ধৈর্যশীলদের আল্লাহ পছন্দ করেন

5228ce2dd2a6a-Untitled-8.1[1]

যে গুণাবলি মানুষের জীবনকে সফল ও সার্থক করে তোলার সুযোগ এনে দেয় তার মধ্যে সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যশীলতা বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। শত প্রতিকূল পরিবেশে বিপদাপদ অতিক্রমের সুযোগ দান করে সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতা। এই বিশেষ গুণটির সামনে অন্যায়-অনাচার মাথা নিচু করে। ফলে সহিষ্ণু ব্যক্তি স্বীয় গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। সহিষ্ণুতা জীবন বিকাশের প্রবল বাধাকে অনুকূলে নিয়ে আসে, বিজয়ী ঘোষণা করে সহনশীল মানুষকে।
সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্য : সহিষ্ণুতা বা সবর বলতে বুঝায় সংযম অবলম্বন ও নফসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ। সহ্য করার বৈশিষ্ট্যের নাম সহিষ্ণুতা। নিজের মনোভাবের সাথে ঐকমত্য সৃষ্টি করে না এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে নিজের ক্ষমতা ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করে নম্রতা ও সৌজন্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করাই সহিষ্ণুতা বা ধৈর্যশীলতা। যেকোনো পরিস্থিতির সামনে সহনশীল মনোভাব প্রদর্শনের মধ্যেই এ গুণের স্বরূপ প্রকাশ পায়। কোনো বিষয়ে অন্যের সম্মুখীন হলে প্রতিপক্ষের উগ্র মনোভাব, আক্রমণাত্মক আচরণ ও উসকানিমূলক মনোবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে সংযত করে রাখাই সহিষ্ণুতা ধৈর্যধারণের সাথে সম্পৃক্ত। স্থিরভাবে গ্রহণ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিক। সহনশীল হয়ে ঘটনার কল্যাণকর পরিণতি প্রত্যাশা করার মধ্যে সহিষ্ণুতার যথার্থ পরিচয় প্রকাশ পায়। সহিষ্ণুতা গুণসম্পন্ন মানুষ কখনো বিরোধকে প্রবল করে তোলে না। ধৈর্যধারণকারী মানুষ নিজের সমূহ ক্ষতি স্বীকার করে অন্যকে হাসিমুখে মোকাবিলা করে। নিজের শক্তি-সামর্থ্য থাকলেও সে অপরের ওপর প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে না তার মধ্যে সহিষ্ণুতা গুণ বিদ্যমান বলে বিবেচনা করা চলে। অপরের ঔদ্ধত্যকে যে ব্যক্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করে সে ব্যক্তি যথার্থ ধৈর্যশীল বলে মর্যাদা পায়। এভাবে সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ধৈর্য, ক্ষমা ও মহত্বের পরিচয় মেলে।
সহিষ্ণুতা বা সবরের শাখাগুলো : পবিত্র কুরআন ও হাদিসের পরিভাষায় সবরের তিনটি শাখা রয়েছে : এক. নফসকে হারাম এবং নাজায়েজ বিষয়াদী থেকে বিরত রাখা। দুই. ইবাদত ও আনুগত্যে বাধ্য করা এবং তিন. যে কোনো বিপদ ও সঙ্কটে ধৈর্য ধারণ করা। অর্থাৎ যে সব বিপদাপদ এসে উপস্থিত হয় সেগুলোকে আল্লাহর বিধান বলে মেনে নেয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা করে। অবশ্য কষ্টে পড়ে যদি মুখ থেকে কোনো কাতর শব্দ উচ্চারিত হয়ে যায়, কিংবা অন্যের কাছে তা প্রকাশ করা হয়, তবে তা সবরের পরিপন্থী নয়। (ইবনে কাসীর)। সবরের ্উপরিউক্ত তিনটি শাখাই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কুরআন-হাদিসের পরিভাষায় ধৈর্যধারণকারী বা ‘সাবের’ সে সব লোককেই বলা হয়, যারা উপরিউক্ত তিন প্রকারেরই সবরের অবলম্বন করে। মুসলিম দার্শনিকদের কেউ কেউ মনে করেন সবর বা সহিষ্ণুতা দু’প্রকার : (ক) দৈহিক, যেমন শারীরিক পীড়া সহ্য করা, প্রত্যক্ষই হোক, যেমন কষ্টসাধ্য কাজ সমাধা করা কিংবা পরোক্ষই হোক, যেমন আঘাত সহ্য করা ইত্যাদি। এ প্রকারের ধৈর্য প্রশংসযোগ্য। (খ) আত্মিক : এটা হলো প্রবৃত্তির তাড়নাকে সংযতকরণ।
সবরের শক্তির তারতম্য ভেদে মানুষকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায় : (ক) অতি অল্প সংখ্যক, যাদের মধ্যে সবর স্থায়ী গুণ হিসেবে অবস্থিত, তারা সিদ্দিকুন ও মুকাররাবুন নামে অভিহিত; (খ) যাদের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি অধিক শক্তিশালী এবং (গ) যাদের দু’টি পরস্পরবিরোধী বাসনা অনবরত সংগ্রামে লিপ্ত, এরা মুজাহিদুন নামে অভিহিত। সহিষ্ণুতার প্রয়োজনীয়তা : মানব জীবনে সহিষ্ণুতার প্রয়োজনের শেষ নেই। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। সমাজের সব মানুষ এক রকম নয়। সামাজিক জীবনে পরস্পরের মধ্যে নানা কারণে বিরোধিতা দেখা দেয়। এই বিরোধ সহজেই প্রবল আকার ধারণ করতে পারে এবং তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এই ধরনের সঙ্কটজনক পরিস্থিতির ক্ষতিকর পরিণাম থেকে অব্যাহতি লাভের দরকার সহিষ্ণুতার মত মহৎ গুণের। সমাজের মধ্যে নানা ধরনের লোক বসবাস করে। সবার রুচি ও মনমানসিকতা এক রকম নয়। ফলে পারস্পরিক বিরোধ এবং প্রতিহিংসার সৃষ্টি সাধারণ ব্যাপার। এই পরিস্থিতির কল্যাণকর সমাধানের জন্য সহিষ্ণুতার প্রয়োজন। মানুষের ব্যক্তিজীবনে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। সেখানে অনেক প্রতিপক্ষ থাকে। তাদের কাছে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে মন জয় করা যায়। মতবিরোধ এড়িয়ে সদিচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারলে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব।
সহিষ্ণুতার মহৎ গুণটি এখানে বিশেষ অর্থবহ ভূমিকা পালন করে। সামাজিক জীবনের মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহনশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। পরস্পর বিরোধ এড়িয়ে প্রতিপক্ষকে শত্রু বলে বিবেচনা না করে সহযোগিতার মাধ্যমে কাজকর্ম চালিয়ে গেলে সেখানে সহিষ্ণুতার নিদর্শন মেলে। সব কাজের শুভ পরিণতি আনয়নে সহিষ্ণুতা সাহায্য করে। যোগ্যতা দিয়ে মানুষ সমাজে টিকে থাকে। সে যোগ্যতা প্রদর্শন ও তার ফল হাতে না আসা পর্যন্ত ধৈর্য অপেক্ষা করতে হবে। উগ্র প্রতিপক্ষকে শক্তির সাহায্যে করার ধৈর্য ধারণ করার মাধ্যমে পরাভূত করা সহজ। জীবনের প্রতিকূল অবস্থায় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে পারলে দুঃখ, কষ্ট ও মনোবেদনা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তাই জীবনে সহিষ্ণুতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। অসহিষ্ণু সমাজ : বিশ্বের বুকে মানুষ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত। ক্ষুদ্র গৃহকোণ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতবিরোধ বিরাজমান। মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষ চিরন্তন। সংসারের একান্ত আপন জনের মধ্যেও অনেক সময় বিরোধ প্রবল হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় তিক্ততার। সমাজে বিরোধের ফলে চরম অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো শক্তির মত্ততা দেখিয়ে বিরোধ জিইয়ে রেখেছে। যুদ্ধবিগ্রহ সেখানে সাধারণ ব্যাপার। সারা বিশ্ব জুড়ে সর্বস্তরে যে অশান্তির খেলা চলছে তা অসহিষ্ণু মনোভাবের পরিণতি। মানুষ ধৈর্যশীল নয়। নিজের ক্ষতি স্বীকার করতে কেউ সহজে রাজি হয় না। কেউ নিজের গৌরবকে গুরুত্বহীন বলে বিবেচনা করতে নারাজ। ক্ষমতাদ্বন্দ্বে আজ বিশ্বের বুকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষ নেই। ধৈর্যহীনতার এ পরিস্থিতিকে সামাল দিতে না পারলে পৃথিবী অচিরেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পারস্পরিক সহিষ্ণুতার মাধ্যমে এ সঙ্কটের অবসান ঘটতে পারে। সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত : সহিষ্ণুতার মাধ্যমে বিশ্বের অনেক বড় কাজ সাধিত হয়েছে। অনেক সঙ্কট থেকে উদ্ধারের উপায় নির্দেশ করেছে সহিষ্ণুতা। বিশ্বের মহামানবগণ নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন সহিষ্ণুতার মাধ্যমে।
বিশ্বের যা কিছু আবিষ্কার, দুঃসাহসিক অভিযান সবই সহিষ্ণুতার ফল। সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সব মূল্যবান অবদানের সৃষ্টি হয়েছে তা সহিষ্ণুতার সুফল। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত মুহাম্মদ সা: অপরিসীম সহিষ্ণুতা ও ধৈর্যের মাধ্যমে সত্য ধর্ম ইসলামের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। শত্রুর আঘাতে তাঁর দেহ থেকে রক্তপাত হয়েছে। জীবন হয়েছে সঙ্কটাপন্ন, তবু মানবদরদী মহামানব শত্রুকে অভিশাপ দেননি, বরং তাদের ক্ষমা করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার সীমাহীন ধৈর্যের ফলে তিনি সত্য প্রচারে সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করে গেছেন। বিশ্বের মহামনীষীদের সহিষ্ণুতার আদর্শ মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। সহিষ্ণুতার অনুশীলন : জীবনকে সুন্দর, সার্থক ও মহৎ করার জন্য সহিষ্ণুতার ব্যাপক অনুশীলন করা দরকার। সহিষ্ণুতার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই হওয়া উচিত। পিতামাতার কাছ থেকেই শিশুরা সহিষ্ণুতা শিক্ষা লাভ করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত পাঠের অনুশীলনের সাথে সাথে সহিষ্ণুতার শিক্ষার সুযোগ রাখতে হবে। মনের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে সহিষ্ণুতার অনুশীলন করতে হবে। অসহিষ্ণু হওয়ার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং সহিষ্ণুতা সম্পর্কে তৎপর হতে হবে। মহাপুরুষদের জীবন ও সাধনা থেকে সহিষ্ণুতার সুফল সম্পর্কে জানা যায়।
সহিষ্ণুতার প্রতিদান : মহান আল্লাহর বাণী : ‘আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১৫৪)। এ কথা মনে রেখে এর কল্যাণকর দিক সম্পর্কে বিশেষ সচেতন হতে হবে। হাশরের ময়দানে ঘোষণা করা হবে, ধৈর্যধারীরা কোথায়? এ কথা শোনার সাথে সাথে সেসব লোক উঠে দাঁড়াবে, যারা উপরিউক্ত তিন প্রকারেই সবর করে জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। এ সব লোককে প্রথমে বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে। (ইবনে কাসীর)। পবিত্র কুরআনে আরো ঘোষণা করা হয়েছে : ‘সবরকারী বান্দাহদেরকে তাদের পুরস্কার বিনা হিসেবে প্রদান করা হবে’। (সূরা আয-যুমার : ১০)। রাসূল সা: বলেন, ‘মুমিনের অন্তর কতই না চমৎকার! ভালোমন্দ সব অবস্থাকেই সে তার জন্য উত্তম মনে করে।’ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে সে কৃতজ্ঞচিত্তÑএটা তার উত্তম হওয়ার প্রমাণ; আবার যখন সে কষ্টের সম্মুখীন হয়, তখন ধৈর্যের সাথে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করে; এটাও তার জন্য উত্তম হওয়ার প্রমাণ।’ উপসংহার : সংসার জীবনে সঙ্কটের মুখোমুখি হয়ে মানুষ যদি ধৈর্যহারা না হয়ে সব কাজ-কর্মে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে পারে তবে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছা সহজ হবে। সহিষ্ণু হলে জীবনে যে সাফল্য আসে তার প্রভাব চারপাশের জীবনে সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য সহিষ্ণুতার পথ অনুসরণ করতে হবে। জীবনকে সুন্দর ও সফলকাম করার যে সাধনায় মানুষ নিজেকে সমর্পণ করেছে তা সফলকাম করার জন্য সহিষ্ণুতাকে উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে জীবন হয়ে উঠবে। সমাপ্ত

Related Post