মানবাধিকার রক্ষায় মহানবী (সা.)-এর কর্ম কৌশল

মানবাধিকার রক্ষায় মহানবী (সা.)-এর কর্ম কৌশল

মানবাধিকার রক্ষায় মহানবী (সা.)-এর কর্ম কৌশল

মানবাধিকার রক্ষায় মহানবী (সা.)-এর কর্ম কৌশল

বর্তমান বিশ্বে চলছে অহেতুক কর্মকাণ্ডের জোয়ার। ফলে ইসলামী বিধানাবলীকে আমলী জীবনে বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ভীষণ দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। যে কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে। অপরদিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে যে, পশ্চিমা বিশ্বই নাকি সর্বপ্রথম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী তুলেছে এবং তার যথার্থ বাস্তবায়ন করেছে এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর আনিত জীবন বিধানে নাকি মানবাধিকারের যথার্থ সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই। সে জন্য পশ্চিমা বিশ্বের বুদ্ধিজীবীগণ নিজেদের জ্ঞান ও গবেষণার আলোকেই মানবাধিকার বাস্তবায়নের একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে নিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে এটাই হলো মানবাধিকারের সীমারেখা এবং এর সংরক্ষণ অপরিহার্য। মূলতঃ তারা নিজেদের জ্ঞান ও গবেষণার ফলাফলকেই সত্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছে এবং প্রত্যেক বিষয়কেই এই মাপকাঠিতে যাচাই করার আপ্রাণ চেষ্টায় তারা মগ্ন।

জ্ঞান-গবেষণার আলোকে নির্ধারিত মানবাধিকার বাস্তবায়নের সীমারেখা ও একটি পর্যালোচনা:
পশ্চিমা বিশ্বের মানবাধিকার সংরক্ষণ কমিটি সমীপে একটি প্রশ্ন হলো: আপনারা নিজেদের জ্ঞান ও গবেষণার আলোকে যে মানবাধিকার বাস্তবায়নের সীমারেখা নির্ধারণ করেছেন তার জন্ম হালালভাবে হয়েছে তো?
ইতিহাস বিচরণ করলে আমরা দেখি যে, প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত মানব রচিত মানবাধিকার নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে। কোন এক সময়ে যে সকল অধিকারগুলোকে মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় মনে করা হতো, কালের পরিবর্তনে তা অচল ও অহেতুক সাব্যস্ত হয়েছে। মূর্খতার তিমিরাবর্ত সমাজে যখন নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আগমন করেছেন, তখন মানবাধিকারের হাল হাকিকত ছিল এই যে, যদি কোন ব্যক্তি কারো গোলাম সাব্যস্ত হতো, তবে সে গোলামের এতটুকু অধিকারও ছিল না যে, সে বলবেÑ আমার জান-মাল ও দেহের মালিক আমি। কারণ সে হলো অন্যের গোলাম। পক্ষান্তরে মনিবের অধিকার এতই বাড়াবাড়ি ছিল যে, ইচ্ছে হলে গোলামের গলায় বেড়ী পরাবে, এবং শিকল লাগাবে, আর এটাই ছিল তাদের দৃষ্টিতে ইনসাফ।
এতো গেল ১৪০০ বছর আগের কথা। নিকট অতীত দেড় শত বছর আগের কথা হলো এই যে, সভ্যতার দাবীদার জার্মান এবং ইটালী দেশগুলোতে বিত্তশালীদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করা হয়েছিল দারিদ্র্য সমাজকে। কারণ দরিদ্র্যরা বিত্তশালীদের গোলামী করবে এটাই ছিল তাদের দৃষ্টিতে যুক্তি সঙ্গত কথা। যেমন ধরুন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা- তারা মানবাধিকারের সমতার নামে আওয়াজ তুলে দরিদ্র মানুষকে বিত্তশালীদের অর্থ আহরণের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করলো। ফলে বেড়ে গেল গরীবদের দুঃখ-কষ্ট আর বিত্তশালীরা হলো পাহাড় সম অর্থ বিত্তের মালিক। তার বাস্তব প্রমাণ হলো: সে দেশে প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার বেতন যেখানে পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার রুবল, সেখানে একজন সাধারণ শ্রমিকের বেতন ধরা হতো এক হাজার থেকে চার হাজার রুবল। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে পৃথিবীতে কোন দিক দিয়ে উদয় হবে ইনসাফের সূর্য? অতএব মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যথাযথ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তবে বাস্তব সত্য হলো, বিভিন্ন মতবাদ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আওয়াজ তুলেছে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ একটি নীতিমালা প্রণয়নে সক্ষম হয়নি। কারণ মানুষের জ্ঞান-গবেষণার পরিসর নিতান্তই সীমিত। যা তার নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রমেও সক্ষম নয়।
পক্ষান্তরে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন। কারণ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রণীত মানবাধিকার নীতিমালাসমূহ ছিল আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত এবং প্রদত্ত। তাই তাঁর নীতিমালাই যথাযথ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা।
মুসলিম শরীফে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, বদর যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে হযরত হুযায়ফা (রা.) এবং তাঁর পিতা ইয়ামান (রা.) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনার দিকে আসতে ছিলেন, পথিমধ্যে আবূ জাহেলের সৈন্য বাহিনীর সাথে তাদের সাক্ষাত হয়, তখন তারা এই সাহাবীকে মদীনায় পৌঁছতে বাঁধা দেয় এবং বলে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করার জন্য যাচ্ছ, অতএব তোমাদেরকে তাঁর নিকট পৌঁছতে দেওয়া হবে না। তখন অপারগতার মুহূর্তে তারা বলেন; আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দলে যুদ্ধ করবো না এবং তাদের সাথে মিলিত হবো না। অতঃপর তারা এই দুজনকে ছেড়ে দেয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত ঘটনা শুনানো হলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেন। হযরত হুযায়ফা (রা.) যখন জিহাদে অংশ গ্রহণের অধিক আগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন তুমি তো আবূ জাহেলের সাথে যুদ্ধ না করার ওয়াদা করেছো! আর মুসলমান তো কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারে না। (সিয়ার আলামুন নুবালা: ৩৬৩)
নিরাপত্তার অধিকার:
মানব জীবনে জান-মালের হকই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বুনিয়াদী হক্ব। কুরআনুল কারীমে এ মর্মে মহান আল্লাহ বলেন: আর তোমরাদের যে আত্মাকে আল্লাহ তায়ালা হারাম করেছেন, তাকে ন্যায় সঙ্গত কারণ ছাড়া হত্যা করো না। (সূরা: ফুরকান:৬৮) তেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ঘোষণা দেন যে, জেহাদের ময়দানেও তোমরা নারী-শিশু এবং বৃদ্ধদের উপর হামলা করো না।
মানব জীবনে মালের হেফাযত হচ্ছে আরেকটি হক্ব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমরা একে অন্যের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। (সূরা নিসা: ২৯) অনুরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের একের সম্পদ অন্যের নিকট আমানত। এরপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। (বুখারী: ২৩৮৭) এক সময় খায়বর যুদ্ধে জনৈক ইহুদী মনে মনে ভাবলো যে, সারা জীবন মুহাম্মাদের কথা লোক মুখে শোনে আসলাম। এবার সরাসরি গিয়ে দেখবো। কথামত সে বকরীর এক পাল নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হলো। সাহাবাদেরকে সে জিজ্ঞাসা করলো যে, মুহাম্মাদ কোথায়? সাহাবাগণ জবাব দিলেন, অমুক কামরায় আছেন। অতঃপর সে ঐ কামরায় উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ইসলাম মানুষের জান-মাল হেফাযতের কতটুকু অধিকার প্রদান করেছে? উত্তরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তাওহীদের, সালাতের দাওয়াতসহ বিস্তারিত বিধি-নিষেধ শুনালেন। ফলে তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে পাঠ করলেন, ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ’। তারপর তিনি ফেরার সময় বলে গেলেন যে, এতগুলো বকরী নিয়ে এসেছিলাম আশঙ্কা ছিল ফেরার সময় হয়তো এসব ফিরে পাবো না। কিন্তু ফেরার সময় দেখা গেল সবই ফিরে পেলাম। ইহা আমাদের ধর্মের হলে আদৌ ফিরে পাওয়ার আশা জাগতো না, এই হল ইসলামের মাল হেফাযতের স্বরূপ। যা দেখে অমুসলিমরাও ইসলাম গ্রহণ করেন।
সম্মান রক্ষার অধিকার:
মানব জীবনে আরো একটি অধিকার হলো মানব সম্মান রক্ষা করার অধিকার। এ প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিও না এবং তাদের লজ্জা দিও না এবং দোষ-ত্রুটি বলে বেড়ায়েও ন। আর যে তার অপর ভাইয়ের দোষ বলে বেড়াবে আল্লাহও তার দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর আল্লাহ তায়ালা যার দোষ প্রকাশ করে দিবেন, সে অবশ্যই লাঞ্ছিত হবে। তেমনিভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন; তোমাদের একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার গোশত খেতে পছন্দ করবে? (সূরা রাসূলাত: ১২) বস্তুতঃ মানুষের অধিকার বাস্তবিকই ইসলাম এতবেশি রক্ষা করেছে যা অন্য কোন ধর্ম করতে পারে নি।
উপার্জন অধিকার:
পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকার নিমিত্তে উপার্জনের অধিকার থাকাও নেহায়েত জরুরী। অন্যথায় জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে একথা অনস্বীকার্য, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: যে, কারো অঢেল সম্পদ আছে বলে তার এ অধিকার নেই যে, সে অন্যের উপার্জন ব্যবস্থা বন্ধ করে দিবে। তিনি বলেছেন; لا يحتكر إلا خاطئ অর্থাৎ ইসলামে কুক্ষিগত করার কোন নিয়ম নেই। (মুসলিম, আহমদ) তিনি অন্যত্র বলেন: المحتكر ملعون অর্থাৎ সম্পদ কুক্ষিগতকারী অভিশপ্ত। (ইবনু মাযাহ) পূর্ণ বাজারের নিয়ন্ত্রণ একজনের হাতে চলে আসবে এমন করার অধিকার কারো নেই। বরং তিনি বলেন: دعوا الناس يرزق الله بعضهم بعضا (সুনানে নাসাঈ) অর্থাৎ তারা মানুষকে ডাকবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের একজন দ্বারা অন্য জনের জীবিকার ব্যবস্থা করবেন। এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, উপার্জনাধিকার ইসলাম এত বেশি দিয়েছে যা অন্য ধর্ম দেয়নি।
ধর্মীয় অধিকার:
যে কেউ যে কোন আক্বীদায় বিশ্বাসী হতে পারে। এ অধিকার ইসলাম দিয়েছে, এক্ষেত্রে ইসলাম কোন চাপ প্রয়োগ করে নি। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন: لا إكراه في الدين দ্বীন তথা ইসলামে কোন জোর জবরদস্তি নেই। (সূরা বাকারা: ২৫৬) যদি কোন ইহুদি হতে চায় ইহুদি হবে, কেউ খ্রিস্টান হতে চাইলে খ্রিস্টান হবে, আবার যদি কারো হিন্দু ধর্ম পালন করতে ইচ্ছে করে, সে তা করবে। এক কথায় যার যা মনে চায় তাই এই দুনিয়ায় করতে পারবে, তাকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার বিধান ইসলামে নেই। তবে হ্যাঁ তাকে হকের তথা ইসলামের দাওয়াত দেওয়া এবং সত্য বোঝানোর জন্য চেষ্টা ফিকির করতে হবে। আর যদি কেউ মুসলমান হওয়ার পর মুরতাদ হয়ে যায়, তাহলে তার অর্থ হলো এই যে, সে ভূখণ্ডে ফাসাদ বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে বেড়াবে। আর ফাসাদের চিকিৎসা হলো নির্মূল করে দেওয়া। এজন্য জমীনকে পূতপবিত্র করার জন্য মুরতাদ ব্যক্তিকেও কতল করে নির্মূল করে দেওয়া ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কেননা মানব দেহের কোন অঙ্গের পচন ধরলে, ডাক্তারগণ সে অঙ্গটিকে কেটে ফেলেন অন্যান্য অঙ্গগুলোকে পচন ধরার আশঙ্কা থেকে বাঁচার জন্য। ঠিক তদ্রƒপ জমীনকে পূতপবিত্র করার জন্য মুরতাদকেও কতল করা হবে।
মোট কথা এ প্রসঙ্গে আলোচনা অত্যন্ত দীর্ঘ। (মুরতাদের শাস্তি কুরআন ও হাদীসের আলোকে একটি সরল উপস্থাপনা, এই শিরোনামে মাসিক আল-হুদার গেল বছরের ২০১৪ নভেম্বর ও ডিসেম্বর সংখ্যায় বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে) এই পবন্ধে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো
১। জানের হেফাযত ২। মালের হেফাযত ৩। মান সম্মানের হেফাযত ৪। জীবিকা অর্জনের অধিকার ৫। ধর্মীয় অধিকার তথা আক্বীদা বিশ্বাসের হেফাযত । এগুলোকে ইসলাম মানব জীবনের অধিকার বলে সাব্যস্ত করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম যার পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছেন। যার লাখো নজীর আজো দুনিয়াতে বিদ্যমান রয়েছে।
পরিশেষে মহান আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ করছি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকেও এর পরিপূর্ণ বাস্তাবায়ন করার তাওফীক দান কর। আমীন

Related Post