হজ্জের গুরুত্ব ও বদলি হজ

হজ : বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববন্ধনের প্রতীক

হজ : বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববন্ধনের প্রতীক

হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম বিধান। মুসলিম উম্মাহর সম্পদশালী লোকদের ওপর এ বিধান অবশ্য পালনীয়। ইরশাদ হচ্ছেوَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
মানুষের মধ্যে যারা কাবা শরীফ পৌঁছুতে সক্ষম তাদের ওপর আল্লাহর ঘর জিয়ারত করা ফরজ (সূরা আলে ইমরান, ৯৭)। এ বিধান অমান্যকারীদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা: কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে পৌঁছুতে সম্পদ ও সওয়ারির মালিক হলো, তা সত্ত্বেও সে হজ করল না, সে ইহুদি বা খ্রিষ্টান হয়ে মরুক তাতে কিছু যায় আসে না। (তিরমিজি : ১-১৬৭)।
আরেক হাদিসে আছে ধনসম্পদ থাকতেও যে তার হক আদায় করল না কিয়ামতের দিন এ ধনসম্পদ বিরাটাকার সাপ হয়ে তার গলায় ঝুলবে। (সহিহ মুসলিম : ১-৩২০), যার ওপর হজ ফরজ হওয়া সত্ত্বেও সে হজ করল না এমন ব্যক্তিকে ইহুদি বা খ্রিষ্টানের সাথে উপমা দেয়ার হিকমত হলো হজ হচ্ছে মিল্লাতে ইব্রাহিমের একটি অন্যতম প্রতীক, আর ইহুদি-খ্রিষ্টানরা নামাজ তো পড়ত তবে হজ করত না। যার কারণে হজ বর্জনকারীকে তাদের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। তাদের বিপরীতে মুশরিকরা হজ করত কিন্তু নামাজ পড়ত না। এ কারণে একটি বর্ণনায় নামাজ ত্যাগকারীকে কাফির ও মুশরিকদের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। (কানযুল উম্মাহ : ৭-২৩০),
এ ছাড়া হজ ফরজ হওয়ার পর যে ব্যক্তি হজ পালন করে না তার সম্পর্কে অন্যান্য হাদিসে কঠোর ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, যা একজন মুমিনের জন্য মোটেই কাম্য হতে পারে না। আর যদি এমন সামর্থ্যবান ব্যক্তি তথা যার কাছে কামাই রোজগারের সরঞ্জামাদি ও ঋণ বাদ দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মক্কা শরীফ যাতায়াতের খরচ এবং ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের খরচ পরিমাণ সম্পদ আছে, তবে সে শারীরিকভাবে অক্ষম বৃদ্ধ বা অসুস্থতাজনিত কারণে কিংবা হজ আদায় করার সময় পাওয়া সত্ত্বেও তা আদায় করেনি এবং পরে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে এমন ব্যক্তির ওপরই অন্যের দ্বারা বদলি হজ করানো ফরজ, তেমনি কোনো ধনী মহিলা শেষ জীবন পর্যন্ত অপেক্ষা করেও মাহরাম সফর সঙ্গীর ব্যবস্থা করতে পারল না তার জন্যও বদলি হজ করানো ওয়াজিব,
বদলি হজের ব্যাপারে আরেকটু বিশ্লেষণে গেলে বলতে হয় ইবাদতের তিনটি সুরত রয়েছে ১. দৈহিক ইবাদত যেমন নামাজ ২. আর্থিক ইবাদত যেমন জাকাত, ৩. সংযুক্ত তথা অর্থ ও দেহের সমন্বিত ইবাদত যেমন হজ। উম্মতের সব উলামা, মুহাদ্দিসিন, ও ফুকাহাকেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, যে ইবাদতে শুধু দেহের খরচ হয় তাতে প্রতিনিধি চলবে না। আর যে ইবাদতে অর্থের খরচ হয় তাতে অন্যকে নিয়োগ প্রদান করা যায়। এমনিভাবে যে ইবাদত অর্থ ও দেহের সমন্বিত রূপ তাতে শুধু সে ব্যক্তিই অন্যকে নিয়োগের মাধ্যমে তার ইবাদত আদায় করাতে পারবে, যে দৈহিকভাবে অক্ষম কিংবা প্রথমে সুস্থ ছিল পরে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তা করানো তার ওপর ফরজও বটে। কেননা এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত ফরজ আদায় না করায় সে গোনাহগার এবং এর জন্য শাস্তিও পেতে পারে। এ কারণে জীবিত থাকলে জীবদ্দশায় করিয়ে যাবে বা মৃত্যুর পরে করানোর জন্য অসিয়ত করে যাবে।অসিয়ত করে গেলে মৃতের সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ দ্বারা উত্তরাধিকারদের ওপর তার এ অসিয়তকৃত হজ আদায় করা অত্যাবশ্যকীয়, আর যদি মৃত ব্যক্তি অসিয়ত করে না যায় তবে উত্তরাধিকারদের ওপর আবশ্যকীয় না হলেও তাদের উচিত তার পক্ষ থেকে আদায় করে দেয়া। এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির গোনাহের কাফফারার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। হজরত ইবনে’ আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, বিদায় হজের সময় এক মহিলা এসে রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করল আমার মা হজ করার ইচ্ছা করেছেন। কিন্তু জীবদ্দশায় হজ আদায় করে যেতে পারেননি। আমি তার পক্ষ থেকে আদায় করতে পারব? রাসূল সা: বললেন, যদি তোমার মায়ের কাছে অন্য কেউ কোনো ঋণ পেতো তাহলে কি তুমি তা আদায় করতে না? আল্লাহর ঋণ আদায় করে দাও। আল্লাহর ঋণ আদায়ই সর্বাধিক অধিকার রাখে’ (সহিহ বুখারি : ১-২৫০)।
হজরত আবু রাজিন উকাইলী (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করেছেন আমার পিতা বয়োবৃদ্ধ, তার ওপর হজ ফরজ হয়েছে, কিন্তু তিনি না হজ পালন করতে পারবেন, না উমরা এবং তিনি সফর করতেও পারছেন না। রাসূল সা: বললেন তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ ও উমরা আদায় করে দাও।’ (তিরমিযী : ১-১৮৬)।
বদলি হজ কিভাবে করাবেন : যিনি বদলি হজ করাচ্ছেন, হজের সফরের প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যয়ভার তিনি বহন করবেন। নফল হজ করাতে হলে যেখানে থেকে ইচ্ছা সে স্থান হতেই করানো যায়। কিন্তু ফরজ হজ বদলি করাতে হলে যার হজ তার বাড়ি থেকে পূর্ণ খরচ দিয়ে করাতে হবে। বদলি হজের জন্য যে টাকা-পয়সা দেয়া হবে, তা ব্যয়ের ব্যাপারে বদলি হজকারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণসহ তার ইচ্ছামত যেভাবে ও যেখানে প্রয়োজন ব্যয় করার সাধারণ অনুমতি দিয়ে রাখা উচিত, যাতে তাকে আর্থিক দুর্ভাবনায় পড়তে না হয়, তবে তাকে সে টাকার মালিক করে দেয়া যাবে না। অন্যথায় প্রেরণকারীর হজ কবুল হবে না, বদলি হজ আদায়কারীকে এ পরিমাণ অর্থ দেয়া উচিত, যা আদেশদাতার অবস্থান থেকে মক্কা মুকাররমা পর্যন্ত মধ্যমভাবে আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়ার জন্য যথেষ্ট হতে পারে, যাতে ব্যয় সঙ্কোচন কিংবা অপব্যয় কোনোটারই সুযোগ না থাকে।
কেমন ব্যক্তিকে দিয়ে বদলি হজ করানো যায় : এমন ব্যক্তিকে দিয়ে বদলি হজ করানো উত্তম যিনি আমলদার আলেম ও মাসআলা, মাসায়েল সম্পর্কে অবগত এবং নিজের ফরজ হজ পূর্বে আদায় করেছেন, তবে আলেম নয় অথচ ইতঃপূর্বে হজ পালন করেছেন, হজের মাসআলা সম্পর্কে ভালো ও স্পষ্ট জ্ঞান রাখেন এবং খোদা ভীরু ও আমানতদার এমন ব্যক্তিকে দিয়েও বদলি হজ করানো যেতে পারে, আর যে ব্যক্তি নিজের হজ করেননি এরূপ ব্যক্তির দ্বারা হজ করানো সম্পর্কে ইমামদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও হানাফি মাজহাব অনুসারে তা আদায় হয়ে যাবে মাকরুহের সাথে।

Related Post