মহান আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। ইবাদতের মাধ্যমে বান্দাহ শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টিতে কয়েকটি আনুষ্ঠানিকতা পালন করে না; বরং ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর নিমিত্তে হওয়ার জন্য চাই খালেস নিয়ত ও একাগ্রচিত্ততা, যা বান্দাহ ক্রমাগতভাবে করতে থাকলে অর্জন করে এক মহামূল্যবান নিয়ামত, যাকে ‘তাক্ওয়া’ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তাক্ওয়া অর্থ : তাক্ওয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরহেজ করা ইত্যাদি। শরী’আতের পরিভাষায় তাক্ওয়া হলো, একমাত্র আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। যে ব্যক্তির মধ্যে তাক্ওয়া থাকে, তাকে মুক্তাকি বলা হয়। সৎ গুণাবলির মধ্যে তাক্ওয়া হচ্ছে অন্যতম। যার মধ্যে তাকওয়া থাকে, সে পার্থিব জীবনের লোভে কোনো খারাপ কাজ করে না। সে পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও মঙ্গলের কাজে সব সময় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক, কবিরা গুনাহ্ ও অশ্লীল কাজকর্ম ও কথাবার্তা থেকে বিরত রাখে, তাঁকে মুত্তাকি বলা হয়।” মুত্তাকি ব্যক্তি সততা, আমানতদারি, ধৈর্য, শোকর, আদল-ইনসাফ ইত্যাদি ধরনের গুণে গুণান্বিত হয়ে থাকে। মুত্তাকিদের পরিচয় প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন “যারা গায়েবের প্রতি ঈমান রাখে, নামাজ আদায় করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। আর যারা আপনার ওপর যা নাজিল করা হয়েছে এবং আপনার আগে যা নাজিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান রাখে, আর তারা আখেরাতের প্রতি ইয়াকিন রাখে।” (সূরা আল-বাকারা, ৩-৪)। উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লহ্ মুত্তাকিদের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন
১. গায়েব বা অদৃশ্য যেমন : আল্লাহ্, ফিরিশ্তা, জান্নাত-জাহান্নাম, আখেরাত ইত্যাদি যা মানবীয় জ্ঞানে বোধগম্য নয়- এরূপ বিষয়গুলোতে ঈমান রাখা। ২. নামাজ কায়েম করা অর্থাৎ যথাযথ শর্ত পালন করে নিষ্ঠার সাথে নামাজ কায়েম করা। ৩. আল্লাহর পথে ব্যয় করা অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবিকা ও ধনসম্পদ থেকে তাঁরই নির্দেশিত পথে ব্যয় করা। ৪. রাসূলুল্লাহ্ (সা:) – এর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন এবং তাঁর পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের ওপর ঈমান রাখা। ৫. মুত্তাকিরা পরকাল সম্পর্কে দৃঢ়বিশ্বাসী। তারা দুনিয়ার ণস্থায়ী জীবন এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের প্রতি ইয়াকিন রাখে।
তাক্ওয়ার গুরুত্ব ও তাৎপর্য : তাক্ওয়া মানব চরিত্রের অন্যতম সম্পদ। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাক্ওয়া। ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবনযাপনের চালিকাশক্তি হচ্ছে তাক্ওয়া। মানব জীবনের তাক্ওয়া গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করো।” (সূরা আলে ইমরান, ১০২)। আরো ইরশাদ হয়েছে “আল্লাহর নিকট পৌঁছে না ওগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশ্ত ও রক্ত। বরং পৌঁছে তোমাদের তাক্ওয়া।” (সূরা আল-হাজ্জ, ৩৭)। তাক্ওয়া আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করার উপায়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন।” (সূরা আত-তাওবা, ৪)।
আরো ইরশাদ হয়েছে এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর মনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ্ মুত্তাকিদের সাথে আছেন।” (সুরা আল-বাকারা, ১৯৪)। তাক্ওয়া অবলম্বন জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্ (সা:) বলেন, “দু’টি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না :
১. একটি চোখ, যা আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে, ২. আর অপর চোখ যা আল্লাহর রাস্তায় পাহারা রত অবস্থায় রাত্রি যাপন করে।” (তিরমিজি শরীফ)
তাক্ওয়া শুধু মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয় না, বরং তা জান্নাতে প্রবেশ করতেও সাহায্য করে। যেমন আল্লাহর বাণী : অর্থাৎ “আর যে ব্যক্তি তার রবের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে ফিরিয়ে রাখে নিশ্চয়ই জান্নাত হবে তার আবাসস্থল।” (সূরা আন-নাযি’আত, ৪০-৪১)। আল্লাহ্ তা’আলা অপর আয়াতে ইরশাদ করেন “মুত্তাকিরা থাকবে নিরাপদ স্থানে।” (সূরা দুখান, ৫১) মুত্তাকি আল্লাহর নিকট সম্মানিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী : “তোমাদের মাঝে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি।” (সূরা হুজুরাত, ১৩)। তাক্ওয়া সমাজ জীবনে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে সমাজে ইতিবাচক মূল্যবোধ সৃষ্টি করে এবং তাকওয়ার অভাবে মানব চরিত্র পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে সামাজিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে, যার নজির বর্তমান বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি েেত্র তাক্ওয়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা খুবই বেশি। মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে যত দিন না তাক্ওয়া সৃষ্টি হবে, তত দিন মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গল আশা করা যায় না। তাই বলা যায়, তাক্ওয়া হলো মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের জীবনের মুক্তি ও নাজাতের জন্য মূল চাবিকাঠি। ==0==