ইরাকের এক সম্পদশালী লোক। নাম খোযায়মা বিন বিশর। তাঁর ছিল প্রচুর ধন-দৌলত ও বিত্ত-বৈভব। কিন্তু ছিল না কৃপণতা ও রুঢ়তা। ছিল না অহঙ্কার ও আত্মম্ভরিতা।
অর্থের প্রাচুর্যে অনেক মানুষ বিলাসী হয়, অনেকে অপব্যয়ী হয়। আবার অনেকে হয় নির্দয়-নিষ্ঠুর। কিন্তু খোযায়মার মধ্যে এর কোনোটাই ছিল না। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন প্রাণভরে। দান করতেন অকাতরে। দানের প্রত্যাশা নিয়ে লোকজন তাঁর কাছে আসত। ভিড় জমাত। কিন্তু তিনি কাউকেই বিমুখ করতেন না। খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। বঞ্চিত করতেন না তাঁর দান ও ধন থেকে; ভালোবাসা ও অনুগ্রহ থেকে।
মাটির মতো সহজ-সরল এ মানুষটির দান ছিল সবার জন্য, সবসময়ের জন্য। তাঁর করুণা ও অনুগ্রহ ছিল দিবা-রাত্র ও সর্বত্র। এভাবে মানুষকে দান করে, ভালোবাসায় সিক্ত করে সুখেই কাটছিল তাঁর জীবন।
দান করলে ধন বাড়ে, ধনে বরকত হয়, কমে না,এটাই সাধারণ রীতি। এটাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। আল্লাহ পাকের এ নিয়মই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে; বরং বলা যায় সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে। তবে মাঝে মধ্যে আল্লাহ পাক এ নিয়মের ব্যতিক্রমও করেন। তখন উদ্দেশ্য হয় বান্দাকে পরীক্ষা করা এবং এই পরীক্ষার মাধ্যমে তাকে মর্যাদার সুউচ্চ আসনে সমাসীন করা। খোযায়মা বিন বিশরের বেলায়ও এমনটি হয়েছিল। আল্লাহ পাক তাঁকে পরীক্ষা করেছিলেন; কঠিন পরীক্ষা। খুশির কথা, সেই পরীক্ষায় তিনি কৃতকার্যও হয়েছিলেন।
খোযায়মার পরীক্ষা শুরু হলো। মাল কমতে লাগল। এই যে কমা শুরু হলো আর বন্ধ হলো না। অর্থ-সম্পদ কমতে কমতে একদিন তিনি নিঃস্ব হলেন। গরীব হলেন। হয়ে গেলেন একেবারে রিক্তহস্ত। ফলে অভাব-অনটন দেখা দিল। ক্ষুধা-অনাহার সঙ্গী হলো।
খোযায়মার এই দুর্দিনে আত্মীয়-স্বজনরা এগিয়ে এল। এগিয়ে এল বন্ধু-বান্ধবরাও। আর স্ত্রীর করুণ মুখপানে তাকিয়ে তিনিও তাদের দান গ্রহণে ‘না’ বলতে পারলেন না। পারলেন না, কোনো ধরনের ‘অপারগতা’ প্রকাশ করতে।
কিন্তু রক্তের টান আর কতকাল? বন্ধু-বান্ধবের সাহায্য আর কতদিন?
একসময় রক্তের আত্মীয়রা দূরে সরে গেল। বন্ধু-বান্ধবরাও পিছিয়ে গেল। ধীরে ধীরে বন্ধ হলো অনুগ্রহের দুয়ার। খোযায়মার আলো ঝলমল সংসারে নেমে এল তিমির অন্ধকার।
যে ব্যক্তির অবারিত দানে সিক্ত হতো কাছের-দূরের অসংখ্য মানুষ, যার দানের প্রত্যাশায় নিত্যদিন ভিড় জমাত অগনিত বনী আদম, যার দয়া আর অনুগ্রহে নতুন প্রাণ ফিরে পেত, এতিম, অসহায় ও অভাবী লোকজন, যার সাহায্যে উপকৃত হতো হাজারো ইনসান, সেই লোকটির আজ চলার মতো পয়সা নেই, খাওয়ার মতো অন্ন নেই, পরিধানের ভালো বস্ত্র নেই, রান্না করার কিছু নেই। ওহ! একজন বিত্তশালী লোকের জন্য এর চেয়ে কঠিন পরীক্ষা আর কী হতে পারে?
কিন্তু খোযায়মা এই কঠিন অবস্থায়ও ভেঙ্গে পড়লেন না। হতাশ হলেন না। কেনই বা তিনি হতাশ হবেন? মানুষের দুয়ার বন্ধ হয়ে গেছে বলে কি আল্লাহর দুয়ারও বন্ধ হয়ে যাবে? না, তা হবে না। হতেই পারে না। আল্লাহর দুয়ার সর্বদাই খোলা থাকে। বন্ধ হয় না কখনো। একজন প্রকৃত মুমিন এই বিশ্বাসকেই সারাক্ষণ লালন করে তার হৃদয়ের মনিকোটায়।
খুযায়মার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এ পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন, পাশ করবেন। এবং ভালোভাবেই পাশ করবেন। কিন্তু তার স্ত্রী? সে কি পারবে ধৈর্যধারণ করতে? পারবে কি সীমাহীন কষ্ট বরদাশ্ত করতে? যদি না পারে? আর পারলেই বা কতদিন পারবে?
খোযায়মা তাঁর জীবন-সঙ্গিনীকে আর কষ্ট দিতে চাইলেন না। চাইলেন না তাকে দুঃখ-মসীবতের অংশীদার বানাতে। তাই একদিন তিনি স্ত্রীকে ডাকলেন। কাছে বসালেন। একান্ত কাছে। তারপর পরম মমতার সুরে বললেন, প্রিয়তমা! এ পর্যন্ত তুমি অনেক কষ্ট স্বীকার করেছ। অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছ। আমি চাই না যে, আমার সঙ্গী হয়ে তুমি আরো কষ্ট ভোগ করো, আরো বিপদ-মুসীবতের সম্মুখীন হও। বরং আমি চাই যে, দুঃখ-কষ্ট যা হওয়ার, আমারই হোক, তোমার না হোক। আমার ইচ্ছা হলো, তুমি তোমার পিত্রালয়ে চলে যাও। সেখানে আরামে দিনাতিপাত করো। সুখে-শান্তিতে বসবাস করো। আর আমি? হ্যাঁ, আজ থেকে আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারো সাহায্য নেব না। দরজা বন্ধ করে ঘরেই বসে থাকব। হয় আল্লাহর সাহায্য আসবে, নয় সেখানেই আমার মৃত্যু হবে।
স্ত্রী বললেন, প্রিয়তম! আপনি কী করে ভাবতে পারলেন যে, আমি আপনাকে কষ্টে রেখে স্বার্থপর লোকদের মতো কেটে পড়ব? বাপের বাড়ি চলে যাব? না, তা কখনোই হতে পারে না। বরং আপনার সুখের সময় আমি যেমন আপনার পাশে ছিলাম, তেমনি দুঃখের সময়ও আপনার পাশেই থাকব। যদি মরতে হয়, একসাথেই মরব। আমার ঘর আপনার সাথে, আমার করবও হবে আপনার পাশে। দোয়া করি, আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে পরকালেও একসাথেই রাখেন।
স্ত্রী কথায় খোযায়মা যারপর নাই আনন্দিত হলেন। বললেন, তোমার প্রতি আমার ধারণা এমনই ছিল। তবু তোমার মনের কথাটা পরিস্কার করে জেনে নিলাম।
সেদিন থেকে অকৃতজ্ঞ মানুষদের সাথে অভিমান করে ঘরকে ‘কবর’ বানিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকলেন তারা।
হায়! এতবড় দানশীল মানুষের আজ এই দশা! এত কষ্ট!!
আফসোফ! গোটা জীবন যিনি মানুষের উপকার করলেন, ধনে-দানে ধন্য করলেন, সেই উপকারী বন্ধুর চরম দুর্দিনে কেউ আজ খোঁজ-খবর নিল না, কেউ পাশে এসে দাঁড়াল না, সবাই কেটে পড়ল!!
পাঠক! এসব অকৃতজ্ঞ মানুষের প্রতি খোযায়মার যদি অভিমান হয়, তাহলে কি বড় অন্যায় হবে?
তখন আরব উপদ্বীপের শাসনকর্তা ছিলেন ইকরামা ফাইয়ায। দানের ব্যাপারে তিনিও ছিলেন মুক্তহস্ত। মানব কল্যাণে ধন-সম্পদ ব্যয়ের মধ্যে তিনিও খুঁজে পেতেন, তৃপ্তি ও আনন্দ। লাভ করতেন গভীর প্রশান্তি।
একদিন তিনি পরিষদ নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় তাঁর মনে হলো খোযায়মার কথা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, খোযায়মাকে বেশ কয়েকদিন যাবত দেখছি না যে! তাঁর কোনো অসুখ-বিসুখ হয় নি তো?
একজন বলল, আমারও তো একই জিজ্ঞাসা। দূরের কোনো সফরে গেছেন কিনা কে জানে!
আরেকজন বলল, আমার জানা মতে, শহরেই তিনি আছেন। তবে মানুষের সাথে অভিমান করে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে দরজা বন্ধ করে ঘরে পড়ে আছেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছেন, দরজা খুলে আর কখনো মানুষের সমাজে বের হবেন না।
কেন কেন? চরম উৎকণ্ঠা ও বিস্ময় নিয়ে কারণ জানতে চাইলেন ইকরামা ফাইয়ায।
লোকটি তখন শাসনকর্তাকে সবকিছু খুলে বলল।
সবশুনে তিনি বললেন, খোযায়মাকে সাহায্য করার মতো ধনী লোক কি এই শহরে নেই?
হুজুর! লোক তো আছে। আছে ধনও। কিন্তু লোক আর ধন থাকলেই তো চলবে না! মনও লাগবে!!
কথাবার্তার এ পর্যায়ে এসে ইকরামা ফাইয়ায একদম নীরব হয়ে গেলেন। মনে হলো, কী যেন চিন্তা করছেন তিনি।
খানিক পর নীরবতা ভঙ্গ করে পুনরায় কথা শুরু করলেন তিনি। তবে খোযায়মার প্রসঙ্গ নিয়ে নয়, অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে। এতে পরিষদের সবাই বেশ অবাক হলো। আর যারা ভেবেছিল, এবার হয়তো খোযায়মার দুঃখের অবসান হবে, তারাও বেশ হতাশ হলো।
এদিকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই একে একে তিনদিন না খেয়ে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়লেন। তবে স্ত্রীর দুর্বলতা ছিল অপোক্ষকৃত বেশি। তার চেহারার দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। স্ত্রীর এই করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে খোযায়মা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি অস্থির হয়ে ভাবলেন, আমার মৃত্যু হয় হোক, কিন্তু অনাহারে থেকে প্রিয়তমা স্ত্রীর করুণ মৃত্যু, সে আমি সইব কেমন করে? তার প্রাণ রক্ষার জন্য কিছু একটা আমাকে করতেই হবে।
খোযায়মা দরজা খুললেন। ঘর থেকে বেরুলেন। ক্ষণিকের তরে ভুলে গেলেন আগের সেই প্রতিজ্ঞার কথা। কিন্তু কোথায় যাবেন তিনি? কার কাছে সাহায্য চাইবেন?
এ মুহূর্তে তাঁর মনে হলো, তাঁর দান ও সহযোগিতায় যারা বড় হয়েছে, যাদের আজ কোনো অভাব-অনটন নেই, তাদের কাছেই যাবেন। তাদের কাছেই সাহায্য চাইবেন।
একথা ভেবে অনাহারকিষ্ট দেহের ভার বহুকষ্টে বহন করে কিছুদূর এগুলেনও, কিন্তু আত্মর্যাদার ভার বহন করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো না!
এতদিনের ‘উপরের হস্ত’ আজ পরিণত হবে ‘নিচের হস্তে’?
এতদিনের দাতা আজ হবেন গ্রহীতা?
তাও আবার একদল অকৃতজ্ঞ মানুষের দুয়ারে উপস্থিত হয়ে?
অসম্ভব! তা হতেই পারে না।
ধনে গরীব হলেও মনে তো তিনি গরীব হননি! অথচ মনের প্রাচুর্যই হলো বড় প্রাচুর্য!
তাহলে কেন তিনি ধনের জন্য মনকে কুলষিত করতে যাবেন– এই অকৃতজ্ঞদের কাছে?
খোযায়মা আবার ফিরে এলেন তাঁর ‘ঘরের কবরে’!
ভরসা করে বসে রইলেন একমাত্র আল্লাহর উপরে॥
গভীর রাত। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না। এমন সময় কে যেনো দরজায় আওয়াজ দিল। খোযায়মার দেহে শক্তি নেই। নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকুও নিঃশেষ প্রায়। তবু অনেক কষ্টে দরজা খুললেন। দেখলেন, মুখোশপরিহিত এক ঘোড়সওয়ার।
দরজা খুলতেই ঘোড়সওয়ার এগিয়ে এল। কিন্তু ঘোড়া থেকে নামল না। কোনো কথাও বলল না। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে খোযায়মা বেশ বিস্মিত হলো। তাঁর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই ঘোড়সওয়ার একটি ভারী থলে তাঁর দিকে এগিয়ে দিল। কিন্তু খোযায়মা থলের দিকে হাত না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি? কী আপনার পরিচয়?
ঘোড়সওয়ার বলল, আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। আল্লাহ পাকই আমাকে আপনার দুয়ারে নিয়ে এসেছেন। আর এই যে থলেটি দেখছেন, এটি একজন ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষ থেকে এক ‘মানব-দরদী’র জন্য সামান্য হাদিয়া। দয়া বা দান নয়। আল্লাহ ছাড়া কেউ এর সাক্ষীও নেই।
আপনার পরিচয় না জেনে আমি এটা গ্রহণ করব না। খোযায়মা সসংকোচে বললেন।
আমি মানুষের অকৃতজ্ঞতার মাশুল আদায় করি– এ-ই আমার পরিচয়।
আরেকটু খুলে বলুন।
মাফ করুন। এ বলে থলেটি খোযায়মার সামনে রেখে ঘোড়সওয়ার চোখের পলকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন এবং মুহূর্তেই অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন।
কে এই দরদী বন্ধু? কে এই আঁধার রাতের ঘোড়সওয়ার? তিনি কি মাটির মানুষ, না আসমানের ফেরেশ্তা? দেখতে তো মাটিরই মানুষ! কিন্তু যদি বলি, মহত্ত্বে ফেরেশ্তা থেকেও উঁচুতে তার অবস্থান, তাহলে ‘না’ বলার কোনো উপায় আছে কি? কিন্তু তাঁর পরিচয়?
হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন আরব উপ-দ্বীপের শাসনকর্তা ইকরামা ফাইয়ায।
সেদিন খোযায়মার অভাবের কথা শুনে চার হাজার স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে নিয়ে নিজেই তিনি হাজির হয়েছিলেন তাঁর ভাঙ্গা কুটিরে! তারপর ফিরে এসেছিলেন একবুক তৃপ্তি ও গভীর প্রশান্তি নিয়ে। (চলবে)