মাওলানা সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে বললেন, আমি একজন মুসলমান। ইসলাম সম্পর্কে সব কিছু তো আমিও জানি না। কিন্তু কিছু জানার চেষ্টা করেছি আমি। আমার মন চায় ইসলাম সম্পর্কে কিছু কথা আমি আপনাকে বলি এবং ইসলাম সম্পর্কে কোন খটকা কিংবা প্রশ্ন আপনার মনে জাগে অথবা আপনার জ্ঞান-বুদ্ধিতে ধরা পড়ে আপনি ইতস্তত না করে নির্দ্বিধায় তা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। ইসলাম সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। কাজেই কী প্রশ্ন করব। ব্যাস, সত্যার্থ প্রকাশে কিছু পড়েছিলাম। কিন্তু সে সব আমার মনে ধরত না। আমি মাওলানা সাহেবকে বললাম, আপনি ইসলাম সম্পর্কে অবশ্যই বলুন এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবন সম্পর্কে যদি বলেন আমার ওপর আপনার বিরাট অনুগ্রহ হবে। মাওলানা সাহেব বলা শুরু করলেন এবং সর্বপ্রথম আমাকে বললেন যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর পরিচয় সম্পর্কে সবচে’ বড় রকমের ভ্রান্ত ধারণা হল লোকে মনে করে যে, তিনি কেবল মুসলমানদের ধর্মগুরু (রসূল)। অথচ কুরআনের জায়গায় জায়গায় এবং হযরত হুমাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বারবার একথা বলেছেন যে, তিনি মসগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহর প্রেরিত আখেরী রসূল (অন্তিম সন্দেষ্টা, সংবাদবাহক)। তিনি যেমন আমার রসূল, তেমনি আপনারও। এখন আমি তাঁর সম্পর্কে যা বলব তা এই মনে করে শুনবে তো বেশি আনন্দ পাবেন। মাওলানা সাহেব যখন একথা বললেন, তখন আমার রাত্রের স্বপ্নের কথা মনে হল এবং আমার এমন লাগল যে, রাত্রে যেসব লোক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন ইনি তাঁদের মধ্যে অবশ্যই ছিলেন এবং সেই সমব্যথী ও সংবেদনশীল সত্তাই ইনি। মাওলানা সাহেব এমন ভালবেসে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবন, মানবতার প্রতি তাঁর দরদ এবং তাদের পথ প্রদর্শনের জন্য সীমাহীন ত্যাগ-তিতীক্ষা ও কুরবানী এবং আপন ও পর শত্র“দের শত্র“তার অবস্থা এমনভাবে বর্ণনা করেন যে, আমি একাধিকবার কেঁদে ফেলি। আনুমানিক দেড় ঘণ্টার সফল এমনভাবে শেষ হয়ে যায় যে, বুঝতেও পারিনি কখন ও কিভাবে তা শেষ হল। বহানা গড় এসে গেলাম। বহালগড় নেমে আমাকে অন্য বাস ধরতে হবে। মাওলানা সাহেব সোনীপথ যাবেন। কিন্তু তিনি টিকিট ছেড়ে আমার সাথেই বহালগড় নামলেন। আমাকে বললেন, শীতকাল। আসুন, আমার সাথে এক কাপ চা পান করুন। আমি রাজী হই এবং সামনের দিকে এক রেস্টুরেন্টের দিকে ইশারা করে বলি, চলুন। কিন্তু মাওলানা সাহেব বলেন, এখানে আমার এক বন্ধুর দোকান আছে। সেখানে গিয়েই চা পান করা যাবে। আমরা সেখানে গিয়ে চা পান করি। আমি মাওলানা সাহেবকে দেখছিলাম আর বাবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম-এর কথা মনে হচ্ছিল। কোন সমব্যথী পেলে কদর করবে। আমি মাওলানা সাহেবকে জিজ্ঞেস করি, আপনার যখন কাউকে মুসলমান বানান তো কী রসম আদায় করেন? তিনি বলেন, ইসলামে কোন রসম বা প্রথা নেই। এই ধর্ম তো এক বাস্তব ধর্ম। ব্যাস দিলের মধ্যে এক খোদাকে সত্য জেনে তাঁকে রাজী-খুশি করার অঙ্গীকারকারী মুসলমান হয়। এরপর আমি বলি, এরপরও তো আপনারা কিছু বলিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, হ্যাঁ, ইসলামের কলেমা আছে। আমরা নিজের মঙ্গল ও সাক্ষী হবার জন্য সেই কলেমা পড়িয়ে থাকি। আমি বলি, আপনি আমাকেও কি সেই কলেমা পড়াতে পারেন? মাওলানা সাহেব বললেন, খুব আগ্রহের সাতে পড়ন : আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মদান ‘আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।” মাওলানা সাহেব এর অর্থও হিন্দীতে আমাকে বলেন ও বলতে বলেন।
আহমদ ভাই! আমি মুখে সেই অবস্থা বর্ণনা করতে পারব না যে, সেই কালেমা পড়ার পর আমি আমার ভেতর কী অনুভব করলাম। মনে হচ্ছিল একজন মানুষ একদম অন্ধকার ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে একেবারে মুক্ত আলো ও বাতাসে এসে গেল এবং ভেতর থেকে না জানি কত রকমের বাঁধন থেকে মুক্ত ও স্বাধীন হয়ে গেল। আমার যখনই সেই অবস্থার কথা স্মরণ হয় তখন আমার ওপর খুশি ও মজার এক নেশা ছেয়ে যায়। ঈমানী নূরের মজা! আল্লাহ! আল্লাহ! দেখুন এখনও আমার শরীরের পশম খাড়া হয়ে গেছে।
প্রশ্ন. মাশাআল্লাহ। আসলে আপনার ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। আপনি ছিলেন সত্যিকারের সত্যানুসন্ধ্যানী। এজন্য আল্লাহ আপনাকে পথ প্রদর্শন করেছেন। এরপর রাই-এর প্রোগ্রামের কী হল?
উত্তর. মাওলানা সাহেব আমাকে অনেক মুবারকবাদ দিলেন এবং আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন। আমার ঠিকানা নিলেন এবং সোনীপথের পথ ধরলেন। তাঁকে সেখানে ভুরা রসূলপুর নামক মুরতাদদের একটি গ্রামে যেতে হবে যারা ১৯৪৭ সালে মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল এবং বংশীয় হিন্দুদের চেয়েও কঠিন হিন্দু হয়ে গিয়েছিল। মাওলানা সাহেবকে আমি বললাম, আপনি আমাকে কোথায় রেখে যাচ্ছেন? এখন তো আমাকেও আপনার সাথে নিতে হবে। মাওলানা সাহেব বললেন, আসলেই আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে বরং থাকতে হবে। কিন্তু আপনার-এর প্রোগ্রামের কী হবে? আমি বললাম, এখন ঐ প্রোগ্রামে শরীক হওয়া কি আমার ভাল লাগবে? মাওলানা সাহেব আমার এই কথায় খুব খুশি হলেন। গেরুয়া কাপড় পরিহিত কপালে তিলক ও ডমরু হাতে আমিও মাওলানা সাহেবের সঙ্গী হলাম এবং আমরা ভূরা রসূলপুর পৌঁছুলাম। মাওলানা সাহেব বললেন, এই এলাকার লোকেরা ইসলাম জানত না। ঈমানের কদর ও কীমত (মর্যাদা ও মূল্য) জানা ছিল না তাদের। এজন্য ১৯৪৭ সালের রায়টের সময় ভয় পেয়ে এরা মুরতাদ (হিন্দু) হয়ে যায়। ছোট্ট বাচ্চার হাতে হীরকখণ্ড থাকলে সে হীরকের মূল্য কী বুঝবে? ধমক দিলে কিংবা ভয় দেখালে সে হীরকখণ্ড দিয়ে দেবে পাথর ভেবে। কিন্তু জহুরীর হাতে সেই হীরকখণ্ড হলে জীবন দিয়ে দেবে কিন্তু হীরকখণ্ড সে কিছুতেই দেবে না। এখন আমাদের ওদেরকে ঈমানের আবশ্যকতা ও এর মূল্য বুঝিয়ে পুনরায় ইসলামে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। ভূরা গ্রামে একটি মসজিদ ছিল। একেবারে বিরান। মাওলানা সাহেব বললেন, এখানে এখন কেবল একঘর গোজর ঘর মুসলমান আছে। অথচ ১৯৪৭ সালের আগে গোটা গ্রাম মাওলা জাট মুসলমানদের ছিল। এখন এই মাওলা জান এমন কঠিন (হিন্দ) হয়ে গেছে যে, কয়েক বছর আগে এখানে একটি তবলীগ জামা’আত এসেছিল। মসজিদে অবস্থান করে। এই বেচারা গোজর মুসলমান তাদেরকে দিয়ে মাওলা জাটদের কাছে নিয়ে যায়। ব্যাস! গোটা গ্রামে হাঙ্গামা দেখা দেয়। ঐ সব মুরতাদ কোর্টে মামলা দায়ের করে এই বলে যে, এরা হাঙ্গামা সৃষ্টির জন্য আমাদের এখানে মোল্লাদের ডেকে এনেছে। মামলা চলল এবং ঐ বেচারা গোজর মুসলমানকে গাশতের রাহবরী করার মূল্য হিসাবে মামলায় প্রায় ২০,০০০ টাকা জরিমানাস্বরূপ আদায় করতে হয়। উত্তর কাশীর ভূমিকম্পের ধাক্কা এখান পর্যন্ত এসেছিল। লোকের মন এতে একটু ভীত ও নরম ছিল। মাওলানা সাহেব মসজিদের ইমাম সাহেবকে বলেন, চেষ্টা-তদবীর করে কিছু দায়িত্বশীল লোককে মসজিদে ডেকে আনুন। তাদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করতে চাই, কথা বলতে চাই। নিদেনপক্ষে কোন বাহানায় লোক আল্লার ঘরে আসুক।
ইমাম সাহেব বললেন, এরা মসজিদে আসবে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মাওলানা সাহেব বললেন, চেষ্টা করে দেখুন। যদি আসে তো ভাল, নইলে প্রধান-এর ঘরে লোকজন ডাকব। আল্লাহ্র কী মর্জি। লোকে মসজিদে এল। মাওলানা সাহেবের আগে আমি কিছু কথা বলার আকাক্সক্ষা জাহির করি। অনুমতি পাবার পর আমি উপস্থিত লোকদের সামনে আমার পরিচয় পেশ করে বলি, আমি ওরাঙ্গিলের এক বিরাট বড় ব্যবসায়ীর ছেলে। এম.এস.সি. করার পর পিএইচডি যখন সম্পন্ন করতে যাচ্ছি তখন বাড়িওয়ালা বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। আমি দুনিয়ার ঝামেলার হাত থেকে বাঁচার জন্য হরিদ্বার আসি। একের পর এক আশ্রয়ে ঘুরতে থাকি। সব আশ্রমই দেখেছি পরে ঋষিকেশ থাকি। সেখানেও বহু আশ্রমে কাটিয়েছি। তের বছর সেখানে কঠোর তপস্য করেছি। হিন্দু ধর্মের এই সব কেন্দ্রে এছাড়া আমি আর কিছু পাই নি লোকে আমাকে শাস্ত্রীজি বলত। এছাড়া শান্তি বলতে কিছু আমি কোথাও পাইনি। মালিকের মেহেরবানী হল। মাওলানা সাহেবের সঙ্গে বড়োত থেকে বহালগড় পর্যন্ত সফর করি। সত্য বলছি, যেই শান্তি আমি এই দেড় ঘণ্টার সফরে ইসলামের কথা শুনে ও কলোম পড়ে পেয়েছি, গত ১৩ বছরে আমি তা পাইনি। আমার ভাইয়েরা! এমন শান্তি ও সত্য ধর্ম ফেলে এই অস্থিরতার মধ্যে আপনরা আবার কেন ফিরে যাচ্ছেন। এই কথা বলতে গিয়ে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আমি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকি। আমার এই সত্য ও ব্যথা ভরা কথার লোকদের ওপর প্রভাব পড়ে এবং সেখানে লোকেরা ইসলামী স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহ প্রকাশ করে বরং এজন্য প্রয়েজনীয় বাঁদাও দেয়। এক্ষেত্রে সর্বাধিক আগ্রহ প্রদর্শন করে গ্রামের প্রধান করণ সিং যিনি সর্বাধিক ইসলাম বিরোধী ছিলেন। মাওলানা সাহেব খুব খুশি হন এবং আামকে মুবারকবাদ পেশ করেন। তিনি বলেন, আপনার ইসলাম ইনশাআল্লাহ জানি না কত লোকের হেদায়োতের মাধ্যম হবে।
প্রশ্ন. এরপর আপনি কোথায় ছিলেন।
উত্তর. মাওলানা সাহেবের সঙ্গে ফুলাত এলাম। কাপড় নামালাম (গেরুয়া বসন ছাড়লাম) টিকি কাটলাম, বেশবাস ও চেহারা-সুরত ঠিক-ঠাক করলাম। এরপর মাওলানা সাহেব চিল্লা দেবার জন্য আমাকে জামা’আতে পাঠিয়ে দিলেন। মথুরা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় চিল্লা লাগাই। আমি আমার ইসলামে খুব খুশি ছিলাম। বারবার আমি শোকরারনা নামায আদায় করতে থাকি। আমার আল্লাহ আমার আশা-আকা´খা পূরণ করেছেন। যখন আমি কোন হিন্দুকে দেখি যে বেচারা পথ না জানার দরুন কুফর ও শির্ক-এর জন্য কী কুরবানী দিচ্ছে তখন আমার ধারণা হয় এতো মুসলমানদের জুলুম। কত লোক প্রতিদিন কুফর ও শির্কের ওপর মারা যেয়ে চিরদিনের তরে দোযখের জ্বালানীনতে পরিণত হচ্ছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই কাজ তো সমগ্র মুসলমানদের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। আমি এ ব্যাপারে খুব ভাবতে থাকি এবং আমার আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। এই দুঃখে আমি ঘুরপাক খেতে থাকি যে, কীভাবে মানুষের কাছে সত্য পৌঁছবে। আমি মথুরা মারকায থেকে হযরত মাওলানা আলী মিঞার ঠিকানা সংগ্রহ করি এবং তাঁর নামে আমার এই অবস্থা জানিয়ে পত্র লিখ। যেই পত্র আপনি ‘আরমুগানে দাওয়াতে’ (দাওয়াতের উপহার) পড়ে থাকবেন। পত্রটি আরমুগান পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হল :
“আদরণীয় মাওলানা আলী মিঞা সাহেব,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন যে, আমি আপনার নতুন সেবক। … এর সাথে সফরে করেছি এবং সেখানে সফর করেছি। জামা’আতে যাচ্ছি। সেখান থেকে এসে হরিদ্বারে কাজ করার ইচ্ছা আছে। সেখানে শান্তির সন্ধানে আগত আমার মত কত লোক পথ হাতড়ে ফিরছে। আপনি আমার জন্য দো’আ করুন। আপনাকে একটি প্রশ্ন করছি, ভুল হলে ক্ষমা করবেন, যারা ইসলামের দাওয়াত না দেবার দরুণ ইসলাম থেকে দূরে ছিল, আজ তারা দুনিয়া থেকে চলে গেছে এবং স্থায়ী নরকের ইন্ধনে পরিণত হয়েছে তার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে? সেজন্য দায়ী কে? আপনার নিকট দো’আ প্রার্থী।
আপনার সেবক
আব্দুর রহমান (অনিল রাও শাস্ত্রী)
প্রশ্ন. জামা’আত থেকে ফিরে আসার পর আপনি কী পেশা গ্রহণ করেছেন?
উত্তর. জামা’আতে আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, হরিদ্বার ও ঋষিকেশ গিয়ে দাওয়াতের কাজ করব। কত বিপুল সংখ্যক সত্যসন্ধানী হিন্দু ভাই পথ না জানার দরুন সেখানে অন্ধকারে ঠোকর খাচ্ছে বরং এখন তো বিরাট সংখ্যক ইংরেজ ও ইহুদিরাও সেখানে অবস্থান করছে। আমাকে এ ধরনের পথহারা লোকদের পথ দেখাতে হবে। জামা’আত থেকে ফিরে এলে মাওলানা সাহেব আমাকে বললেন, আপনার কাজের ময়দানে তো হরিদ্বার ও ঋষিকেশই। কিন্তু প্রথমে তো ঘরের লোকদের হক। আপনি এক-আধ বছর ওরাঙ্গিল থাকুন। আমি ওরাঙ্গিল যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পাই, আমার পিতামাতা মারা গেছেন। তাঁরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করেছেন এবং ছটফট করেছেন। এখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে সম্পর্কহীন হিন্দুদের কুফর ও শির্কের ওপর মৃত্যুর জন্য দুঃখ আমার ওপর সওয়ার ছিল। এখন আমার মা যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যার রক্তে আমি গঠিত ও বর্ধিত যিনি আমাকে দুধপান করিয়েছেন, আমার পেশাব-পায়খানা পরিষ্কার করেছেন, আমার প্রিয় পিতা যিনি আমাকে চোখের মণি ভেবে লালন-পালন করেছেন, ঘর থেকে পালিয়ে যাবার পাঁচ-বছর গোটা দেশে আমাকে সন্ধান করেছেন ও কেঁদে ফিরেছেন, আমার এমন মুহ্সিন পিতা-মাতা ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়ে কুফর ও শির্কের ওপর মারা গেলেন এবং তাঁরা দোযখে জ্বলছেন হয়তো। আমার এই ভাবনা আমার বুকের এমন এক যখম যে, ভাই আহমদ! আপনি আমার এই ব্যথা বুঝবেন না। এ এমন এক যখম যার কোন উপশম নেই। এমন ব্যথা যার কোন ঔষধ নেই। আমি যখন ভাবি যে, মুসলমানরা তাদেরকে ঈমান পৌঁছে দেয়নি তখন আমি চিন্তা করি যে, এ ধরনের জালিমদের আমি কিভাবে মুসলমান বলি? একথা ঠিক যে, এই পথহারাকে মুসলমানই পথ দেখিয়েছি, কিন্তু আমার ঈমানের চেয়েও বেশি জরুরী ছিল আমার মা-বাপের ঈমান। তাঁরা ছিলেন ইসলামের খুব কাছাকাছি। নিজেদের ঘরে মুসলমান কর্মচারী রাখতেন। ড্রাইভার সবসময় মুসলমান রাখতেন। বিড়ি ফ্যাক্টরীর সমস্ত শ্রমিকই ছিল মুসলমান। হিন্দু ধর্মে তাদের এতটুকু বিশ্বাস ছিল না। তিনি বলতেন, সম্ভবত পূর্বজন্মে আমি মুসলমানই থেকে থাকব। এজন্য যে আমার কেবল ইসলামের কথা শুনতেই ভাল লাগে। একদিন তিনি তাঁর ড্রাইভারকে বলছিলেন, কোন খারাপ কর্মফলের দরুণ এই জন্মে আমি হিন্দু হয়ে জন্মেছি। আগামী জন্মে আশা যে আমি মুসলমান হয়ে জন্ম নেব।
আহমদ ভাই! আমি বলতে পারছি না যে, এই কষ্টের কিভাবে উপশম ঘটবে। কখনো কখনো আমার মুসলমানদের ওপর সীমাহীন ক্রোধের সৃষ্টি করে। ভাইটি আমার। আমি যদি জন্মই না নিতাম! (কাঁদতে কাঁদতে)। আপনি একটু কল্পনা করুন সেই পুত্রের শোক ও জীবনের দুঃখ যার বিশ্বাস যে, তার শ্রদ্বেয় ও দয়ালু পিতামাতা জাহান্নামের আগুনে জ্বলছেন হয়তো। (অনেকক্ষণ ক্রন্দনরত)।
প্রশ্ন. কে জানে আল্লাহ্ হয়তো তাকে ঈমান দান করেছেন। তিনি যখন ঈমানের এত কাছাকাছি ছিলেন তখন হতে পারে যে আল্লাহ তা’আলা তাকে ফেরেশতাদের দিয়ে কলেমা পড়িয়ে দিয়েছেন। এমন ঘটনাও পাওয়া যায়।
উত্তর. হ্যাঁ, ভাই যদি একথা সত্য হয়। মিথ্যা সান্ত্বনার জন্য আমি আামর মনকে এও বোঝাই। কিন্তু এওতো সত্য যে, এটা কেবলই সান্তনা।
প্রশ্ন. বাকী আত্মীয়-স্বজনদের কথাও তো আপনি ভাবতেন। আপনি তাদের ওপর দাওয়াতী কাজ করেছেন?
উত্তর. আলহামদুলিল্লাহ! আমার বড় ভাই, ভাবী তাদের দুই সন্তানসহ হয়েছেন। পিতার মৃত্যুর পর কারবারের ওপর খুবই বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফ্যাক্টরী বন্ধ হয়ে যায়। তারা ঘর-বাড়ি বিক্রি করে এখন গুলবর্গাতে একটি বাড়ি কিনেছেন এবং কারবার শুরু করেছেন।
প্রশ্ন. আপনার বিয়ের কী হল?
উত্তর. আমার স্বভাব-প্রকৃতি যিম্মাদারি ভয় পায়। এজন্য ভেতর থেকে আমার মন বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমার মত অপারগের সম্ভবত শরীয়তেও অবকাশ থাকত। কিন্তু মাওলানা সাহেব বিয়ে সুন্নত হওয়া এবং এর ফযীলত কিছুটা এভাবে বর্ণনা করেন যে, একে নিরাপদ মনে হল। এক দরিদ্র মেয়েকে বিয়ে করেছি। আলহামদুলিল্লাহ! খুবই নেক-চরিত্র ও সীমাহীন খেদমত গোযার মহিলা। আল্লাহ তা’আলা আমাদের দুটি সন্তানÑ একটি ছেলে ও একটি মেয়েও দান করেছেন।
প্রশ্ন.হদ্বারে ও ঋষিকেশে কাজ করার ইচ্ছার কী হল?
উত্তর. শির্ক ও কুফর অবস্থায় পিতামাতার মৃত্যু আমাকে দুর্বল ও ক্লান্ত করে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার হুঁশ-জ্ঞান নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। পাগলপ্রায় বনে-জঙ্গলে কাটাতে থাকি। ভাই সাহেব আমাকে ধরে নিয়ে আসেন। চিকিৎসা ইত্যাদি করান। বছর কয়েক পর শরীর-মন ঠিক হয়। তিন বছর আগে ঋষিকেশ গিয়েছিলাম। সত্যপ্রকাশ আশ্রমে যাই। স্বামী নিত্যানন্দজীর সঙ্গে দেখা করি। আমার কাছে কিছু বই ছিল। মাওলানা সাহেবের ‘আপ কী আমানত আপ কী সেবা মেঁ’ তার খুব মনঃপুত হয়। তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। তার কিডনীতে ক্যান্সার হয়েছিল। একদিন তিনি একান্ত আমাকে ডেকে পাঠান এবং বলেন, আমার মনও এ কথায় সায় দেয় যে, ইসলাম সত্য ধর্ম। কিন্তু এই পরিবেশে আমার জন্য তা কবুল করা খুবই কঠিন। আমি তাঁকে খুব বোঝাই যে, আপনি এত লেখাপড়া জানা মানুষ। নিজের ধর্ম মানা প্রত্যেক মানুষের গোটা জগদ্বাসীর সামনে আইনসম্মত অধিকার। আপনি খোলাখুলি ঘোষণা দিন। কিন্তু তিনি ভয় পান। ইসলামের ওপর তাঁর বিশ্বাসের কথা তিনি বারবার বলতেন আমাকে। আমি তাঁকে হিন্দী ভাষায় অনূদিত ‘কুরআন শরীফ’ এনে দিই। তিনি মাথায় ও চোখে লাগিয়ে গ্রহণ করেন এবং দৈনিক পড়তেন। তাঁর অসুখ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমি এই ধারণায় থাকি যে, তিনি যেন কুফর অবস্থায় মারা যাবার হাত থেকে বেঁচে যান, তাঁকে বলি, আপনি সত্যিকারের মন নিয়ে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান। চাই কি লোকের ভেতর এর ঘোষণা নাইবা দিলেন। দিলের ভেদ যিনি জানেন তিনি তো দেখছেন ও শুনছেন। তিনি এতে রাজী হন। আমি তাঁকে কালেমা পড়াই এবং তাঁর নাম রাখি মুহাম্মদ উছমান। মারা যাবার একদিন আগে তিনি আশ্রমের লোকদের ডাকেন এবং তাদেরকে নিজের মুসলমান হবার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমাকে যেন জ্বালানো না হয়, বরং ইসলামী তরীকায় দাফন করা হয়। লোকে ইসলামী তরীকায় তাঁকে দাফন করে নাই বটে বরং হিন্দু তরীকামতে বসিয়ে সমাধিস্থ করে। আল্লাহর শোকর যে, তিনি এখানকার আগুনের হাত থেকে বেঁচে যান। তাঁর মুসলমান হওয়াতে ঋষিকেশের অনেক লোক আমার বিরোধী হয়ে যায়। সেখানে থাকটা আমার জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি আশংকা অনুভব করি। আমি ফুলাত এসে সমস্ত ঘটনা মাওলানা সাহেবকে বলি। তিনি বলেন দাঈর ভয় পাওয়া উচিত নয়। তিনি আশ্বস্ত করে কুরআন পাকের আয়াত তেলাওয়াত করেন :
‘যারা আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয় ও তাঁকে ভয় করে এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না, আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আল্লাহ্ই যথেষ্ট।’
Ñসূরা আহযাব-৩৯
আল্লাহর সাহায্য ও মদদ সব সময় দাঈদের সাথে থেকেছে। কিছুদিন গুলবর্গায় থেকে আমি পুনরায় ঋষিকেশ সফর করি। আমাদের আশ্রমের কয়েকজন যিম্মাদার এখন আমার এবং ইসলামের খুব কাছাকাছি এবং অন্যান্য আশ্রমের লোকেরাও এর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। শান্তিকুঞ্জের তো বহু লোক ইসলাম সম্পর্কে পড়ছে। আশা করি, দাওয়াতের পরিবেশ অবশ্যই সৃষ্টি হবে। এখন যথেষ্ট লোক আমার।