জামে তিরমিযি এবং সুনানে নাসায়িতে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে : ‘হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন—মুসলমান তাকে বলা হবে যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ। এবং মুমিন ওই ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে অন্য মানুষের জান-মালের কোনো শঙ্কা না থাকে।
এই হাদিসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন মুসলমানের স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কিছু গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে দ্বীনের বিশাল এক তাত্পর্যময় শাখার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যাতে অজ্ঞতার দরুন মানুষ দ্বীনের শাখা জ্ঞান করতেও চায় না। অনেকেরই ধারণা হলো, দ্বীন কেবল কিছু আকিদা-বিশ্বাস, নামাজ, রোজা এবং নির্দিষ্ট কিছু ইবাদত-বন্দেগির নাম। এসব ইবাদত-বন্দেগি পালন করার পর মানুষ তার জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে আজাদ এবং স্বাধীন। অথচ বাস্তবতা হলো, ইসলাম যেমনিভাবে আমাদের নামাজ-রোজা এবং অন্যান্য ইবাদতের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, একইভাবে জীবনের প্রতিটি শাখা-প্রশাখাতেই এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে যার ওপর আমল করলে আমরা আমাদের সমাজকে জান্নাতে রূপান্তর করতে পারি।
সত্য এবং বাস্তব এটিই যে, ইসলামের শিক্ষায় মাত্র এক-চতুর্থাংশ আকিদা-বিশ্বাস এবং ইবাদত-বন্দেগির আলোচনা এসেছে। বাকি তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষাই লেনদেন, আখলাক-চরিত্র এবং সামাজিক বিষয়াসয় সংক্রান্ত। দ্বীনে গুরুত্বপূর্ণ শাখা-প্রশাখার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা হচ্ছে সামাজিক আচার-আচরণ। যাতে অন্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এবং পরস্পর মিলে জীবন যাপনের আদব-শিষ্টাচারের আলোচনা করা হয়েছে।
আমরা যে হাদিসটি এইমাত্র উল্লেখ করে এসেছি, এই হাদিসটিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করে দিয়েছেন। কেননা সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলাম যত বিধিবিধান দিয়েছে, তার চূড়ান্ত ও সর্বশেষ উদ্দেশ্য হলো, আপন সত্তা দ্বারা কোনো মুসলমান এমনকি কোনো মানুষেরও যেন কোনো ধরনের কষ্টের সম্মুখীন না হতে হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামী জীবন ব্যবস্থার এই নীতিকে চূড়ান্তভাবে অন্তর্নিহিত করার জন্য হাদিসে এই বাক্য ব্যবহার করেছেন: ‘প্রকৃত অর্থে মুসলমান ওই ব্যক্তিই, যার হাত এবং মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ অর্থাত্ অন্যকে পীড়া দেয়া, কষ্ট দেয়া থেকে বেঁচে থাকা ইসলামের নির্দশন। সুতরাং যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দিয়ে থাকে, তাকে আইনত ও শাব্দিক অর্থে মুসলমান বলা হলেও একজন সাচ্চা মুসলমান হওয়ার ক্ষেত্রে, প্রকৃত বৈশিষ্ট্যধারী এবং বুনিয়াদি নিদর্শনধারী মুসলমান হওয়ার ক্ষেত্রে বহু দূরে অবস্থান করবে।
অতঃপর হাদিসের শুরুর অংশে তো বলা হয়েছে যে, ‘মুসলমান তাকে বলা হবে, যার মুখ এবং হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ।’ কিন্তু পরের অংশেই বলা হয়েছে, ‘তার দ্বারা মানুষের জান-মালের কোনো শঙ্কা থাকবে না।’ এছাড়া সহিহ ইবনে হাব্বানের বর্ণনায় এই শব্দ বর্ণিত হয়েছে : ‘যার হাত এবং মুখ থেকে সব মানুষ নিরাপদ থাকে।এর দ্বারা বুঝে আসে যে, মুসলমানের কাজ হলো এই যে, সে কোনো মানুষকেই কোনো কষ্ট ও পীড়া দেবে না। চাই ওই ব্যক্তি মুসলমান হোক বা অমুসলিম। সুতরাং যেমনিভাবে একজন মুসলমানকে কষ্ট ও পীড়াদান থেকে বেঁচে থাকা একজন মুসলমানের জন্য জরুরি, একইভাবে কোনো অমুসলিমকেও বিনা কারণে পেরেশান করা, কষ্ট ও পীড়া দেয়া হারাম।
অতঃপর হাদিসের ভাষ্যে সুস্পষ্টভাবে হাত এবং মুখের উল্লেখ শুধু এজন্য করে দেয়া হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ অন্যকে এই দুইটি মাধ্যমেই কষ্ট দিয়ে থাকে। অন্যথায় হাদিসের উদ্দেশ্য হলো যে, মানুষকে কোনোভাবেই কোনো ধরনের কষ্ট দেয়া যাবে না। হাতের দ্বারা নয়, মুখের দ্বারাও নয়, এমনকি অন্য কোনো পন্থাতেই নয়।
হাতের দ্বারা কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য তো স্পষ্ট। কেননা এর মাধ্যমে অন্যায়ভাবে মারপিট, লড়াই-ঝগড়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু মুখের দ্বারা কষ্ট দেয়ার ভেতর অসংখ্য গোনাহ ও অন্যায়ের সমন্বয় ঘটে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ মিথ্যা, ধোঁকা-প্রতারণা, অঙ্গীকার ভঙ্গ, গিবত, পরশ্রীকাতরতা, গালমন্দ বা এমন কোনো কথা বলে দেয়া; যার দ্বারা অন্যের অন্তর ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, কিংবা তার অন্তরপীড়া কিংবা দৈহিক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়াও কষ্ট পোহানোর আরও যত পদ্ধতি হতে পারে, তার সবগুলোকেই এই হাদিসে তেমনি হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন চুরি, ডাকাতি, শরাব পান ও অন্যান্য কবিরা গোনাহ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।এ কারণেই ইসলাম তার প্রতিটি নির্দেশেই অন্যকে কষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামের নির্দেশ হলো, জুমার দিন যখন মসজিদে যাবে, তখন মানুষের ঘাড় মাড়িয়ে আগে যাওয়ার চেষ্টা করবে না; বরং যেখানেই স্থান পাবে সেখানেই বসে যাবে। একইভাবে জুমার নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করে যাবে। দুর্গন্ধযুক্ত কোনো কিছু খেয়ে মসজিদে যাবে না। কেননা এতে পাশের লোকের কষ্ট হতে পারে। একইভাবে নির্দেশ হলো, এমন জায়গায় নামাজের নিয়ত করে দাঁড়াবে না, যাতে করে অন্যের চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। হজরত আয়েশা (রাযি.) বলেন, যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য জাগ্রত হতেন তখন সব কাজ এত আস্তে সম্পন্ন করতেন যে, কারও যেন ঘুম ভেঙে না যায়। কেননা নফল ইবাদতের জন্য অন্য কাউকে কষ্ট দেয়া ইসলামী চিন্তা-চেতনা পরিপন্থী।
আবার কষ্ট দেয়ার কিছু পদ্ধতি তো একেবারেই স্পষ্ট। যেমন মারামারি করা, অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করা ইত্যাদি। কিন্তু কিছু পদ্ধতি এমনও রয়েছে, যাতে আমরা একেবারেই হেয়ালি করেই করে থাকি। এটিও যে মানুষের কষ্টের কারণ হতে পারে তা আমরা কখনও চিন্তাই করি না। যেমন রাস্তায় ফলফলাদির ছিলকা নিক্ষেপ করার সময় কারও ধারণায় এই বিষয়টি থাকে না যে, এটি একটি গোনাহের কাজ। অথচ ওই ছিলকার কারণে যদি কোনো মানুষ পা পিছলে পড়ে গিয়ে আহত হয়, তাহলে এর সমুদয় গোনাহ ওই ব্যক্তির হবে যে ফলের ছিলকাটি রাস্তায় নিক্ষেপ করেছে।
একইভাবে জনসাধারণের চলাচল রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করা, আরোহণের গাড়ি-ঘোড়া অনির্ধারিত স্থানে রেখে দেয়া, প্রয়োজন ছাড়া মাইক ব্যবহার করে মানুষের আরামে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার মতো কাজগুলোও শুধু সভ্যতা পরিপন্থীই নয় বরং এই হাদিসের আলোকে তা শরয়িভাবে গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এই হাদিসের শিক্ষা হলো, মুসলমানের প্রতিটি কাজেই এই চিন্তা থাকা উচিত যে, এই কাজ দ্বারা আবার অন্য কোনো ব্যক্তির অন্তরপীড়া বা দৈহিক কষ্টের কারণ হবে না তো? আর যে কাজের দ্বারা কারও কষ্ট হওয়ার সামান্যতম আশঙ্কা থাকে, তা পুরোপুরিভাবে পরিহার করে চলা উচিত। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে এই হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন