পূর্বে প্রকাশিতের পর
আকাবার দ্বিতীয় বাইয়া‘ত
নবুয়্যাতের তেরতম বছর হজ্জ উপলক্ষে মদীনা থেকে বাহাত্তর মতান্তরে তিহাত্তর জন অধিবাসী মক্কায় এলেন। যাদের মধ্যে দু‘জন মহিলাও ছিলেন। তারা আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি সময়ে অন্য সঙ্গীদের থেকে লুকিয়ে আকাবায় গিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হাতে ইসলাম কবুল করলেন এবং যে-কোন অবস্থায় রাসূল (সাঃ)-এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত, মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি, অংশীবাদীদের পতন ঘটিয়ে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী করার জন্যে বাইয়াত (শপথ) সম্পন্ন করলেন। এই লোকগুলো যখন শপথ গ্রহণ করছিলেন, তখন সা‘দ বিন জারারাহ (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন: “ভাইসব! তোমরা কি জানো, কোন কথার ওপর তোমরা শপথ গ্রহণ করছো? জেনে রাখো, এ হচ্ছে গোটা আরব ও অনারবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।” সকলে সমস্বরে বললো, “হ্যা” আমরা সব কিছু বুঝে-শুনেই শপথ গ্রহণ করছি।” ঠিক এই সময়েই মদীনার এই নও-মুসলিম এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মধ্যে স্থিরকৃত হয় যে, কোন সময় যদি মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় গমন করেন তো মদীনাবাসীরা সর্বতোভাবে তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। এই দলটির মধ্য থেকে বারো ব্যক্তিকে নকীব বা আহবায়ক নিযুক্ত করা হলো, যাতে তারা নিজ নিজ গোত্রের লোকদের এই বাইয়াতে শামিল করে নিতে পারেন। এদের মধ্যে সর্ব প্রথম রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বাইয়াত কারী বারা ইবনে মা‘রূর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ)-এর সাথে আমাদের এই বাইয়াত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে শয়তান আকাবার পর্বত শীর্ষ থেকে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলো যে, ওরকম বিকট চিৎকার আমি আর কখনো শুনিনি। সে চিৎকার করে বলছিলো, “হে মিনাবাসী ! মুজাম্মাম অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির সাথে সাবী অর্থাৎ ধর্মদ্রোহীরা যে যোগ সাজস করলো তা কি তোমরা লক্ষ্য করলে না? ওরা তোমাদের সাথে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে।” রাসূল (সাঃ) বললেন, “এ হলো আকাবার শয়তান আযেব ইবনে উযাইবের চিৎকার।” মুজাম্মাম অর্থ ধিকৃত বা নিন্দিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নাম মুহাম্মাদ অর্থ প্রশংসিতর বিপরিত শব্দ। মুশরিকরা তাঁকে এই নামে ডাকতো। আর যারা ইসলাম গ্রহণ করতো তাদেরকে বলতো সাবি অর্থাৎ ধর্মত্যাগী বা বে-দ্বীন। শয়তানের এ আওয়াজ পৌঁছে গেল কুরাইশদের কানে। সকালেই তারা ঘিরে ফেললো মদীনাবাসীদের। তারা হুংকার দিয়ে বললো আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমরা মুহাম্মাদকে নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করছো। মদীনাবাসীদের মধ্যে মুশরিকরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো “এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রই এখানে হয়নি এবং আমরা তেমন কিছু ঘটেছে বলে জানিনা।” অতঃপর আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদের সন্ধানে তারা চারিদিকে বেরিয়ে পড়লো। মক্কার নিকটবর্তী আযাখের নামক স্থানে সা‘দ বিন উবাদা (রাঃ) কে তারা ধরে ফেললো এবং উটের রশি দিয়ে বাঁধলো। তারপর তাঁকে পিটাতে পিটাতে চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে মক্কায় নিয়ে গেল। অমানুষিক নির্যাতন শুরু হলো ধারাবাহিকভাবে। সা‘দ (রাঃ) মক্কার কুরাইশদেরকে বাণিজ্যের জন্য মদীনার ওপর দিয়ে যাতায়াতের সময় সহযোগিতা করতেন। অথচ আজ তারাই তাঁকে নির্মম নির্যাতন করছে বিনা অপরাধে। ওদের নজরে অপরাধ সে ইসলামকে বিজয়ী করার শপথ করেছে। (আজো পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকেই ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য আওয়াজ তোলা হয়, সেখানেই আড়াল থেকে শয়তানের তোলা উষ্কানী ও বিভ্রান্তী মূলক আওয়াজের সাথে সূর মিলিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ শয়তান, একই ধরনের আওয়াজ তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে ইসলামের বিজয় প্রতিহত করার উদ্দ্যেশ্যে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে অবিরাম।)
মু‘জিজা
মু‘জিজা কথাটির সাধারণ অর্থ কোনো অলৌকিক বা অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় মু‘জিজা হচ্ছে এক প্রকারের চূড়ান্ত দলীল। কোন পয়গম্বরের নবুয়্যাতের দাবিকে প্রমাণ করার জন্যে আল্লাহ তা‘য়ালা চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে এই দলীলকে উপস্থাপন করেন। অবশ্য তার জন্যে শর্ত এই যে, দলীলের বিষয়বস্তুকে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়ঃ আগুনের কাজ হচ্ছে দাহ করা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা দাহ করবে না; সমুদ্রের ধর্ম হচ্ছে প্রবাহিত হওয়া, কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রবাহ থেমে যাবে; বৃক্ষের স্বভাব হচ্ছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে চলমান হবে। অনুরূপভাবে মৃত জীবিত হয়ে উঠবে, লাঠি সাপে পরিণত হবে ইত্যাদি। যেহেতু দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজের আসল কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘য়ালার মহিমা এবং তাঁর ইচ্ছা মাত্র, সেহেতু কোনো কোনো কাজ যেমন নির্ধারিত নিয়মে ক্রমাগত সস্পন্ন হতে থাকে, ঠিক তেমনি কোনো কোনো কাজ আল্লাহ তা‘য়ালারই মহিমায় এই স্বাভাবিক নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে কোনো অস্বাভাবিক নিয়মেও হতে পারে। আর যখন আল্লাহর ইচ্ছা হয়, তখন তা হয়েও থাকে। অল্লাহ তা‘য়ালা অধিকাংশ নবীকেই তাঁদের নবুয়্যাতের সত্যতা প্রমাণের জন্যে মু‘জিজার ক্ষমতা দান করেছিলেন। কিন্তু সে মু‘জিজা কাফিরদের ঈমান আনা ও বিশ্বাস পোষণের কারণ হিসেবে খুব কমই কাজ করেছে। আগেই বলা হয়েছে, মু‘জিজা হচ্ছে এক প্রকারের চূড়ান্ত দলীল। এজন্যে লোকেরা যখন মু‘জিজা দেখার পরও নবীকে অস্বীকার করেছে, তখন তাদের ওপর আল্লাহ তা‘য়ালা গজব নাযিল করেছেন এবং দুনিয়া থেকে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মক্কার কুরাইশরাও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে মু‘জিজা দাবি করছিলো। তাদের এই দাবিকে বার বার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কারণ আল্লাহ তা‘য়ালার নিয়মানুযায়ী কোনো জনগোষ্ঠীকে তাদের দাবি অনুসারে যদি কোন মু‘জিজা দেখানো হয়, তাহলে তারপর তাদের সামনে শুধু দু‘টি পথই খোলা থাকেঃ ঈমান অথবা ধ্বংস। কুরাইশদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার কোনো ইচ্ছা আল্লাহ তা‘য়ালার ছিলো না। সেজন্য তাদের দাবিকেও বার বার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে করতে যখন দীর্ঘ দশ-এগারটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো এবং লোকদেরকে বুঝানোর কাজও প্রায় শেষ হয়ে এলো তখন মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং অন্যান্য মু‘মিনদের মনের মাঝে আগ্রহ জাগতে লাগলোঃ হায়! আল্লাহর তরফ থেকে যদি কোনো অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ পেতো, যা দেখে অবিশ্বাসী লোকেরা ঈমান আনতো এবং ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো। কিন্তু তাঁদের আগ্রহের জবাবে বলা হচ্ছিলোঃ “অধৈর্য হয়ো না। যে ধারা ও নিয়মে আমি আন্দোলন পরিচালিত করছি, ঠিক সেভাবে ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে তুমি কাজ করতে থাকো। মু‘জিজার দ্বারা কাজ হাসিল করতে চাইলে তা অনেক আগেই সম্পন্ন হয়ে যেতো। আমি যদি ইচ্ছা করতাম তো এক-একটি কাফিরের অন্তর মোমের মতো নরম করে দিতাম এবং তাদেরকে জোরপূর্বক সুপথে চালিত করতাম। কিন্তু এটা আমার নীতি নয়। এভাবে না মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার কোনো পরীক্ষা হয়ে থাকে, আর না তার চিন্তাধারা ও নৈতিক জীবনে আদর্শ সমাজ গড়ার উপযোগী কোনো বিপ্লব আসতে পারে। কাজেই তোমাকে লোকদের বেপরোয়া আচরণ এবং তাদের অবিশ্বাসকে ধৈর্যের সঙ্গে মুকাবিলা করতে হবে। তার মানে এই নয় যে তাঁকে কোন মু‘জিজাই দেয়া হয়নি। তাঁর সবচেয়ে বড় মু‘জিজা হলো আল্ কুরআন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর ব্যক্তিসত্তা থেকে অসংখ্য মু‘জিজা প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ এবং তাঁর মহাকাশ ভ্রমণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এতদভিন্ন বহুতর ভবিষ্যদ্বাণীর সফল হওয়া, তাঁর দোয়ার ফলে পানি বর্ষিত হওয়া, লোকদের সুপথপ্রাপ্ত হওয়া, প্রয়োজনের সময় অল্প জিনিস বৃদ্ধি পাওয়া, রুগ্ন ব্যক্তির আরোগ্য লাভ করা, পানি প্রবাহিত হওয়া ইত্যাকার অসংখ্য মু‘জিজা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার ১৪ দফা :
১। আল্লাহর আইনের আনুগত্য করা। মানব রচিত মতবাদ দিয়ে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সুদুর পরাহত। তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ২। পারিবারিক জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলার জন্য পিতা-মাতার সাথে ভাল আচরণ করা। ৩। সামাজিক বন্ধন মজবুত করার জন্য আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল আচরণ করা, তাদের হক এবং মিসকীন ও পথিক (মুসাফির) দের হক আদায় করা। ৪। অপচয় না করা। আল্লাহ বলেন তোমরা অপচয় করো না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয় খরচ এবং আত্মীয় স্বজনের ফকির-মিসকীনের হক আদায় না করে বিভিন্ন খাতে প্রচুর টাকা অপচয় করি। ৫। আয়-ব্যয় ভারসাম্য রাখতে হবে। ভারসাম্যহীন জীবন মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে তাই আয় এবং ব্যয়ের সাথে সংগতি রেখে খরচ করতে হবে। বেহিসাবী খরচ যেমন করা যাবে না তেমনি আবার কৃপন ও হওয়া যাবে না। ৬। রিযিক বন্টনের ব্যাপারে আল্লাহর যে নীতি কাউকে বেশী আবার কাউকে কম দিয়েছেন। তা মেনে নেওয়া। এ নীতি অত্যন্ত যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং এ নীতি ধনী গরীব সকলের জন্য কল্যাণকর। ৭। নিজ সন্তান হত্যা না করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা গরীব হয়ে যাওয়ার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। তাদের ও তোমাদের রিযিক আমি দেবো’। খাওয়া-পরার ভয়ে নিজ সন্তানকে হত্যা করা বড় ধরনের অপরাধ। আমাদের উচিত সন্তানদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়ে তাদেরকে সুশিক্ষিত করে সম্পদে পরিণত করা। ৮। জ্বেনা ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা রোধ করা। জ্বেনা ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জন্য এক ভয়ংকর মহামারী। অশ্লিলতার কারণে নৈতিক ও চরিত্রহীন যে সমাজ গঠিত হয় তা জাতির জন্য অভিশাপ। ৯। বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন- ‘জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তোমরা এই আদেশ মেনে চলবে যে কাউকে হত্যা করবে না’। কারণ মানুষের জীবন আল্লাহর নিকট অতি পবিত্র। তাই মানুষ হত্যা তিনি হারাম করেছেন। এ আদেশের মধ্যে গুপ্ত হত্যা, বিনা বিচারে হত্যাসহ সকল প্রকার খুন, গুম ও অপহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১০। ইয়াতিমের সম্পদ সংরক্ষণ করা। মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কখন এতিমের মাল স্পর্শ করো না’। কিন্তু এতিম যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞন বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়ার মত বয়সে না পৌঁছে ততদিন পর্যন্ত তার সম্পত্তি দেখাশুনা করা উত্তম। ১১। ওয়াদা, চুক্তি ও অংগীকার পালন করা, ওয়াদা বা চুক্তি বা ব্যক্তিগত হোক বা রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক যে পর্যায়ের হোক যে কোন চুক্তি তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ১২। ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা। বর্তমান অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফভিত্তিক বিলি বন্টন না থাকার কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। একদল লুটেরা ও আরেক দল বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছে। ১৩। অনুমানভিত্তিক কোন কাজ করবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত মনগড়া অনুমান নির্ভর না হয়ে শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও চিন্তা শক্তিসহ প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলে বিপদগামী বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ১৪। অহংকার পরিহার করা। আল্লাহ বলেন- তোমরা জমিনের উপর দিয়ে কখনও গর্ব করে চলাফিরা করো না। তোমাদের গর্ব, অহংকার যমীন ভাঙতে পারবে না এবং পাহাড়ের সমান ও উঁচু হতে পারবে না। অহংকার আল্লাহর চাদর এটি শুধু তাঁর জন্য। আল্লাহর বান্দার জন্য অহংকার শোভা পায়না। অতীতে অনেক জাতি, বড় স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী, গর্ব অহংকার করে ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই আমাদের উচিত গর্ব, অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করা। আধুনিক পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র যদি এসব ধারাগুলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর করা হয় তাহলে আর কি এমন কোন চোরা পথ খোলা থাকে যে পথ ধরে সমাজে অশান্তি ঢুকতে পারে?
বিদায়, হে মক্কা! (হিজরত)
অস্থিতিশীল নিমজ্জমান সমাজ ব্যবস্থার শেষ অস্ত্র হয়ে থাকে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও নির্যাতন নিপীড়ন। এতেও যদি প্রতিপক্ষকে দমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিরোধীরা শান্তি আন্দোলনের মূল ব্যক্তিকে হত্যা করতে সিদ্ধান্ত নেয়। মক্কবাসীতো আগে থেকেই আক্রোশে অধীর ছিল কিভাবে মুহাম্মাদ সা.কে নির্মূল করা যায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। এবার চরম মূহুর্ত উপস্থিত। ইসলামী আন্দোলনের মূল ব্যক্তিসহ সাথীদের জন্য মক্কা জ্বলন্ত আগুনের রূপ ধারণ করল। কোরায়েশ নরপশুরা তাদের যুলুমের ষ্টীম রোলার চালিয়ে সত্যের নিশানাবাহীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুললো। রাসূল সা. এর রক্তপিপাসু দুশমনেরা তাঁর বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর চক্রান্তের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলো। এই কঠিন পরিস্থিতে মি‘রাজ থেকে এসে রাসূল সা. উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিলেন। আভাসে ইংগিতে তিনি হিজরতের পথ উন্মুক্ত হওয়ার ও তারপর ক্ষমতার যুগ শুরু হওয়ার আশ্বাস দিলেন। এই শুভ সংবাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হলো। যারা সহিংসতার স্বীকার হয়েছিল, তারা সান্ত্বনা পেল এবং তাদের ও উৎসাহ বৃদ্ধি পেল। এছাড়াও আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর বাণীর মাধ্যমে হিজরতের জন্য বার বার ইশারা দিতে লাগলেন। “হে আমার বান্দাগণ ! তোমরা শুধু আমারই ইবাদত করতে থাকো। আমার ইবাদতের কারণে যদি স্বদেশের জমিন তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে যায় তাহলে সেজন্যে কোনো পরোয়া করোনা; আমার জমিন অত্যন্ত প্রশস্ত।” (সূরা আন্কাবুত-৫৬) অর্থাৎ এজন্যে যদি ঘরবাড়ীও ছেড়ে দিতে হয় তো তাই কর; কিন্তু আমার বন্দেগীর সম্পর্ক ছিন্ন করো না। হিজরত শব্দের শাব্দিক অর্থ ত্যাগ করা, বর্জন করা। মনের অসন্তষ্টি চিত্তে কোন কিছু ত্যাগ করা। ইসলামী পরিভাষায় ঃ দীন-ইসলামের জন্যে নিজের দেশ ছেড়ে এমন স্থানে গমন করা যেখানে দীনের প্রয়োজন সমূহ পূর্ণ হতে পারে। কারণ ইসলামী ধারায় জীবন-যাপন করার এবং আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানানোর আজাদী যে দেশে নেই, সে দেশকে শুধু আয়-উপার্জন, ঘর-বাড়ী, ধন-সম্পত্তি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের মায়ায় আঁকড়ে থাকা মুসলমানের পক্ষে জায়েজ নয়। মনে রাখতে হবে যে,কুফরী রাষ্ট্র বলতে শুধু কাফির, মুশরিক ও নাস্তিকদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রকেই বুঝায়না, বরং এমন প্রত্যেক রাষ্ট্রকে বুঝায়, যে সকল রাষ্ট্রে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ বলে বিশ্বাস করে, সে সকল রাষ্ট্রের অধিবাসী বা শাসকবৃন্দ ‘মুসলিম’ নামে পরিচিত হলের কার্যত তাতে কিছু আসে যায় না। আল্লাহর দীনের প্রতি ঈমান পোষণকারীর পক্ষে কোন কুফরী ব্যবস্থার অধীনে জীবন-যাপন করা কেবল দু‘টি অবস্থায় সংগত হতে পারে। একঃ সংশ্লিষ্ট দেশে ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কুফরী ব্যবস্থাকে ইসলামী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার জন্যে সে ক্রমাগত চেষ্টা-সাধনা করতে থাকবে। যেমন, এযাবত মক্কায় থেকে মুসলমানরা যেরূপ চেষ্টা-সাধনা করে আসছিলো এবং এর জন্যে সর্বপ্রকার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করছিলো। দুইঃ সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে বেরোবার কোনো পথ যদি সত্যিই না থাকে কিংবা ইসলামী ধারায় জীবন-যাপন ও ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত চেষ্টা-সাধনা করার উপযোগী কোন জায়গা যদি সে খুঁজে না পায়। কিন্তু দীনের প্রয়োজন পূর্ণ হবার উপযোগী জায়গা যখনি পাওয়া যাবে-মদীনা থেকে যেমন প্রত্যাশা করা গিয়েছিলো- তখন অবশ্যই তাদের হিজরত করে সেখানে চলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, হিজরতের জন্যে কোনো দারুল ইসলাম বর্তমান থাকা অপরিহর্য নয়। মুসলমানগণ প্রয়োজন হলে যে কোনো পাহাড়-জংগলে জীবন যাপন করতে পারে,কিন্তু তাদের পক্ষে কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিঃশ্চিন্তে আনুগত্য করা চলবেনা। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের নিকট যে কোন জিনিসের চেয়ে তার দীনের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব অনে বেশী। তবে এক্ষেত্রে যারা নিতান্তই অক্ষম ও পংগু এবং যারা অসুস্থতা কিংবা দারিদ্র্যের কারণে কোনো প্রকারেই হিজরতের জন্যে সফর করতে সক্ষম নয়, কেবল তারাই ক্ষমা পাবার যোগ্য।
সাধারণ মুসলমানদের হিজরত
আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথের পর থেকেই মদীনায় ইসলামের অগ্রগতি হচ্ছিলো। শুধু অগ্রগতিই নয়, যে কোন পরিস্থিতিতে তারা মুসলমানদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারেও অংগীকারাবদ্ধ হয়েছিলো। মক্কায় মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতির সময় নির্যাতিত মুসলমানদেরকে রাসূল সা. মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা টের পেয়েই কুরাইশরা মুসলমানদেরকে বিরত রাখার জন্যে জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো এবং মুসলমানরা যাতে তাদের নাগাল থেকে বেড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্যে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদের ধন-প্রাণ ও সন্তা-সন্ততির জীবন বিপন্ন করেও নিছক দীনের খাতিরে দেশত্যাগ করাকেই পছন্দ করলো। কোনো প্রলোভন বা ভয়-ভীতিই তাদেরকে বিরত রাখতে পারলো না। একের পর এক সাহাবীগণ মদীনায় চলে যেতে লাগলেন। রাসূল সা.এর সংগে থেকে গেলেন হযরত আবু বকর ও আলী (রা:)। আর কিছু সাহাবী থেকে গেলেন যারা দারিদ্র ও শারীরিক অক্ষমতার কারণে হিজরত করতে অসমর্থ ছিলেন। মহল্লার পর মহল্লা খালি হয়ে গেল। একবার আবু জাহল সহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কুরাইশ নেতারা বনু জাহশ গোত্রের শূন্য বাড়ীঘর দেখে বলতে লাগলোঃ ‘এটা আমাদেও ভাতিজা (মুহাম্মাদ)এর কীর্তি। সে আমাদের ঐক্য ভেঙ্গে দিয়েছে’। সাথীদের মদীনা চলে যাওয়া সত্বেও রাসূল সা. নিজ দাওয়াতের কেন্দ্র ভূমি ত্যাগ করেননী। তিনি আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষায় রয়ে গেলেন। (চলবে…)