মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা জানাই যে, তিনি আমাকে পৃথিবীর প্রথম ঘর তথা কা‘বা ও রাসূলের শহরে যিয়ারতের সুযোগ করে দিলেন। সত্যি যতবারই কা‘বা যিয়ারত করেছি, ততবারই মুগ্ধ হয়েছি, আর হৃদয়ে স্পন্দনে বারবার যিয়ারত করার আকাঙ্খা তৈরি হতে থাকে। এই স্পৃহা যেন শেষ হবার নয়। যে ঘরকে যিয়ারত করে ধন্য হচ্ছে প্রতিদিন সারা পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ।
যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) স্বীয় পুত্র ইসমাইল (আ.)কে নিয়ে কা‘বা ঘর নির্মাণ শেষ করেন, তখন মহান আল্লাহ তাঁকে বললেন: “এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে। (সূরা হজ্জ: ২৭)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেজ আল্লামা ইমামুদ্দীন ইবনে কাসীর (রহ.) স্বীয় তাফসীর ইবনে কাসীরে লিখেন; যেই মহান সত্ত্বা তোমাকে এই পবিত্র ঘর নির্মাণ করার নির্দেশ দিলেন, সেই ঘরের দিকে হজ্জ করার জন্য মানুষকে আহ্বান করো। তখন ইবরাহীম (আ.) বললেন, হে আমার রব! কিভাবে সারা পৃথিবীর মানুষকে হজ্জের জন্য আহ্বান করবো, আমার কণ্ঠের শব্দ তো সবাই শুনবে না। তখন বলা হলো, তোমার দায়িত্ব হলো, আহ্বান করা আর আমার দায়িত্ব তা পৌঁছানো। তখন হযরত ইবরাহীম (আ.) তার মাকামে উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘোষণা করলেন, “হে লোক সকল! তোমাদের রব তোমাদের জন্য ঘর নির্মাণ করেছেন, সুতরাং তোমরা সেখানে এসে হজ্জ করো। তখন মক্কার চতুর্পাশের পাহাড়গুলো নিম্নমুখী হয়েছিলো, ফলে তাঁর কণ্ঠের শব্দ পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছিলো। এমনকি যারা মায়ের গর্ভে অথবা পিতার পৃষ্ঠে বা রূহ জগতে ছিলো সকলে শুনতে পেয়েছে, যারা এই আহ্বান শুনে লাব্বাইক বলেছে, তারাই কিয়ামত পর্যন্ত এই বায়তুল্লাহর যিয়ারত করে হচ্ছে।
ইসলামে মর্যাদাবান তিনটি স্থান, ক) পবিত্র মক্কা নগরী বা কা‘বা, খ) রাসূলের শহর মদীনা, গ) মসজিদুল আকসা। এই পবিত্র ভূমিগুলো নিয়েও ষড়যন্ত্র কম হয়নি এবং তা আজও অব্যাহত রয়েছে। অভিশপ্ত ইহুদীদের কবলে আজও বাইতুল মাকদিস বা মসজিদে আকসা করারুদ্ধ। যাকে মুক্ত করার জন্য ফিলিস্তিনের মুসলমানগণ লড়ে যাচ্ছে প্রতি নিয়ত।
আর রাসূলের জন্মের প্রায় ৫০ দিন আগে ইয়ামেনী গভর্ণর আবরাহা বায়তুল্লাহকে ধ্বংস করতে এসে ৬০ হাজার সৈন্যসহ নিজেই ধ্বংস হয়ে যায়। আব্দুল মুত্তালিবের ভাষায় ঘরের মালিক তাঁর ঘর হেফাযত করবেন। হয়েছেও তাই। এসব বাস্তব উদাহরণ থাকার পরও বায়তুল্লাহকে নিজেদের স্বার্থে দখল করতে চায় শিয়া সম্প্রদায়রা। তারা বিভিন্ন হাঙ্গামা তৈরী করে বায়তুল্লাহর কর্তৃত্ব দলখ করতে চায়। আল্লাহ তার ঘরকে জালেমদের হাত থেকে তিনি নিজেই রক্ষা করবেন। তাছাড়া বিশ্বময় ইসলামের শত্রুরাও বায়তুল্লাহকে অসম্মান করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে বলতে চাই, তোমরা যতই আল্লাহর ঘর কাবা নিয়ে হিংসায় যতই জ্বলে পুড়ে মর না কেন? তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। বরং দিন দিন বায়তুল্লাহর প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েই চলছে। সার বছরই হজ্জের ভিরের মত ভির কাবা ঘরে লেগেই আছে। নাস্তিকদের বলতে চাই আর বিরোধিতা নয়, সঠিক পথের সন্ধান করুন, আল্লাহ হয়ত হেদায়াত নসীব করতেও পারেন। যারাই বায়তুল্লাহ নিয়ে কটুক্তি করেছে, তারাই ধ্বংস হয়েছে। এমন হাজারো উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান।
অপর দিকে রাসূল কারীম (সা.)-এর জীবদ্দশায়ও ইহুদীরা শান্তিতে থাকতে দেয়নি। এমনকি রাসূলের ইন্তেকালের পরও চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। হিজরী ৫৫৭ সালের একরাতের ঘটনা। সুলতান নূরুদ্দীন জাঙ্কি (রহ.) তাহাজ্জুদ ও দীর্ঘ মুনাজাতের পর ঘুমিয়ে পড়েছেন। চারিদিক নিরব নিস্তব্দ। কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। এমতাবস্থায় হঠাৎ তিনি স্বপ্নে দেখলেন স্বয়ং রাসূল (সা.) তার কামরায় উপস্থিত। তিনি কোন ভূমিকা ছাড়াই দু’জন নীল চক্ষু বিশিষ্ট লোকের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, (নূরুদ্দীন) মাহমূদ! (এরা আমাকে বিরক্ত করছে), এ দুজন থেকে আমাকে মুক্ত কর।
এই ভয়াবহ স্বপ্ন দেখে নূরুদ্দীন জাঙ্কি (র:) অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গোটা কক্ষময় পায়চারি করতে লাগলেন। সাথে সাথে তার মাথায় বিভিন্ন প্রকার চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। হৃদয় রাজ্যে ভীড় জমাল হাজারও রকমের প্রশ্ন। তিনি ভাবলেন-
আল্লাহর রাসূল তো এখন কবরের জীবনে! তার সাথে অভিশপ্ত ইহুদীরা এমন কী ষড়যন্ত্র করতে পারে? কী হতে পারে তাদের চক্রান্তের স্বরুপ? তারা কি রাসূল (স)-এর কোন ক্ষতি করতে চায়? চায় কি পর জীবনেও তার সাথে ষড়যন্ত্র লিপ্ত হতে? আমাকে দু’জন ইহুদীর চেহারা দেখানো হল কেন? শয়তান তো আল্লাহর নবীর অবয়বে আসতে পারে না। তাহলে কি আমি সত্য স্বপ্ন দেখেছি?
নূরুদ্দীন জাঙ্কি (রহ.) জুমুয়ার খোৎবা দান করলেন এবং ঘোষণা দিলেন, “আমি মদিনাবাসীকে দাওয়াত দিয়ে এক বেলা খানা খাওয়াতে চাই। আমার অভিলাষ, সকলেই যেন এই দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করে।”
সুলতান মদিনাবাসীকে আপ্যায়নের জন্য বিশাল আয়োজন করলেন এবং প্রত্যেকের নিকট অনুরোধ করলেন, মদিনার কোন লোক যেন এই দাওয়াত থেকে বঞ্চিত না হয়। স্বপ্নে দেখানো নীল বর্ণের চোখ বিশিষ্ট দুজন দাওয়াত গ্রহণ হতে বিরত ছিলো। এই বিরত থাকাটাই সুলতানের নিকট প্রতিস্ফুটিত হলো, যে এরাই কুচক্রি ইহুদী। তাই তিনি তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত করেন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেন। এবং রাসূলের রওজার চতুর্পাশে সীসা দিয়ে প্রাচীর নির্মাণ করেন। ঘটনাতি বিস্তারিত জানতে পাঠ করুন:
বিশ্বনবীর লাশ চুরি ও ইহুদী চক্রান্ত” লেখক: জিল্লুর রহমান নাদভী । এছাড়াও এই ঘটনাটা পাবেনঃ “রওজা শরীফের ইতিকথা লেখক মুহিউদ্দিন খান (সম্পাদক, মাসিক মদীনা)। আল্লাহ আমাদেরকে রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করে জীবন গড়ার তাওফীক দান করুন। আমীন