ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, যে তাকওয়ার সংজ্ঞায় তালক বিন হাবীব (রহ.) কে করা হয়ে তিনি উত্তরে বলেন; সাওয়াবের আশা নিয়ে আল্লাহর আনুগত্য করা, আর আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে গুনাহের কাজ ছেড়ে দেওয়া।
মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করেছেন এভাবে-
الم ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ أُوْلَئِكَ عَلَى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
১. আলিফ লাম মীম। (এর অর্থ কেবলমাত্র আল্লাহ অবগত)। ২. এই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক। ৩. যারা গায়েবে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে। ৪. যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ বিষয়ে, যা আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার পূর্ববর্তীগণের প্রতি নাযিল করা হয়েছিল। আর পরকালীন জীবনের প্রতি যারা নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে। ৫. ঐ সকল মানুষ তাদের প্রভুর দেখানো পথের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম।
আয়াতগুলিতে মুত্তাক্বীদের ৫টি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। এখন এই বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করা হবে। ইনশা আল্লাহ
هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ ‘আল্লাহ ভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক’। কুরআন সকল মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক হলেও এখানে মুত্তাক্বীদের খাছ করা হয়েছে এ কারণে যে,তারাই কেবল এ থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন,অন্যেরা নয়। যেমন বিরানী সকলের জন্য উত্তম খাদ্য হলেও তা কেবল
সুস্থদেহীদের জন্য উপযোগী,অন্যদের জন্য নয়। একদল ছাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মুত্তাক্বী বলতে ঐসব মুমিন নর-নারীকে বুঝায় যারা শিরক থেকে বেঁচে থাকেন এবং আল্লাহর অবাধ্যতার শাস্তিকে ভয় পান। তারা আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ কাজ করেন এবং সর্বদা তাঁর
রহমতের আশা করেন (ইবনু কাছীর) ।
আল্লাহ অত্র আয়াতে মুত্তাক্বীদের জন্যই কেবল হেদায়াতকে খাছ করেছেন। কেননা যারা হেদায়াত চায় কেবল তারাই হেদায়াত পায়। যারা যেদী ও হঠকারী তারা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়। এ বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে,
قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ ۖ وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى ۚ أُولَٰئِكَ يُنَادَوْنَ مِن مَّكَانٍ بَعِيدٍ
বলুন এটা (কুরআন) বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও আরোগ্যকারী। আর যারা (একে) বিশ্বাস করে না, তাদের কানে রয়েছে বধিরতা, আর তারা এ থেকে অন্ধ। যেন তাদেরকে দূরবর্তী স্থান থেকে আহবান করা হচ্ছে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৪) ।
অর্থাৎ যারা কুরআনকে বিশ্বাস করে না ও তা থেকে ফায়দা উঠাতে চায় না,তাদের অবস্থা এমন যেমন কাউকে দূর থেকে ডাকা হয়। অথচ সে শুনতেও পায় না,দেখতেও পায় না। যারা মুত্তাক্বী নয়, তাদের অবস্থা অনুরূপ। কুরআন থেকে তারা উপকৃত হতে পারে না।
যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا
‘আমরা কুরআনে এমন সব বিষয় নাযিল করেছি যা আরোগ্যকারী এবং বিশ্বাসীদের জন্য রহমত স্বরূপ এবং যা সীমা লংঘনকারীদের জন্য কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৮২) ।
অত্র আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে,কুরআন যেমন সত্যসেবীদের জন্য পথ প্রদর্শক, তেমনি এর প্রতি অবিশ্বাসী ও অনীহা প্রদর্শনকারীদের জন্য কঠিন বিপদ ও গযবের কারণ।
এখন আসছি মূল আলোচনায়-
১। মুত্তাকীদের প্রথম গুণ হলো, গায়েবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা:
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
‘যারা গায়েবে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি,তা থেকে ব্যয় করে’।
অত্র আয়াতে মুত্তাক্বীদের ছিফাত ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনটি গুণ বর্ণিত হয়েছে।
১.অদৃশ্যে বিশ্বাস
২. ছালাত কায়েম করা এবং
৩. আল্লাহর পথে ব্যয় করা।
প্রথমতঃ অদৃশ্যে বিশ্বাস। এর অর্থ কি? আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُم بِالْغَيْبِ لَهُم مَّغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ
নিশ্চয়ই যারা তাদের প্রভুকে না দেখে ভয় করে,তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার’ (মুলক ৬৭/১২) ।
এই ভয় হতে হবে একথা জেনে-বুঝে যে, এ সৃষ্টিজগত আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়নি এবং আপনা-আপনি পরিচালিত হচ্ছে না। বরং নিশ্চিতভাবেই এর একজন সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আছেন, যাঁর কুশলী বিধান ও দূরদর্শী পরিকল্পনা মতে পুরা সৃষ্টিজগত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
‘বান্দাগণের মধ্যে আল্লাহকে ভয় করে কেবল তারাই যারা জ্ঞানী’(ফাত্বির ৩৫/২৮) ।
এখানে জ্ঞানী অর্থ সূক্ষ্মদর্শী ও বিজ্ঞানী,যারা সৃষ্টিতত্ত্ব উপলব্ধি করে এবং সৃষ্টি কৌশলসমূহ প্রমাণ সহকারে জেনে-বুঝে আল্লাহর অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করে। বোকা মানুষ সবকিছু চর্মচক্ষুতে দেখতে চায়। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই সে বুঝতে পারে যে, তার জীবনটা সর্বদা অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতেই পরিচালিত হচ্ছে। মায়ের গর্ভ থেকে সে পৃথিবীতে এসেছিল ছোট একটি শিশু হিসাবে। অথচ এখন সে সাড়ে তিনহাত দীর্ঘ তরতাজা এক নওজোয়ান।
কে তাকে টেনে লম্বা করলো? সে সবকিছু খেয়ে হযম করে। কিন্তু কিভাবে তার খাদ্য হযম হয়। কিভাবে ঐ খাদ্য থেকে রক্ত,গোশত,তাপ ও শক্তি সৃষ্টি হয় এবং অপ্রয়োজনীয় অংশ পেশাব ও পায়খানা হয়ে বেরিয়ে যায়,সেই কৌশল সে কি কখনো প্রত্যক্ষ করেছে? অথচ পেট তার সাথেই রয়েছে সর্বদা-সর্বক্ষণ। একটু পেট ব্যথা বা মাথা ব্যথা হলেই মুখের হাসি মিলিয়ে যায়,সামান্য ডায়রিয়া হলেই বিছানায় সটান হয়ে পড়তে হয়,হাতের নাগালের মধ্যেই নিজের পেটটা থাকলেও তার উপরে তার কোনই নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে কে ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন? কে ঐ মাথার মধ্যে মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তি দান করলেন? বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ড দান করলেন? একই পিতা-মাতার পাঁচটি সন্তান। কেন সবার মেধা ও প্রতিভা, যোগ্যতা ও ক্ষমতা সমান হল না? একজনের হাতে কলম দিলে লাইনের পর লাইন নির্ভুলভাবে লিখে যায়,আরেকজন কলম হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও দু’লাইন লিখতে পারে না,এসবের জবাব বস্তুবাদী নাস্তিকদের কাছে আছে কি? এক সেকেন্ড পরেই তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে, সেকথা যে মানুষ বলতে পারে না,তাকে তো একথা মানতেই হবে যে,সে অবশ্যই কোন অদৃশ্য শক্তি দ্বারা প্রতি মুহূর্তে পরিচালিত হচ্ছে। তিনিই তো আল্লাহ,যিনি সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, যিনি আদি ও যিনি অন্ত,যিনি চিরঞ্জীব ও সব কিছুর ধারক। বস্তুতঃ এটাই হল গায়েবে বিশ্বাসের মূল কথা। মুত্তাক্বী হবার প্রথম ও প্রধান গুণ হল এটাই।
আবু জুম‘আহ আনছারী (রাঃ) বলেন,আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে দুপুরের খানা খাচ্ছিলাম। এ সময় আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের চাইতে উত্তম কেউ আছে কি? আমরা আপনার কাছে ইসলাম কবুল করেছি এবং আপনার সাথে জিহাদ করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বললেন, ﻗَﻮْﻡٌ ﻳَﻜُﻮْﻧُﻮْﻥَ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِﻯْ ﻳُﺆْﻣِﻨُﻮْﻥَ ﺑِﻰْ ﻭَﻟَﻢْ ﻳَﺮَﻭْﻧِﻰْ ‘হ্যাঁ। তারা হল আমার পরবর্তী লোকেরা, যারা আমার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করবে অথচ তারা আমাকে দেখেনি’।
দ্বিতীয় গুণ, নামায প্রতিষ্ঠা করা:
وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ অর্থাৎ মুত্তাক্বী তারাই যারা ছালাতের ফরয-ওয়াজিব-সুন্নাত,কিয়াম-কুঊদ, রুকূ-সুজূদ,ওযূ এবং ছালাতের ওয়াক্তের যথাযথ হেফাযত করে। (ইবনু কাছীর) ।
এখানে রাব্বুল আলামীন নামায প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন; নামায প্রতিষ্ঠা করা আর আদায় করা এক কাজ নয়। পবিত্র কুরআনে যত জায়গায় নামাযের আলোচনা আসছে, সব জায়গায়তেই প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তাই শুধু একাকী নামায আদায় করলে যিম্মদারী শেষ হবে না। পরিবারের সকলকে নিয়ে নামায আদায় করতে পারলে আল্লাহর নির্দেশের যথাযথ পালন হবে। এই মর্মে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন:
وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا ۖ لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا ۖ نَحْنُ نَرْزُقُكَ ۗ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَىٰ
নিজের পরিবার পরিজনকে নামায পড়ার হুকুম দাও১১৪ এবং নিজেও তা নিয়মিত পালন করতে থাকো। আমি তোমার কাছে কোন রিযিক চাই না, রিযিক তো আমিই তোমাকে দিচ্ছি এবং শুভ পরিণাম তাকওয়ার জন্যই। (সূরা ত্বাহা: ১৩২)
আমাদের সমাজে পোশাক পরিধান করা প্রতিষ্ঠিত আছে, এ কথা সকলে স্বীকার করেন, কেউ যদি খালি গায়ে বের হয় তাকে জনগণ পাগল বলবে। তাকে সমাজে সুস্থ লোকদের সাথে স্থান দেওয়া হয় না। এবার বলুন তো সেভাবে কি আমাদের মুসলিম সমাজে নামায প্রতিষ্ঠিত আছে, কেউ নামায না পড়লে তাকে, সমাজ থেকে কি বের করে দেওয়া হয়? উত্তর না। মহান আল্লাহ নামাযকে প্রতিষ্ঠিত করতে বলেছেন। তাই আসুন মুত্তাকীদের দ্বিতীয়গুণ নামাযকে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর হই। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন
মুত্তাকীদের তৃতীয় গুণ: আল্লাহর রাস্তায় দান করা-
وَمِمَّا رَزَقْنٰهُمْ يُنْفِقُوْنَ মুত্তাক্বীদের তৃতীয় গুণ হল এই যে,আল্লাহ তাদেরকে যাকিছু খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি দান করেছেন,তা থেকে তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। জ্ঞান,স্বাস্থ্য ও চিন্তাশক্তি ইত্যাদি আল্লাহর দেওয়া অন্যতম মূল্যবান রিযিক। এগুলিকে মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর পথে ব্যয় করে থাকেন। তবে অত্র আয়াতে খাদ্য ও ধন-সম্পদকেই বুঝানো হয়েছে।
আলোচ্য আয়াতে কেবল ছালাত ও ইনফাক্ব ফী সাবীলিল্লাহর কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে,ছালাত হল দৈহিক ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং যাকাত হল আর্থিক ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাকী সব ইবাদত এ দুইয়ের অনুষঙ্গ।
وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ
‘এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ সকল বিষয়ে, যা আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা আপনার পূর্ববর্তীগণের প্রতি নাযিল হয়েছিল। আর পরকালীন জীবনের উপরে যারা নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে’।
অত্র আয়াতে মুত্তাক্বীদের চতুর্থ ও পঞ্চম গুণ বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থটি হচ্ছে কুরআন ও হাদীছ, যা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে, তার উপরে ঈমান আনা এবং যে সকল কিতাব ও শরী‘আত পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণের উপরে নাযিল হয়েছিল, সেগুলির উপরে ঈমান আনা। যেমন ইবরাহীম (আঃ)- এর উপরে ছহীফাসমূহ, মূসা (আঃ)-এর উপরে তওরাত, দাঊদ (আঃ)-এর উপরে যবূর, ঈসা (আঃ)-এর উপরে ইনজীল প্রভৃতি।
মুত্তাক্বীগণ বিগত সকল নবী ও রাসূলগণ এবং তাঁদের আনীত কিতাব ও শরী‘আতের উপরে ঈমান রাখেন এই মর্মে যে, ঐ সকল কিতাব আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছিল এবং সেগুলি সে যুগের নবীগণের স্ব স্ব গোত্রের জন্য পালনীয় ছিল। অতঃপর বিশ্বমানবের জন্য সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ এলাহী কিতাব আসার পরে বিগত সব কিতাবের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। এলাহী কিতাব ও শরী‘আতের উপরে বিশ্বাস এভাবে রাখতে হবে যে, এগুলি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। এর মধ্যে নবীর কপোল কল্পিত কিছুই নেই এবং এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এলাহী কিতাব ও শরী‘আতের বিধি-বিধানসমূহ মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ ও অতুলনীয়। মানব রচিত কোন বিধান এর চাইতে উত্তম নয় বা এর সমতুল্য নয়।
শেষ যামানায় ‘কুরআন’ ও ‘ইসলাম’ আসার পরে এখন আর কোন এলাহী কিতাব ও দ্বীন নেই। বিগত সকল কিতাব এখন অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। ইহুদী-নাছারাসহ বিগত সকল দ্বীন
এখন বাতিল হয়ে গেছে। এখন ইসলামই বিশ্বমানবতার জন্য একমাত্র দ্বীন। যেমন আল্লাহ
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ ۗ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে তাঁর মনোনীত দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯) ।
ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন আল্লাহর নিকটে গৃহীত হবে না। যেমন তিনি বলেন,
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, কখনোই তা কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫) ।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لاَ يَسْمَعُ بِي أحد من هذه الأمة لا يَهُودِيٌّ، وَلاَ نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كانَ مِنْ أَصْحَابِ النار
‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত তাঁর কসম করে বলছি,ইহুদী হৌক বা নাছারা হৌক,এই উম্মতের যে কেউ আমার আবির্ভাবের খবর শুনেছে,অতঃপর মারা গেছে। অথচ আমি যা নিয়ে আগমন করেছি তার উপরে ঈমান আনেনি,সে অবশ্যই জাহান্নামের অধিবাসী হবে’। (মুসলিম)
হাদীছে ‘এই উম্মত’ অর্থ এ যুগের সকল জিন ও ইনসান।
এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, অত্র আয়াতসহ কুরআনের অন্যূন ৫০টি স্থানে ঈমানের আলোচনায় পূর্ববর্তী নবীগণের ও তাঁদের প্রতি প্রেরিত কিতাব ও ছহীফা সমূহের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোথাও পরবর্তী কোন নবী বা কিতাবের উল্লেখ নেই। এমনকি এ বিষয়ে কোন ইশারা-ইঙ্গিতও নেই। এ বিষয়টি কুরআনের সর্বশেষ ইলাহী গ্রন্থ হওয়ার এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সর্বশেষ নবী হওয়ার একটি প্রকৃষ্ট দলীল। মূসা, দাঊদ, ঈসা প্রমুখ শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলগণ বনু ইসরাঈল গোত্রের নবী ছিলেন।
وَبِالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ ‘এবং তারা আখেরাতের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করবে’। এটি হ’ল মুত্তাক্বীদের পঞ্চম গুণ। আখেরাত অর্থ পরবর্তী জীবনের উপর ঈমান আনা,
এখানে আখেরাত বলতে পরকালীন জীবনকে বুঝানো হয়েছে, যা মৃত্যুর পরে শুরু হবে। এর মধ্যে কবর, কিয়ামত, হাশর, শেষবিচার, জান্নাত,জাহান্নাম সবকিছু শামিল রয়েছে।
উল্লেখ্য যে,ইতোপূর্বে يُؤْمِنُونَ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হলেও আখেরাত বিশ্বাসের
ক্ষেত্রে يُوقِنُونَ ক্রিয়াপদ ব্যবহারের মাধ্যমে এই বিশ্বাসের দৃঢ়তার প্রতি অধিক জোর দেওয়া হয়েছে।
বলা বাহুল্য এ সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর সেরা ও প্রিয় সৃষ্টি মানুষের সেবার জন্য। অথচ মাত্র অনধিক একশ’ বছরের মধ্যেই মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। যার
মধ্যে যালেম যুলুম করেও প্রশংসা পাচ্ছে। অন্যদিকে নিরপরাধ মযলূম অত্যাচারিত হয়েও বদনামগ্রস্ত হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। তাহলে যালেমের যুলুমের শাস্তি এবং মযলূমের যথাযথ পুরস্কার পাবার পথ কি? সেটারই জওয়াব হল পরকাল। মৃত্যুর পরেই যার সূচনা হয়
এবং শেষ বিচারের দিন যা চূড়ান্ত হয়। অতঃপর যালেম জাহান্নামী হয়ে তার যোগ্য শাস্তি পায় এবং ঈমানদার মযলূম জান্নাতী হয়ে তার যোগ্য প্রতিদান পেয়ে ধন্য হয়।
অতঃপর সেখানেই তার চিরস্থায়ী নিবাস।
يَا قَوْمِ إِنَّمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ ﴿٣٩﴾
দুনিয়ার এ মুসাফিরখানা হ’ল দারুদ্দুনিয়া, কবরের অপেক্ষমান জগত হ’ল দারুল বারযাখ এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী জগত হ’ল দারুল ক্বারার (মুমিন ৪০/৩৯) ।
আখেরাতের উপরে এই দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা তাই মুমিন জীবনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।
আল্লাহ আমাদের আখেরাত বিশ্বাসকে মযবূত করুন- আমীন!
أُوْلَئِكَ عَلَى هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
‘ঐ সকল মানুষ তাদের প্রভুর দেখানো পথের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম’। ‘সফলকাম’ অর্থ اَلْفَائِزُوْنَ بِالْجَنَّةِ وَالْبَاقُوْنَ فِيْهَا ‘জান্নাতের অধিকারী ও সেখানে অবস্থানকারী’ (কুরতুবী)।
মুত্তাকীদের আরো কিছু গুণাবলী:
এক নজরে মুত্তাকীদের কিছু গুণাবলী আলোচনা করা হলো:
১। আল্লাহর প্রতি ঈমান, ফেরেশতাদের প্রতি রাসূলগণের প্রতি, তাকীদের প্রতি ঈমান আনা। ২। নামায প্রতিষ্ঠা করা, ৩। যাকাত প্রদান করা, ৪। পূর্বেকার কিতাবসমূহ ও বর্তমান কিতাব আল কুরআনের প্রতি ঈমান আনা, ৫। প্রতি পরকালের,৬। ওয়াদা পূরণ করা, ৭। সত্যবাদিতা, ৮।ধৈর্যধারণ করা ৯। দোয়া করা, ১০। শেষ রাতে উঠে ইস্তেগফার করা, ১১। তাওবার প্রতি খেয়াল রাখা, ১২। ইহসান বা অন্যের প্রতি অনুগ্রহশীল থাকা, ১৩। ধার্মিকতা হওয়া, ১৪। সহনশীল হওয়া, অন্যকে ক্ষমা করার মন-মানষিকতা থাকা, ১৫। কিয়ামুল লাইয়ের নামায পড়া, ১৬। ইনফাস প্রতিষ্ঠা করা, ১৭। আল্লাহর প্রতীকগুলোর সম্মান করা।