উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি
তৃতীয় পদক্ষেপের সময় থেকে শুরু হলো উস্কানী, উত্তেজনা ও বিরোধিতা। এ পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশ বা তার চেয়ে কিছু বেশী হয়েছিলো। রাসূল (সা.) এবার কা‘বা শরীফে গিয়ে ইসলামের প্রকাশ্যে দাওয়াত দিলেন। কা‘বা ঘরে ইসলামের প্রকাশ্য ঘোষণা কুরাইশদের নিকট এটা ছিলো কা‘বা শরীফের সবচেয়ে বড়ো অবমাননা। ধর্মীয় চেতনা যখন বিকৃত হয়ে যায়, তখন মানুষের ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান হারিয়ে যায়। তা না হলে যে পবিত্র আল্লাহর ঘর একদিন তাওহীদের বাণী প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চত্তরে আল্লাহর বাণী প্রচার করায় কা‘বা অবমাননার কারণ হিসেবে চিন্হিত হলো। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, অতগুলো মূর্তি স্থাপনে কা‘বার অবমাননা হয়না,মূর্তির সামনে কপাল ঘষলেও তার অবমাননা হয়না, উলংগ হয়ে তওয়াফ করলে, উলু ধ্বনি দিলে এবং তালি বাজালেও তার পবিত্রতা হানি হয়না। দেবদেবীর নামে জানোয়ার বলি দিলে এবং পুরোহিতগিরি ও খাদেমগিরির কর আদায় করলেও কা‘বার অপমান হয়না। অপমান হয় শধু ঐ ঘরের আসল মালিকের নাম নিলেই। বড়ই বিচিত্র বিবেক মানুষের! যে আল্লাহ সৃষ্টি করে লালন-পালন করছেন, সে আল্লাহর জমিনে তাঁর ইবাদতের আহবান করা মহা অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়। আজকের মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাও কি তেমনি মনে হয়না? মুসলিম দেশে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা চলে, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া-লটারী, গান-বাজনা, উলংগপনা-বেহায়াপনা, জবর দখল, মারা-মারী, হানা-হানী, দুর্নীতি,নারী ধর্ষণ-নির্যাতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ হত্যা, এমন কি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে যারা বিদেশী রাজনীতির তল্পীবাহক হয়ে কাজ করেন,তাদের যতটানা অপরাধী মনে করা হয়,তার চেয়েও বেশী অপরাধী মনে করা হয় যারা সঠিক ভাবে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন তাদের। আল্লাহর বাণী, “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে চাচ্ছ না? (নূহ্ ১৩)। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও যুক্তিসংগত পন্থায় যে দাওয়াত দেয়া হয়, তা নিযে বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং যুক্তির জবাব যুক্তির মাধ্যমে দেয়ার পরিবর্তে অন্ধ আবেগ ও উন্মত্ত হিংস্রতা দিয়ে তার জবাব দেয়া হয়। একটা বাতিল ব্যবস্থায় স্বার্থপর হোতাদের এটাই বৈশিষ্ট্য যে,তারা যুক্তির জবাবে উস্কানী ও উত্তেজনা এবং প্রমাণের জবাবে হিংস্রতা সৃষ্টি করে। এটা হচ্ছে ধর্মীয় বিকৃতির ফল। রাসূল (সা.)-এর তাওহীদের ঘোষণার পর আওয়ায উঠলোঃ কা‘বার অবমাননা করা হয়েছে, হারাম শরীফের সম্মানহানি করা হয়েছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মাথায় রক্ত চড়িয়ে দেয়ার মত উস্কানীদায়ক কাজ প্রচন্ড উত্তেজনায় বেসামাল ও আবেগে দিশেহারা কুরাইশরা চারদিক থেকে ধেয়ে আসলো। গোলযোগের সূত্রপাত হলো। রাসূল (সা.) ঘেরাও হয়ে গেলেন। হারেস বিন উবাই হৈ চৈ শুনে রাসূল (সা.) কে রক্ষা করতে ছুটে এলেন। কিন্তু তরবারীর আঘাতে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। আরবে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘাতে এটাই ছিল ইসলাম রক্ষার লক্ষ্যে সংঘটিত প্রথম শাহাদাত। কুরাইশদের মধ্যে এতটুকু ভাববার সময় ছিলনা যে কা‘বা ঘরে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ও অধিকার আছে? তাছাড়া মুহাম্মাদ(সা.)-এর প্রচারিত মতাদর্শে যদি ত্রুটি থাকে সে ত্রুটি শুধরাবার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। আসলে কোন বাতিল ব্যবস্থার নেতাদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতা একেবারেই শেষ হয়ে যায় এবং তাদের চিন্তাভাবনা ও বিচার বিবেচনার যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে তাদের মধ্যে নানারূপ দু®কৃতি অনৈতিক ও গর্হিত কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা সমাজের সাধারন মানুষ জানলেও তার প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা.) সে সব নেতাদের বুনিয়াদী চরিত্রের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো থেকে বাঁচার জন্যে তাদের উপদেশ দিচ্ছিলেন। ফলে জনসাধারণের মধ্যে এসব কথা প্রচারিত হতেই তারা আতংকিত হলো। তারা উপলব্ধি করলো যে, লোকচক্ষে তাদের মর্যাদার অবনতি ঘটছে এবং সামনা-সামনি না হলেও অন্তত পেছনে অবশ্যই তাদের সমালোচনা হচ্ছে। পরন্তু কুরআন মাজীদে এই ধরনের দুশ্চরিত্র ও দু®কৃতিকারী লোকদের সম্পর্কে বারবার আয়াত নাযিল হচ্ছিলো এবং তাদের এই শ্রেণীর কীর্তিকলাপের জন্যে কঠোর আজাবের ভয় প্রদর্শন করা হচ্ছিলো। এ সকল আয়াত যখন সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হতে লাগলো, তখন কোথাকার পানি কোন্ দিকে গড়াচ্ছে,তা সবাই স্পষ্টত উপলব্ধি করতে পারলো। ইসলামের প্রসার যতই বাড়বে ততই তাদের সমস্ত কায়েমী স্বার্থ ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তিই ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। কাজেই এ নয়া বিপদের নাম নিশানা মুছে ফেলতেই নেতারা বিরোধীতার সব হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করলো। একটু ভাবতে চেষ্টা করি তো সেই পরিবেশটা আর আজকের পরিবেশের পার্থক্য কোথায়? যেখানে আমাদের সকলের ইহ-পরকালের কল্যাণের জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একেবারেই নিরস্ত্র ও নিসম্বল অবস্থায় আপন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)।
অপপ্রচার
সত্যের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রমাণ সহকারে বক্তব্য দিতে অক্ষম লোকদের একমাত্র সম্বল হয়ে থাকে নেতিবাচক প্রচারণা। বিরোধিতার প্রথম স্তর সব সময়ই ঠাট্টা বিদ্রুপ, উপহাস ও কূটতর্কের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা সন্ত্রাস-গুন্ডামীর রূপ ধারণ করে। রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতের গুরুত্ব কমানোর উদ্দেশ্যে গালিগালাজের ঘৃণ্য ইতরামির পাশাপাশি রকমারি উপাধি প্রণয়নের কাজও শুরু করে দিল অপপ্রচারের দক্ষ কুশলীরা। কেউ বললো, এই ব্যক্তি পূর্বপুরুষদের চিরাচরিত ধর্মকে ত্যাগ করেছে বিধায় সে ধর্মত্যাগী। কখনো বলা হতো, সে নক্ষত্র পূজারী। কখনো যাদুকর, গণক, করি, জ্বিনে ধরেছে, ইত্যাদি শব্দ ব্যাবহার করতো। মক্কার প্রত্যেক অলিতে-গলিতে, সভা-সমিতিতে এ ধরণের প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হতো। এ ধরনের প্রচারণার ঝড় যখন উঠতো তখন সাধারণ মানুষের জন্য পরিবেশ যে কত ভারী ও শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠে এবং সঠিক পথের সন্ধান করা যে কত দুরূহ হয়ে উঠে তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। এরূপ পরিবেশে সত্যের সেই ক্ষুদ্র কাফেলা যে কী সংকটের সম্মুখীন ছিল, তা কল্পনা করাও বোধ হয় সহজসাধ্য নয়। সত্যের বাহকদের আজকের বিপদও সে পথেই এগুচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু পরিস্থিতি ও পরিবেশ যতই বিপদ সংকুল হোক, তা দৃঢ়চেতা ও কৃত সংকল্প সত্যের বাহকদের পথ রুখতে পারবে না। আল্লাহর বাণী, “আল্লাহ মানুষের জন্য যে অনুগ্রহ উন্মুক্ত করেন, তা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা।” (ফাতির-২)। অপপ্রচারে আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ কিছূ দিন বিশ্বাস করলেও অচিরেই তা নি¯প্রভ ও ম্লান হয়ে মানুষের মন তার প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে যায়। তাই এ কাজে যারা অভিজ্ঞ, তাদের মূলনীতি হলো নিত্যনতুন প্রপাগান্ডা আবিস্কার করে যেতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তারা নতুন শব্দ যোগ করে প্রচার চালালো যে, মুহাম্মদ (সা.) একটা পাগল, উম্মাদ ও নির্বোধ ছাড়া আর কিছু নয়। কুরআনুল কারীমে সূরা আল্ হিজরের ছয় নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, “তারা বলেঃ ওহে যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে ! তুমি তো একটা পাগল (উম্মাদ) ছাড়া আর কিছু নও।” কোন আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ও প্রধান ব্যক্তিত্বকে যখন এ ধরনের হীন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, তখন শুধু ঐ ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়াই আসল লক্ষ্য হয়না, বরং আসল লক্ষ্য হয়ে থাকে ঐ মতবাদ ও মতাদর্শকে এবং ঐ আন্দোলনকে হেয় করা ও তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা যার ক্রমবর্ধমান প্রসারে বিরোধীরা আতংকিত থাকে। মজার ব্যাপার হলো, একদিকে বাপদাদার ধর্মের সম্পূর্ণ বিরোধী নতুন ধর্ম প্রচারের দায়ে রাসূল (সা.) কে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। অপরদিকে সেই রাসূলের (সা.)-এর পেশ করা বাণীকেই প্রাচীন কিস্সা কাহিনী বলে নিন্দা করা হচ্ছিল। মতলববাজ কুচক্রীদের এটা চিরাচরিত স্বভাব যে, আগপাছ চিন্তা-ভাবনা না করে কখনো একদিক থেকে একটা খুঁত ধরে, আবার কখনো অন্যদিক থেকে আক্রমণ করে ঠিক তার বিপরীত আপত্তি তোলে। অথচ তারা ভেবেও দেখেনা যে, এভাবে তারা স্ববিরোধী আচরণই করছে। দুনিয়ার সুখ সমৃদ্ধি বাড়ানো এবং নিজেদের লোভ-লালসা ও কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া যাদের স্বভাব, তাদেরকেই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক মনে করা হয়। পক্ষান্তরে সমাজের সংস্কার ও সংশোধনের কর্মসূচী গ্রহণ করে যারা নিজেদের জীবনকে জনগনের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন, তাদেরকে নানা সময় নানা ধরনের যুগ উপযোগী ধারা বজায় রেখে স্থান কাল পাত্র ভেদে নতুন নতুন শব্দ তৈরী করে জনগণকে ধোকা দেয়ার প্রচেষ্টায় অপপ্রচার চালিয়ে তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়, যার ধারা আজো আছে এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
কুটতর্ক ও যুক্তি
যারা চাক্ষুষ সত্যকে মানতে চায়নী, তারা নিজেদের ও দাওয়াতদাতার মাঝে নানা রকমের কুটতর্ক বাধিয়ে অন্তরায় সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাতো। একটা ব্যর্থ হলে আরেকটা শুরু করা হতো। এ ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত লোকদের গোটাজীবনই এতে নষ্ট হয়ে যায়, অথচ তারা না পারে নিজেদের কোন উপকার করতে, আর না পারে অন্যদের কোন গঠনমূলক সেবা করতে। আন্তরিকতার সাথে যে প্রশ্ন ও আপত্তি তোলা হয়, তার ধরন হয় এক, আর চক্রান্তমূলকভাবে দাওয়াতদাতার পথ আটকানোর জন্য যে প্রশ্ন ও আপত্তি তোলাকে বলা হয় কুটতর্ক। কুটতর্ক সবসময় দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের প্রতীক হয়ে থাকে। কুটতর্ক কারীদের বৈশিষ্ট হলো, তারা দাওয়াত থেকে কিছুই শিখতে চায়না, বরং তাতে কৃত্রিমভাবে কোন না কোন বক্রতা অন্বেষণ করে। আল্লাহর বাণী, “ যারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত রাখতো এবং ওতে বক্রতা বের করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকতো; আর তারা পরকালেরও অমান্যকারী ছিল।” (হুদ-১৯)। তারা আরো বলতো এ কেমন নবী যে, আমাদের মতই বাজারে যায়, বিবাহ শাদী করে, তার সাথে কেন ফেরেশ্তা থাকেনা, কুরআন এক সাথে কেন নাযিল হলোনা। তুমিতো আমাদের মধ্য গরীব, তোমার উপর জুলুম করলেও কোন বিপদ নেমে আসেনা, কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে ইত্যাদি বহু ধরনের উদ্ভট তর্ক বিতর্ক করতো। কুটতর্কে এ তান্ডবের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হবার সময় রাসূল (সা.) যে মানসিক নির্যাতন ও কষ্ট ভোগ করেছেন, তার পুরো প্রতিচ্ছবি কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ স্তরটা ধৈর্যের সাথে পেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ পাক বলেছেঃ “ক্ষমার নীতি অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অজ্ঞ লোকদের এড়িয়ে চলো।” (আ‘রাফ-১৯৯)। রাসূল (সা.) আল্লাহ পাকের এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তাদের দুরভিসন্ধির মোকাবেলা করেছেন।
এরপর কুরাইশরা যুক্তির মাধ্যমে ইসলামের বিরোধিতার পথ বেছে নিলো। তারা মাঝে মাঝে যুক্তি দিয়ে বলতো, আমরা তো দেব মূর্তিগুলোকে আল্লাহর চেয়ে বড় কখনো মনে করিনা। আমরা শুধু বলি, এ মূর্তিগুলো যে সব মহান ব্যক্তির আত্মার প্রতীক, তারা আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করতে পাারে। এ সব মূর্তির সামনে সিজদা করে ও বলি দিয়ে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকি। এরকম যুক্তি বর্তমান কালেও আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। কতিপয় ভন্ডপীর ও মাজার পন্থীদের ধোকায় পড়ে সহজ সরল মুসলমানদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে তাদের ঈমান হারা করছে। তারা বলে মাজারে মান্নত করলে তাদের মনো বাসনা পূর্ণ হবে আর ভন্ডপীরের উছিলায় পরকালে নাজাত পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সে সময়ে কুরআন মাজীদে তাদের সে সব কুটতর্ক ও যুক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হচ্ছিলো। উদাহরণ স্বরূপ সূরায়ে কলমে রাসূল (সা.) কে সান্ত¡নার জন্যে বলা হলোঃ আপনার প্রতি আল্লাহ খুবই মেহেরবান। আপনি পাগল নন; আপনার প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুগ্রহ রয়েছে। কার জ্ঞান-বুদ্ধি বিকৃত হয়ে গেছে, তা খুব শীগ্রই জানা যাবে। আপনার প্রভু ভালো করেই জানেন যে, কে ঠিক পথে রয়েছে আর কে পথভ্রষ্ট হয়েছে। নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকুন। যারা ইসলামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চায়, তাদের কথা মোটেও কর্ণপাত করবেন না। তারা চায় যে, আপনি আপনার প্রচার কাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করুন তো তাদের তৎপরতাও শিথিল হয়ে আসবে। কিন্তু ঐ সব লোকের প্রবৃত্তি অনুসরণ করা আপনার কাজ নয়। আপনার আহবান যারা মানতে রাজী নয়, তাদের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। তারা যথাশিগ্রই জানতে পারবে যে, তাদের যে অবকাশ দেয়া হয়েছিলো, তার তাৎপর্য কি? আপনি জিজ্ঞেস করুনঃ আমি কি তোমাদের কাছে কিছু প্রার্থনা করছি? না নিজের ফায়দার জন্যে কিছু দাবি করছি? বা আমার কথার বিরুদ্ধে তোমাদের কাছে কোনো যুক্তি-প্রমাণ আছে? এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তাদের কাছে এ ধরনের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। আপনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মুকাবেলা করুন। যথাসময়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই। এ ধরনের বাণী বার বার নাযিল হাচ্ছলো। তাতে লোকদের স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হলো যে, সত্যের আহবায়ক না পাগল, না গণক, না কবি, না জাদুকর। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো তোমাদের সামনে রাখো এবং সত্যের আহবায়কের ভিতর তার কোন্ কোন্ লক্ষণ পাওয়া যায়, তা- ও বিচার করে দেখ। তিনি যে কালাম পেশ করেছেন, তাঁর প্রতিটি কাজের মাধ্যমে যে চরিত্র প্রতিভাত হচ্ছে এবং তোমাদের মাঝে তিনি যে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছেন, তার কোনটির সাথে পাগল, কবি ও জাদুকরের তূলনা হতে পারে?
সন্ত্রাস ও গুণ্ডামী
নেতিবাচক ষড়যন্ত্রের হোতারা যখন তাদের অপপ্রচার ব্যর্থ হতে দেখে, তখন গুন্ডামী ও সন্ত্রাসই হয়ে থাকে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। কুরাইশরা রাসূল (সা.)-এর সাথে যে অমানবিক আচরণ করেছে সে জাগায় তিনি ছাড়া অন্য কেউ হলে তিনি হতাশ হয়ে কাজ ছেড়ে দিতেন। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর ভদ্রতা , গাম্ভীর্যতা ও ধৈর্য সকল সহিংসতা ও গুন্ডামীকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মক্কার বড় বড় মোড়ল ও গোত্রপতি তাঁর পথে নিয়মিতভাবে কাঁটা বিছাতো, তাঁর নামায পড়ার সময় ঠাট্টা বিদ্রুপ আর হৈ চৈ করতো। সিজদার সময় তাঁর পিঠের ওপর জবাই করা পশুর নাড়িভূড়ি নিক্ষেপ করতো। চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিত, মহল্লার বালক বালিকাদেরকে লেলিয়ে দিত এবং কুরআন পড়ার সময় তাঁকে, কুরআনকে এবং আল্লাহকে গালি দিত। রাসূল (সা.)-এর সাথে এ ধরনের অমানবিক আচরণের সাথে জড়িত জ্ঞানপাপীরা ভেবেছিল এবার কুরআনের আওয়ায শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যাঁকে কাঁটা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো, তিনি সব সময় ফুল বর্ষণ করতে লাগলেন। যাঁর গায়ে ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করা হলো, তিনি জাতিকে ক্রমাগত ভালবাসার আতর গোলাপ বিতরণ করতে লাগলেন। যার ঘাড়ে নাড়িভূড়ির বোঝা চাপানো হলো, তিনি মানবজাতির ঘাড়ের ওপর থেকে বাতিলের ভূত নামিয়ে যেতে থাকলেন। যাঁর গলায় ফাঁস দেয়া হলো, তিনি সভ্যতার গলা থেকে বাতিল রসম রেওয়াজের শেকল খুলে ফেললেন। সহিংসতা আর গুন্ডামী এক মহূর্তের জন্যও ভদ্রতার পথ আটকাতে পারেনি। ভদ্রতা ও শালীনতার পতাবাহিরা যদি যথার্থই কৃত সংকল্প হয়, তবে মানবেতিহাসের শাশ্বত নিয়মের পরিপন্থী সন্ত্রাস ও গুন্ডামীকে এভাবেই চরম শাস্তি দিয়ে চিরতরে নির্মূল করে সমাজে শান্তি আনতে পারে। আর এ কাজে যারা এগিয়ে আসে তাদের জীবনই সার্থক। (চলবে…)