কদর রজনী কখন? কিভাবে বুঝবো? কী কী আমল করবো?

মাওলানা মামুনুর রশীদ, খতীব ওজারাতুল আওকাফ কুয়েত, সম্পাদক মাসিক আল-হুদা

মাওলানা মামুনুর রশীদ, খতীব ওজারাতুল আওকাফ কুয়েত, সম্পাদক মাসিক আল-হুদা

মাওলানা মামুনুর রশীদ, খতীব ওজারাতুল আওকাফ কুয়েত, সম্পাদক মাসিক আল-হুদা

পবিত্র রমযান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো, শেষ তৃতীয়াংশ তথা শেষ দশ দিন।

হাদীসগ্রন্থগুলোতে রমযানের শেষ দশকের অনেক ফযীলত ও  বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

  এ দশ দিনের মাঝে রয়েছে লাইলাতুল কদর নামের একটি রাত। এ রাতে ইবাদত করলে বিগত জীবনের যাবতীয় গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিবেন: রাসূল (সা.) বলেন:

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

যে এ রাতে ঈমান ও ইহতিসাবের (সাওয়াবের আশা নিয়ে) সাথে ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অতীতের পাপগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

এরাতে ইবাদত করলে, হাজার মাসের সাওয়াবের চেয়েও বেশি সাওয়াব দান করা হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন: কদর রজনী হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। (সূরা কদর: ৩)

রমযানের শেষ দশকের ইবাদত করার মূল উদ্দেশ্যই হলো কদর রজনী লাভ করা। তাই আরব বিশ্বে শেষ দশকে প্রতি রাতে এ নামায আদায় করা হয়ে। ২০ রমযানের রাত থেকে সকল মসজিদে কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদের নামায শুরু হয়েছে। মুসল্লীগণ খুশু ও খুযু তথা একাগ্রতা ও বিনয়ের সাথে এ নামায আদায় করেন। এই নামায প্রায় ২ ঘন্টা ব্যাপী সময় নিয়ে পড়া হয়।

লাইলাতুল কদর কখন ?

আল-কুরআনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি লাইলাতুল কদর কোন রাতে। তবে কুরআনের ভাষ্য হল লাইলাতুল কদর রমযান মাসে। কিয়ামত পর্যন্ত রমযান মাসে লাইলাতুল কদর অব্যাহত থাকবে। এবং এ রজনী রমযানের শেষ দশকে হবে বলে সহীহ হাদীসে এসেছে। আর তা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে হাদীসে এসেছে-

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا، أنَّ النَّبِيَّ صلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِيْ الْوَتْر مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ  رواه البخاريُّ (2017)

‘তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোর রাতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।’(বুখারী)

এবং রমযানের শেষ সাত দিনে লাইলাতুল কদর থাকার সম্ভাবনা অধিকতর। যেমন হাদীসে এসেছে-

الْتَمِسوها في السَبع الأواخِرِ رواه البخاريُّ (6991) واللَّفظ له، ومسلم (1165)

‘যে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করতে চায় সে যেন শেষ সাত দিনে অন্বেষণ করে। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)

অধিকতর সম্ভাবনার দিক দিয়ে

প্রথম হল: রমযান মাসের সাতাশ তারিখ।

দ্বিতীয় হল: পঁচিশ তারিখ।

তৃতীয় হল: ঊনত্রিশ তারিখ।

চতুর্থ হল: একুশ তারিখ।

পঞ্চম হল: তেইশ তারিখ।

এ রাতকে গোপন রাখার কারণ

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করে। তিনি দেখতে চান এর বরকত ও ফযীলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালাতে পারে।

 কদর রজনীতের আমরা কি করবো?

১। এ রাতে বেশি বেশি করে দোয়া করা: আয়েশা (রাঃ) নবী করিম (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, লাইলাতুল কদরে আমি কি দোয়া করতে পারি? তিনি বললেন, বলবে—

اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عنى 

‘হে আল্লাহ ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (বর্ণনায় : তিরমিজি)

শেষ দশকের রাতগুলোর জাগার উদ্দেশ্য লাইতুল কদরের সন্ধান করা। আর আল্লাহ তা`আলার অশেষ অনুগ্রহ যে তিনি লাইতুল কদরকে রমযানের শেষ দশকে লুকিয়ে রেখেছেন। যদি সারা বছরের যে কোনো রাতে তা সুপ্ত রাখা হত তাহলে এর সন্ধান পাওয়া অনেক দুষ্কর হত এবং অধিকাংশের ভাগ্যেই লাইলাতুল কদর জুটত না।

 কদর রজনী চেনার কিছু আলামত বা লক্ষ্যণ: আর  সেগুলো হল :

  • রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
  • নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
  • মৃদু-মন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
  • সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
  • কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।
  • ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।

 সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।(সহীহ বুখারী, মুসলিম, ইবনু খুযাইমাহ)

মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরে আমরা কী কী ইবাদত করতে পারি?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে এ রাত কাটাতেন এর পূর্ণ অনুসরণ করাই হবে আমাদের প্রধান টার্গেট। এ লক্ষ্যে আমাদের নিম্নবর্ণিত কাজগুলো করা আবশ্যক :

  • নিজে রাত জেগে ইবাদত করা এবং নিজের অধীনস্ত ও অন্যান্যদেরকেও জাগিয়ে ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করা।
  • লম্বা সময় নিয়ে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পড়া। এসব নামাজে কিরাআত ও রুকু-সিজদা লম্বা করা। রুকু থেকে উঠে এবং দুই সিজদায় মধ্যে আরো একটু বেশি সময় অতিবাহিত করা, এসময় কিছু দু’আ আছে সেগুলে পড়া।
  • সিজদার মধ্যে তাসবীহ পাঠ শেষে দু’আ করা। কেননা সিজদাবনত অবস্থায় মানুষ তার রবের সবচেয়ে নিকটে চলে যায়। ফলে তখন দু’আ কবুল হয়।
  • বেশি বেশি তাওবা করবে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়বে। ছগীরা কবীরা গোনাহ থেকে মাফ চাইবে। বেশি করে শিরকী গোনাহ থেকে খালেছ ভাবে তাওবা করবে। কারণ ইতোপূর্বে কোন শিরক করে থাকলে নেক আমল তো কবুল হবেই না, বরং অর্জিত অন্য ভাল আমলও বরবাদ হয়ে যাবে। ফলে হয়ে যাবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
  • কুরআন তিলাওয়াত করবে। অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ কুরআন অধ্যয়নও করতে পারেন। তাসবীহ তাহলীল ও যিকির-আযকার করবেন। তবে যিকির করবেন চুপিসারে, নিরবে ও একাকী এবং কোন প্রকার জোরে আওয়ায করা ছাড়া। এভাবে যিকির করার জন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন :

وَاذْكُر رَّبَّكَ فِي نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَخِيفَةً وَدُونَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ الْغَافِلِينَ ﴿٢٠٥﴾

সকাল ও সন্ধ্যায় তোমার রবের যিকির কর মনে মনে বিনয়ের সঙ্গে ভয়ভীতি সহকারে এবং জোরে আওয়াজ না করে। এবং কখনো তোমরা আল্লাহর যিকির ও স্মরণ থেকে উদাসীন হয়োনা। (সূরা আরাফ-২০৫)

  • একাগ্রচিত্তে দু’আ করা। বেশি বেশি ও বার বার দু’আ করা। আর এসব দু’আ হবে একাকী ও বিনম্র চিত্তে কবুল হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে। দু’আ করবেন নিজের ও আপনজনদের জন্য, জীবিত ও মৃতদের জন্য, পাপমোচন ও রহমত লাভের জন্য, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির জন্য। তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে নিম্নের এ দু’আটি বেশি বেশি করার জন্য উতসাহিত করেছেন :

اللهم إِنَّكَ عُفُوٌّ كَرِيمٌ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي

হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমার আধার, আর ক্ষমা করাকে তুমি ভালবাস। কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযী)

মহান আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা, তিনি যেন আমাদের সকলকে এই মহিমান্বিত রাতের ফযীলত লাভে ধন্য করেন। আমীন।

Related Post