে এক বছর ধরে বজায় থাকতে হবে। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট ইমারতের মূল্যের জন্যনয়, বরং এরূপ ইমারত থেকে প্রাপ্ত নিট আয়ের জন্যই জাকাত আদায় করতে হয়।যানবাহনের জাকাত : মোটরগাড়ি, ভ্যান, ট্রাক, ঠেলাগাড়ি, ওয়াগন, নৌকা ইত্যাদি যেসবযানবাহন ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় না, সেসবের মূল্যের জন্য জাকাত আদায় করতেহয় না। তবে এসব বাহন থেকে অর্জিত নিট আয় যদি মালিকের কাছে এক বছর ধরে থাকে তাহলে ওইনিট আয়ের জন্য জাকাত আদায়যোগ্য।

যেসব সম্পদের জাকাত দিতে হবে না : প্রত্যেক মানুষের ওপর যেমন জাকাত আদায় করাবাধ্যতামূলক বা ফরজ নয়, তেমনি জাকাতের বিধিবিধানও মানুষের সব ধরনের সম্পদের জন্যপ্রযোজ্য নয়। সোনা, রুপা, সঞ্চরণশীল গবাদিপশু, বাণিজ্যিক দ্রব্যস¤ভার ও বাণিজ্যপণ্যাদি জাকাতের বিধিবিধানের আওতায় আসে। এসব ছাড়া অন্যান্য দ্রব্যের জন্য জাকাতপ্রযোজ্য নয়। যথাদালান, সোনা বা রুপা ব্যতিরেকে অন্য উপাদানে নির্মিত তৈজসপত্র, থালাবাসন, আসবাবপত্র, কাপড়চোপড় ইত্যাদি। তবে ব্যবসায় বা বিনিয়োগের অংশ হিসেবেক্রয়কৃত যেকোনো পণ্য। যথাইমারত, গবাদিপশু, থালাবাসন, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদির জন্যজাকাত আদায় করতে হবে।

জাকাত কাদের প্রাপ্য : জাকাতের অর্থ বিতরণের বিষয়ে কুরআন শরিফে সুনির্দিষ্টনির্দেশনা রয়েছে। যারা জাকাত পাবেন তারা হলেন১. ফকির, অর্থাৎ এরূপ গরিব মানুষ যারসম্পত্তির পরিমাণ নিসাব অপেক্ষা কম; ২. মিসকিন, অর্থাৎ অভাবী, যার রোজগার তার নিজেরও নির্ভরশীলদের অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়; ৩. আমিলিন, অর্থাৎবায়তুল মাল বা কোনো সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণকাজে নিয়োজিতকমচারী; ৪. মুয়াল্লেফাতুল কুলুব, অর্থাৎ শাশ্বত ধর্মে দীক্ষাপ্রাপ্ত সেসব ব্যক্তি, যাদের হৃদয় সত্যের দিকে ধাবমান এবং যাদের জন্য সাহায্য আবশ্যক; ৫. রিকাব, অর্থাৎক্রীতদাসের দাসত্ব মোচনের জন্য মুক্তিপণ প্রদান; ৬. গারিমিন, অর্থাৎ ঋণগ্রস্তব্যক্তি; ৭. ইবনুস সাবিল, অর্থাৎ মুসাফিরের পাথেয়, যা অর্থাভাবে বিদেশ-বিভুঁইয়েআটকে থাকা এমনকি সচ্ছল ব্যক্তির ভ্রমণব্যয় হিসেবেও ব্যবহার করা যায়; এবং ৮. ফিসাবিলিল্লাহ, অর্থাৎ যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের নিয়োজিত রাখে বা আল্লাহকেসন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনো উত্তম কাজে ব্যয় করা।

Related Post