Originally posted 2013-02-17 09:57:49.
আন-নাসীহা বা নসীহত শব্দের অর্থ হল : উপদেশ দেয়া, কল্যাণ কামনা করা। যার কল্যাণ কামনা করা হয় তাকেই উপদেশ দেয়া হয়। নসীহতের বিপরীত হল : ধোঁকাবাজী, প্রতারণা, খেয়ানত, ষড়যন্ত্র, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি। মানুষের বিবাদ মীমাংসা করাও একটি নসীহত। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই, অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যে সংশোধন-মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। (সূরা হুজুরাত-১০) আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে নূহ আলাইহিস সালামের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, নূহ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন : আমি আমার প্রতিপালকের পয়গাম তোমাদের কাছে পৌছিয়ে দিচ্ছি, আর আমি তোমাদের উপদেশ দেই ও কল্যাণ কামনা করি। আর তোমরা যা জান না আমি তা আল্লাহর নিকট থেকে জেনে থাকি। (সূরা আ’রাফ-৬২)
আল্লাহ তা’আলা আল-কুরআনে নবী হূদ আলাইহিস সালাম-এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, হূদ আলাইহিস সালাম বলেছিলেন : আমি আমার প্রতিপালকের পয়গাম তোমাদের নিকট পৌছিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত কল্যাণকামী-উপদেশ দাতা। (সূরা আ’রাফ-৬৮)
উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় :
(এক) ঈমানদারগণ একে অপরের ভাই, তাই তারা অবশ্যই পরস্পরের কল্যাণ কামনা করবে। এক ভাই তার অপর ভাইয়ের জন্য অকল্যাণ কামনা কখনো করে না বা করতে পারে না।
(দুই) সত্যিকার ভ্রাতৃত্ব হবে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব। এটি রক্ত সম্পর্কীয় ভ্রাতৃত্বের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রক্ত সম্পর্কীয় ভ্রাতৃত্বের মধ্যে যদি দ্বীন না থাকে তবে সেটা আল্লাহর কাছে কোন ভ্রাতৃত্ব বলে স্বীকৃতি পায় না।
(তিন) মুসলিমরা যখন একে অপরের ভাই, তখন তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা। এটা কল্যাণকামিতার একটি দিক।
(চার) সকল নবীই মানবতার কল্যাণ কামনা করেছেন। এ জন্য কল্যাণকামিতাই হল আসল ধর্ম।
হযরত আবু রুকাইয়া তামীম ইবনে আউস আদ-দারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ধর্ম হল নসীহত বা কল্যাণকামিতা। আমরা বললাম, কার জন্য কল্যাণ কামনা? তিনি বললেন : আল্লাহ তা’আলা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল এবং মুসলমানদের নেতৃবর্গ ও সাধারণ মুসলমানদের জন্য। (মুসলিম)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয় :
(এক) ইসলাম ধর্মের মূল কথা হল অপরের কল্যাণ কামনা। তাই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ধর্ম হল কল্যাণ কামনা করা।
(দুই) পাঁচ প্রকার সত্ত্বার জন্য কল্যাণ কামনা করতে হবে।
প্রথমত : আল্লাহ তা’আলার জন্য কল্যাণ কামনা করা। প্রশ্ন হতে পারে আমরা মানুষ হয়ে মহান আল্লাহ যিনি সকল কল্যাণের স্রষ্টা ও মালিক, তাঁর জন্য কিভাবে কল্যাণ কামনা করব? অর্থাত, আল্লাহর জন্য কল্যাণ কামনা হল : তাকে সর্ব বিষয়ে প্রভু-পালনকর্তা বলে স্বীকার করা। তাকে ছাড়া আর কারো ইবাদত না করা। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক-সমকক্ষ জ্ঞান না করা। তাঁর গুণাবলীগুলো অবিকৃতভাবে বিশ্বাস করা। তাঁর আদেশগুলো মেনে চলা। নিষেধগুলো বর্জন করা। তাঁর জন্য বন্ধুত্ব, তাঁর জন্য শত্রুতা পোষণ করা। তাঁর নি’আমাত সমূহের শুকরিয়া আদায় করা।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহর কিতাবের জন্য জন্য কল্যাণ কামনা করা। অর্থাত, আল কুরআন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বলে বিশ্বাস করা। তা অবিকৃত বলে বিশ্বাস রাখা। তিলাওয়াত বা অধ্যায়ন করা। এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা।
তৃতীয়ত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য কল্যাণ কামনা করা। অর্থাত, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা’আলার রাসূল বলে বিশ্বাস করা, তাঁর আদেশ, নির্দেশ ও আদর্শ অনুসরণ করা, তাঁকে ভালবাসা।
চতুর্থত : মুসলমানদের নেতা ও ইমামদের জন্য কল্যাণ কামনা করা। অর্থাত, তাদের আনুগত্য করা, সত্য প্রতিষ্ঠায় তাদের সাহায্য করা, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা, তাদের সংশোধনের জন্য চেষ্টা করা ও উপদেশ দেয়া, তাদের জন্য দু’আ করা।
পঞ্চমত : সাধারণ মুসলিমদের জন্য কল্যাণ কামনা করা। অর্থাত, জাগতিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের উপদেশ ও নির্দেশনা দেয়া, তাদের পারস্পারিক বিবাদ মীমাংসা করে দেয়া, তাদের সকল ভাল কাজে সহযোগিতা করা, তাদের দোষত্রুটি গোপন রাখা, নিজের জন্য যা পছন্দ তা তাদের জন্যেও পছন্দ করা, সহমর্মিতার সাথে তাদের ভাল কাজের আদেশ করা আর অন্যায় থেকে বিরত রাখা, তাদের জন্য দু’আ করা।
হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে শপথ (বাইআত) গ্রহণ করেছি, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, সকল মুসলমানের জন্য কল্যাণ কামনা ও উপদেশ দেয়ার। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয় :
(এক) বাইয়াত হল, হাতে হাত রেখে শপথ করা। জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) তিনটি বিষয়ে রাসূলের হাতে হাত রেখে শপথ করেছেন। বিষয় তিনটি হল : নামাজ, যাকাত ও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কল্যাণ কামনা করা।
(দুই) ইসলামের প্রতি একনিষ্ঠ মুসলিম সর্বদা অপর মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করে থাকে কিন্তু মুনাফিক অপর মুসলিমের জন্য কল্যাণ কামনা করে না।
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করে। (বুখারী ও মুসলিম)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয় বিষয় :
(এক) কল্যাণ কামনার একটি দিক হল, নিজের জন্য যা পছন্দ করবে তা অপরের জন্যও পছন্দ করা। যদি কারো মধ্যে এ গুণটি অর্জন না হয় তাহলে সে অপরের জন্য কল্যাণকামী বলে বিবেচিত হবে না। কল্যাণ কামনার নামই তো দ্বীন। এ গুণটি না থাকলে এমনকি সত্যিকার ঈমানদার বলেও গণ্য হবে না। তাই হিংসুক ব্যক্তি কখনো কল্যাণকামী হতে পারে না। কারণ, সে অন্যের কল্যাণ হোক তা চায় না। সে সর্বদা নিজের কল্যাণ চায়।
(দুই) যে ব্যক্তি সর্বদা নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করে সে কল্যাণকামী হতে পারে না। তাই স্বার্থপরতা কল্যাণ কামনার পথে একটি বড় বাধা। যে ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপরের জন্য তা পছন্দ না করলে সে-ই স্বার্থপর। এ গুণটি অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন। মুসলিম জীবনে এ গুণটির অভাব সবচেয়ে বেশী। এ গুণটি না থাকার কারণে আমরা সর্বক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হই। অথচ এ গুণটিকে ঈমানের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এটি ঈমানের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
কল্যাণকামীদের মর্যাদা : আল্লাহর বান্দাদেরকে দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণের নসীহত করাই ছিল নবী-রাসূলদের কাজ। অতএব কোন ব্যক্তির মর্যাদাবান হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে সৃষ্টি সেরা ব্যক্তিত্ব তথা নবী-রাসূলদের কাজ আঞ্জাম দিচ্ছে। কেননা নবীদের উচ্চ মর্যাদার মাধ্যমই ছিল এই নসীহত। সুতরাং মহান আল্লাহর দরবারে হিসাবের পাল্লাকে মর্যাদাবান করতে চাইলে গুরুত্বপূর্ণ এই মহান কাজে অবশ্যই শরীক হতে হবে। আল্লাহ তা’আলা সকল মুসলিমকে এ গুণটি অর্জন করার তাওফীক দান করুন।