মুসলমানের ধর্ম ও আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ও সেক্যুলার হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের দেশের সেক্যুলারিস্টদের কোনো নীতি নেই। তারা যা বলেন তা করেন না, যা করেন তা বলেন না। সেক্যুলারিজমের মূল কথাই হলো ধর্মহীনতা বা কোনো ধরনের ধর্মবিশ্বাস না থাকা। কিন্তু আমাদের দেশে একদল সেক্যুলার আছেন যাদের কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিভ্রান্ত হতে হবে। সেক্যুলারিজমের অর্থ ‘ধর্মহীনতা’হলেও এরা প্রচার করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এর মাধ্যমে তারা এদেশের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে চলছে। পুরোদস্তুর নাস্তিক হলেও এদের কেউ কেউ মাথায় টুপি পরে ব্যক্তিবিশেষের জানাজায় উপস্থিত হন। বিভিন্ন দিবসে দোয়া-মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল করেন। সংবিধান থেকে ধর্মের কালো ছায়াও মুছে ফেলার ঘোষণা দেন, আবার বিভিন্ন ধর্মীয় উত্সবে গিয়ে ধর্মীয় লোকদের শুভেচ্ছা জানান! বাংলাদেশের সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থার ধারা বাদ দিয়ে আবার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রেখে দেয়া হয়েছে। সত্যিই আজব!
ইদানীং আরেকটি প্রতারণামূলক বাক্য বাজারে চালু হয়েছে—‘ধর্ম যার যার, উত্সব সবার’। এই বাক্যটিও সেক্যুলারিস্টদের মনগড়া কথা। একটু গভীরে চিন্তা করলে বোঝা যাবে কথাটির মধ্যে গলদ কোথায়। সত্যিই কি ‘ধর্ম যার যার উত্সব সবার’? আস্তিকমাত্রই একথার অসারতা টের পাবেন। কেননা প্রত্যেকটি ধর্মীয় উত্সবের সঙ্গে জড়িত আছে ধর্মবিশ্বাস। ধর্মবিশ্বাসের সূত্র ধরেই একেকটা ধর্মীয় উত্সব পালিত হয়। যেমন ধরুন, ইসলামের বড় উত্সব হচ্ছে, দুই ঈদ তথা ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। এই দুই উত্সবের মধ্যে রয়েছে মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় বিশ্বাসের নিবিড় সম্পর্ক। রমজানের পুরো একমাস রোজা রাখার পর মুসলিম নর-নারী ঈদুল ফিতর পালন করেন। ‘ফিতর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ভাঙা। পুরো একমাস দিনের বেলা আহার-পানীয় এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থেকে ঈদুল ফিতরের দিন থেকে আবার তা করা হয় বিধায় একে ঈদুল ফিতর বলা হয়। এই উত্সব পালন করার নৈতিক অধিকার কেবল রোজাদার মুসলিমেরই রয়েছে। ইবরাহিম (আ.)-এর মহান কোরবানির ইতিহাস জড়িত আছে ঈদুল আজহা পালনের মধ্যে। ইসলামের এই উত্সব শুধু উত্সবই নয়, বরং তা ইবাদত যা পালন করা আবশ্যকও বটে। যার ওপর কোরবানি করা ফরজ তাকে অবশ্যই কোরবানি করতে হবে। আবার এই উত্সব যেনতেনভাবে উদযাপন করার কোনো সুযোগ নেই। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় রোজা রাখা হারাম। ঈদের দিন ঈদের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করতে হয় মুসলিমদের। পশু কোরবানি ঈদুল আজহার নামাজের আগে করলে হবে না। আবার পশুকে আল্লাহর নাম ছাড়া অন্য কারও নামে জবাই করলেও হবে না। এ থেকে বোঝা যায় মুসলমানের উত্সব পালনের মধ্যেও ধর্ম কতটা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে।
খ্রিস্টানদের ‘বড়দিন’ উত্সবের মধ্যেও আছে ধর্মবিশ্বাস। যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনকে তারা ক্রিসমাস ডে বা বড়দিন হিসেবে পালন করে। হজরত ঈসা (আ.)-কে তারা যিশু মনে করে। যিশুকে নিয়ে তাদেরও আছে ধর্মবিশ্বাস। খ্রিস্টানরা মনে করে যিশু হচ্ছে আল্লাহরই একটি অংশ; যিনি মানবরূপে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা মনে করেন, হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর পাপের শাস্তি দেয়া হয়েছে তারই সন্তান ঈসাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার মাধ্যমে। তারা ‘ত্রিতত্ত্ববাদ’-এ বিশ্বাস করে। যেখানে আল্লাহ হলেন, পিতা আল্লাহ, ঈসা হলেন পুত্র আল্লাহ এবং মরিয়ম হলেন পবিত্র আত্মা। খ্রিস্টানদের এই ধর্মবিশ্বাস মুসলিমদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। খ্রিস্টানদের এই বিশ্বাস কোনো মুসলিম করতে গেলে তিনি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করবেন এবং নিশ্চিত ঈমানহারা হবেন। কেননা ইসলামে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করার কোনো সুযোগ নেই। সব নবী-রাসুলের ওপর ঈমান আনা মুসলমানের ওপর ফরজ। হজরত ঈসার বিষয়ে কোরআন-হাদিসে যে তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে তার বাইরে অন্য কোনো বিশ্বাস কোনো মুসলমান করার সুযোগ একেবারেই নেই। তাই কোনো মুসলিম খ্রিস্টানদের বড়দিনের বিশ্বাসে একমত পোষণ করে উত্সবে যোগদান করতে পারে না।
হিন্দুদের শারদীয় দুর্গাপূজা, কালীপূজাসহ বিভিন্ন পূজা উত্সবের মধ্যেও আছে গভীর ধর্মবিশ্বাসের অস্তিত্ব। ধর্মবিশ্বাসের কারণেই তারা বিভিন্ন পূজা উত্সব পালন করছেন। ধর্মে না থাকলে তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে ধর্মীয় আচারাদি পালন করতেন না। বৌদ্ধদের সবচেয়ে বড় উত্সব হচ্ছে বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এ দিনটিকেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পালন করেন ধর্মবিশ্বাস থেকেই।ধর্মবিশ্বাসের এই তারতম্যের কারণেই যার যার ধর্ম, উত্সবও তার তার। কেননা মুসলিমের কাছে যিনি নবী, খ্রিস্টানদের কাছে তিনি আল্লাহর অংশ মানে আল্লাহ। মূর্তি পূজা হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মে পবিত্র কর্ম বলে বিবেচিত হলেও ইসলামে তা পৌত্তলিকতা এবং আল্লাহর অস্তিত্বে অন্য কাউকে শরিক করা। ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি মুসলমানের কাছে পবিত্র কাজ হলেও বৌদ্ধদের কাছে তা গর্হিত অপরাধ। ধর্মবিশ্বাসের এই ভিন্নতার কারণে এক ধর্মে বিশ্বাসী লোক অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীর উত্সবকে বিশ্বাস করতে পারে না। কেননা সেটি করতে গেলে তাকে নিজ ধর্মের বিশ্বাসকে বিসর্জন দিতে হবে। এ কারণেই ধর্মীয় উত্সব সর্বজনীন নয়। যারা ‘ধর্ম যার যার, উত্সব সবার’ বলে বেড়ান তারা মূলত সব ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে ধোঁকায় ফেলে নাস্তিক্যবাদের দিকে নিয়ে যেতে চান। কৌশলে তারা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের মূল চেতনা থেকে দূরে সরাতে চান। সেক্যুলারিস্টদের এটি একটি চালাকি। চমত্কার চমত্কার স্লোগান দিয়ে তারা সহজ-সরল আস্তিক মানুষকে নাস্তিক বানাতে চায়। একটি দেশের সর্বজনীন উত্সব হতে পারে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, মাতৃভাষা দিবস, মানবাধিকার দিবস ইত্যাদি। যার মধ্যে আছে সর্বজনীনতা; একক কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীর চেতনা যেখানে কাজ করে না।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে সর্বজনীনতার রূপ দিতে গেলে সমস্যা আছে। বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনো উত্সবকে সর্বজনীন করতে গেলে তার মধ্যে অশ্লীলতা, গান-বাজনা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মাদকতা ইত্যাদি হুরহুর করে ঢুকে পড়বে, যা ইসলাম কোনোভাবেই অনুমোদন করে না। আমাদের অনুরোধ, ‘ধর্ম যার যার, উত্সব সবার’ কথাটি পরিহার করুন। তবে সব ধর্মের উত্সব ও আনুষ্ঠানিকতার সময় পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হবে। এটি নিষিদ্ধ নয়, এটি কাম্য। ইসলামে এর নির্দেশনা ও গৌরবজনক ঐতিহ্য রয়েছে। সব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে করতে দেয়া আর সব ধর্মীয় উত্সবকে সবার বলে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মধ্যে তফাত আছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে নবী! তুমি বলে দাও, হে কাফেররা, আমি (তাদের) ইবাদত করি না যাদের ইবাদত তোমরা কর। না তোমরা (তাঁর) ইবাদত কর যার ইবাদত আমি করি। এবং আমি (কখনোই তাদের) ইবাদত করব না যাদের তোমরা ইবাদত কর। না তোমরা কখনও (তাঁর) ইবাদত করবে যাঁর ইবাদত আমি করি; অতএব তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য আর আমার ধর্ম আমার জন্য।’ (সূরা আল কাফিরুন: ১-৬)।===