সাধারণ মুসলমানদের হিজরত
আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথের পর থেকেই মদীনায় ইসলামের অগ্রগতি হচ্ছিলো। শুধু অগ্রগতিই নয়, যে কোন পরিস্থিতিতে তারা মুসলমানদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারেও অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলো। মক্কায় মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতির সময় নির্যাতিত মুসলমানদেরকে রাসূল সা. মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা টের পেয়েই কুরাইশরা মুসলমানদেরকে বিরত রাখার জন্যে জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো এবং মুসলমানরা যাতে তাদের নাগাল থেকে বেড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্যে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদের ধন-প্রাণ ও সন্তান-সন্ততির জীবন বিপন্ন করেও নিছক দ্বীনের খাতিরে দেশত্যাগ করাকেই পছন্দ করলো। কোনো প্রলোভন বা ভয়-ভীতিই তাদেরকে বিরত রাখতে পারলো না। একের পর এক সাহাবীগণ মদীনায় চলে যেতে লাগলেন। রাসূল সা.এর সঙ্গে থেকে গেলেন হযরত আবু বকর ও আলী (রা:)। আর কিছু সাহাবী থেকে গেলেন যারা দারিদ্র ও শারীরিক অক্ষমতার কারণে হিজরত করতে অসমর্থ ছিলেন। মহল্লার পর মহল্লা খালি হয়ে গেল। একবার আবু জাহলসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কুরাইশ নেতারা বনু জাহশ গোত্রের শূন্য বাড়ি-ঘর দেখে বলতে লাগলোঃ ‘এটা আমাদের ভাতিজা (মুহাম্মাদ)এর কীর্তি। সে আমাদের ঐক্য ভেঙ্গে দিয়েছে। আমাদের সমাজকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভাংগন লাগিয়ে দিয়েছে।’ সাথীদের মদীনা চলে যাওয়া সত্ত্বেও রাসূল সা. নিজ দাওয়াতের কেন্দ্রভূমি ত্যাগ করেন নি। তিনি আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষায় রয়ে গেলেন। কুরাইশরা যাদের আটক রেখেছিল কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে যেতে বাঁধা দিয়েছিল, এমন স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া তেমন কোন মুসলমান আর মক্কায় অবশিষ্ট্য ছিলনা। তবে ঘনিষ্ট সাথীদের মধ্যে হযরত আবু বকর ও হযরত আলী (রা:) তখনো মক্কায় ছিলেন।
মুহাম্মাদ (সা.)কে হত্যা করার সলা-পরামর্শ
সাহাবীগণ হিজরত করে মদীনায় চলে যাওয়ার পর রাসূল (সা.) হিজরতের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় মক্কায় রয়ে গেলেন। কুরাইশরা চিন্তায় পড়ে গেল এই ভেবে যে, মুসলমানগণ একে একে সবাই মদীনায় গিয়ে শক্তি সঞ্চার করছে এবং সেখানে ইসলাম ক্রমশঃ প্রসার লাভ করছে। তাই তারা রাসূল (সা.)-এর দেশত্যাগের ব্যাপারে আসন্ন জাতীয় দুর্যোগ মনে করে এর থেকে উত্তরণের পন্থা বের করার জন্যে ‘দারুন-নাদওয়ায়’ পরামর্শ সভার আয়োজন করলো। এই গৃহটি ছিলো কুসাই ইবনে কিলাবের বাড়ি। মক্কার মুশরিক কুরাইশরা যে কোন জাতীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনার জন্য এখানে সমবেত হত। এবার তারা রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নির্ধারিত দিনে সেখানে সমবেত হওয়ার জন্য আহবান করলো। এই দিনকে তারা ‘গণসমাবেশ দিবস’ নামে অভিহিত করলো। তাদের পরামর্শ গৃহে প্রবেশ পথে ইবলিস শয়তান কম্বল জড়িয়ে এক বৃদ্ধের বেশে দাঁড়ালো। তাকে দেখে সবাই বললো, “এই বৃদ্ধলোকটি কে?” সে বললো, “আমি নাজদের অধিবাসী। তোমরা যে উপলক্ষে আজ সমবেত হয়েছো, তা আমি শুনেছি। তাই তোমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য এসেছি। আশা করি আমার উপদেশ ও তোমাদের কাজে লাগতে পারে।” একথা শুনে সবাই তাকে পরম সমাদরে ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। সে সবার সাথে প্রবেশ করলো। ততক্ষণে কুরাইশদের বড় বড় নেতারা ভেতরে আসন গ্রহণ করেছে। অতঃপর রাসূল (সা.) সম্পর্কে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “এই লোকটির তৎপরতা বর্তমানে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তোমরা সবাই তা জান। সে তার বাইরের অনুসারীদের নিয়ে কখন যে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার কোন ঠিক নেই। তার আক্রমণ থেকে আমরা এখন নিরাপদ নই। অতএব,সবাই মিলে তার ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।” সলা পরামর্শ চলতে থাকলো। একজন বললো, “তাঁকে কোন লোহার তৈরী হাজতখানায় আটক করে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে দরজা বন্ধ করে রাখা হোক। এতে আপত্তি তুলে বলা হলো যে, সে এমন এক ব্যক্তি, যার কথা বদ্ধ লোহার ঘর থেকেও বাইরে চলে যাবে, আর তাঁর সাথীরা শক্তি অর্জন করলে তাঁকে বের করে নিয়ে যাবে। অন্য কোন উপায় খুঁজতে হবে।” শয়তান এ কথায় সমর্থন দিলে কণ্ঠ ভোটে এ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। মজলিসে জনৈক সদস্য প্রস্তাব দিল, ‘তাঁকে মক্কা থেকে বের করে দেয়া হোক।’ এ প্রস্তাবে আপত্তি তুলে বলা হলো, মুহাম্মাদ যেখানেই যাবে সেখানেই তাঁর আকর্ষণীয় কথাবার্তায় তাঁর পক্ষে জনমনে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার প্রভাব ঘটবে এবং ইসলামী আন্দোলন সামনে অগ্রসর হবে, এ আশঙ্কায় উক্ত প্রস্তাবও নাকচ করা হলো। অবশেষে আবু জেহেল প্রস্তাব উত্থাপন করলোঃ “প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে শক্তিশালী ও প্রতাপশালী যুবককে বেছে নিয়ে তাদের সবার হাতে তলোয়ার দিতে হবে; এরা সবাই এক সাথে মুহাম্মাদের উপর হামলা করবে এবং তাঁকে হত্যা করে ফেলবে। এভাবেই আমরা তাঁর ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে পারি। এতে মুহাম্মাদের খুনের দায়দায়িত্ব ও রক্তপণ সকল গোত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। বনু হাশিম গোত্র একাকী সব গোত্রের ওপর প্রতিশোধ নিতে সাহস করবে না। রক্তপণ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হবে। আমরা সকল গোত্র মিলে তাদেরকে রক্তপণ দিয়ে দেব।” শয়তান বললো, “এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না।” শয়তানের সমর্থনের পর এ অভিমতটি সবাই পছন্দ করলো, এবং এ কাজের জন্যে একটি রাতও নির্দিষ্ট করা হলো। নয়টি গোত্র থেকে বাঁছাই করে এগারোজন যুবককে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট রাতে মনোনীত ব্যক্তিগণ মুহাম্মাদ (সা.)-এর বাসভবন ঘেরাও করে থাকবে। ভোরে তিনি যখন বাইরে বেরোবেন, তখন তারা আপন কর্তব্য সমাধা করবে। এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ এই যে, আরবরা রাতের বেলায় অন্য কারো ঘরে প্রবেশ করাকে পছন্দ করতো না। তারা ষড়যন্ত্র করতে থাকলো আর আল্লাহ পাকও কৌশল করতে থাকলেন। আল্লাহ তা‘য়ালা দুশমনদের এই গোপন দূরভীসন্ধির কথা রাসূল (সা.)-কে অবহিত করতে থাকলেন। হিজরতের দু‘দিন আগে থেকেই তিনি হযরত আবুবকর (রা.)-এর সাথে পরামর্শ করেন যে তিনিও তাঁর সাথী হচ্ছেন। সফরের জন্যে দু‘টি উষ্ট্রী প্রস্তুত করা হলো এবং কিছু পাথেয় তৈরী করে নেয়া হলো।
অতঃপর সেই প্রতীক্ষিত সময়টি এলো, যখন তিনি মক্কা ছেড়ে মদীনায় গমন করার জন্যে ওহীযোগে নির্দেশ পেলেন। জিব্রিল (আ:)এসে মুহাম্মাদ সা.কে বললেন, “আপনি প্রতিদিন যে বিছানায় ঘুমান আজ রাতে সে বিছানায় ঘুমাবেন না।” রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নির্ধারিত ঘাতকের দল রাসূল সা.এর ঘরের দরজায় এসে সমবেত হয়ে ওঁত পেতে থাকলো। তিনি কখন ঘুমান তারা তার প্রতীক্ষা করতে লাগলো। রাসূল সা.তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি আলী (রা:)কে ডেকে বললেনঃ “আমি হিজরতের নির্দেশ পেয়েছি এবং আজ রাতেই মদীনা রওয়ানা হয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে বহু লোকের আমানত জমা রয়েছে। সকালে তুমি এগুলো লোকদের নিকট ফেরত দিও। আজ রাতে তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও,যেন আমি ঘরে আছি ভেবে লোকেরা নিশ্চিন্ত থাকে।”এত উঁচু মানের নৈতিকতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর আছে কি যে, যারা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে আর সে হত্যাকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার চিন্তায় বিভোর? কুরাইশরা ইসলাম বৈরিতার কারণে মুহাম্মাদ সা.এর রক্তের নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠেছিলো; কিন্তু এ অবস্থায়ও তারা মুহাম্মাদ সা.কে শ্রেষ্ঠ আমানতদার ও বিশ্বাসভাজন বলে মনে করে তাদের ধন-সম্পদ রাসূল সা.এর নিকট জমা রাখতো। ঘাতক দল বাড়ি ঘেরাও করে অপেক্ষায় প্রহর গুনছে আর তাদের ভিতর দিয়েই তিনি বেরিয়ে এসে সোজা আবু বকর রা.এর বাড়ী এসে হাজির হলেন। আসমা বিনতে আবু বকর দ্রুত নিজের কোমরের বেল্ট কেটে দুটো বানালেন এবংএকটি দিয়ে খাবারের পুটুলি ও অপরটা দিয়ে পানির মসকের মুখ বাঁধলেন। সত্যের পথের এই দুই অভিযাত্রী রাতের আঁধারে রওয়ানা হলেন। আজ বিশ্বমানবতার সবচেয়ে বড় উপকারী ও শুভাকাংখী, মানুষের পরীক্ষিত বন্ধু অতি আপন জন মুহাম্মাদ সা.একেবারেই বিনা অপরাধে ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আজ তিনি সেই সব অলিগলিকে বিদায় জানাতে জানাতে যাত্রা করছেন, যেখানে চলাফেরা করে তিনি বড় হয়েছেন,যার ওপর দিয়ে তিনি সত্যের বাণী সমুন্নত করতে হাজার হাজার বার দাওয়াতী সফর করেছেন, যেখানে তিনি অসংখ্য গালাগাল খেয়েছেন এবং নির্যাতন সয়েছেন। আজ তাঁর হারাম শরীফের পবিত্র আধ্যাত্মিক কেন্দ্র থেকে বিদায় নেয়ার পালা, যেখানে তিনি বহুবার সিজদা করেছেন, বহুবার আপন জাতির কল্যাণ ও সুখশান্তির জন্য দোয়া করেছেন, বহুবার কুরআন পড়েছেন, বহুবার এই চত্তরে নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত এই একমাত্র আশ্রয়স্থলেও বিরোধীদের হাতে নিপীড়িত হয়েছেন। শুনতে হয়েছে মর্মঘাতী বোলচাল। যে শহরের আকাশ বাতাস আজও তাঁর দোয়ায় মুখরিত, সেই শহরকে আজ তাঁর শেষ সালাম নিবেদন করতে হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তাঁর হৃদয় যে বিদীর্ণ হয়ে গেছে, কলিজা যে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, চোখে যে অশ্রুর বান ডেকেছে, সেটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও জীবনের লক্ষ্য অর্জনে যেহেতু এ কুরবানীর প্রয়োজন ছিল, তাই শ্রেষ্ঠ মানব এ কুরবানী দিতেও দ্বিধা করলেন না। সত্যের দাওয়াতের চারা গাছটি মক্কার মাটিতেই জন্মেছিল। কিন্তু তার ফল আহরণ করার সৌভাগ্য মক্কাবাসীর কপালে জোটেনী সত্যের বিরোধীতার কারণে। এ সৌভাগ্য অর্জন করলো মদীনাবাসী এবং সেই সাথে সারা দুনিয়াবাসী যারা তাঁর আদর্শ কবুল করে তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করলো। অথচ ঐ লোকগুলোই নিজেদেরকে বড় মনে করতো, অভিজাত ও কুলীন মনে করতো, আর নিম্ন মনে করা হতো তাদেরকে। আল্লাহ পাক তাদের জন্যই বরাদ্দ করলেন উচ্চুতর ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন দুনিয়া ও আখেরাতের জন্যে। রাসূল সা. শেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মক্কাকে বললেনঃ “ আল্লাহর কসম, তুমি আল্লাহর সর্বোত্তম ভূখন্ড এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা প্রিয় ভূখন্ড। আমাকে এখান থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া না হলে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতামনা।” কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সূর পর্বত গুহায় উপনীত হলেন।
কোন পথ ধরে যেতে হবে, সেটা স্বয়ং রাসূল সা.নির্ধারণ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন আরিকতকে নির্দিষ্ট মজুরীর ভিত্তিতে পথ প্রদর্শক নিয়োগও তিনিই করলেন। আবু বকরের ছেলে আব্দুল্লাহ রাতে মক্কার সমস্ত সংবাদ পৌঁছাতেন। আমের বিন ফুহাইরা (আবু বকরের ক্রীতদাস) মেষপাল নিয়ে সারাদিন গুহার আশপাশ দিয়ে চরিয়ে বেড়াতো আর সন্ধা হলে গুহার কাছে নিয়ে যেত, যাতে উভয়কে প্রয়োজনীয় দুধ সরবরাহ করতে পারেন। তিনি তিন দিন গুহায় কাটালেন।
এদিকে কুরাইশগণ সারা রাত রাসূল সা.এর বাড়ী ঘেরাও করে রাখলো। তাছাড়া পুরো শহরের সীমানাও বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু যখন জানতে পারলো যে, তাদের সেই কাংখিত ব্যক্তিটিই হাতছাড়া হয়ে গেছে,তখন তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। রাসূল সা.এর বিছানায় আলী রা: কে দেখে তারা গভীর হতাশায় ভেংগে পড়লো। চারিদিকে তালাশ করতে লোক পাঠানো হলো। একটা দল অনেক দোঁড়ঝাপ করে সূর পর্বতগুহায় এসে হাজির হলো। ভেতর থেকে তাদের পা দেখা যাচ্ছিলো। কী সাংঘাতিক নাজুক মুহূর্ত ছিল তখন তা, ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। আবু বকর এই ভেবে চিন্তিত হলেন যে,এরা গুহায় ঢুকে পড়লে রাসূল সা. এর জীবন ও গোটা ইসলামী আন্দোলন হুমকীর সম্মুখীন হবে। তাঁর এই অস্থিরতা লক্ষ্য করে মুহাম্মাদ সা. অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্তে বললেন,“ঘাবড়িও না,আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন।” কার্যত হলোও তাই। আল্লাহ তা‘য়ালার অনুগ্রহে গুহামুখে এমন কতিপয় নিদর্শন ফুটে উঠলো যে, তা দেখে কুরাইশরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তাদের মনে ধরণা জন্মালো যে,এ গুহার ভিতরে কেউ প্রবেশ করেনি। তিন দিন পর রাসূল সা. আবু বকর ও পথ প্রদর্শক আমের বিন ফুহাইরাকে নিয়ে বেরিয়ে রওনা দিলেন। কুরাইশ গোয়েন্দারা যাতে তাদের পিছু নিতে না পারে, সে জন্য সাধারণ চলাচলেন পথ বাদ দিয়ে সমুদ্রোপকূলের দীর্ঘ পথ অবলম্বন করা হয়। এদিকে মক্কায় ঘোষণা করা হয় যে, মুহাম্মাদ সা. কে যদি কেউ জীবিত বা মৃত অবস্থায় গ্রেফতার করে এনে দিতে পারে, তাহলে তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে। এই পুরস্কারের আশায় বহু লোক চারিদিকে বেড়িয়ে পড়লো রাসূল সা.এর সন্ধানে। সুরাকা বিন মালেক বিন জা‘সাম খবর পেল যে, এ ধরনের দু‘জনকে উপকূলীয় সড়কে দেখা গেছে। সে একটা বর্শ হাতে ঘোড়া হাঁকিয়ে রওনা হয়ে গেল। কাছাকাছি এসেই সুরাকা যখন ত্বরিত গতিতে ধাওয়া করলো, অমনি তার ঘোড়ার সামনের দু‘পা মাটিতে দেবে গেল। সুরাকা দু‘তিনবার ব্যর্থ চেষ্টা চালানোর পর ক্ষমা চাইল এবং একটা লিখিত নিরাপত্তানামাও চাইল। নিরাপত্তানামা লিখে দেয়া হলো। সে বুঝতে পারলো যে, এই ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। এই সফর কালে বারিদা আসলামীও পুরস্কারের লোভে সত্তর জন সাথীসহ বেরিয়ে ছিলো। কিন্তু রাসূল সা.এর সামনে আসা মাত্রই বারিদার মধ্যে পরিবর্তন এল। যখন রাসূল সা.তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, “তোমার অংশ নির্ধারিত হয়ে গেছে” (অর্থাৎ তুমিও ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে অবদান রাখবে এটা নির্ধারিত হয়ে গেছে)। তখন বারিদা সত্তর জন সাথীসহ ইসলাম গ্রহণ করলো। এরপর বারিদা বললো, ‘রাসূল সা. মদীনায় প্রবেশকালে তাঁর সামনে একটা পতাকা থাকা উচিত। রাসূল সা. সম্মতি দিলেন এবং নিজের পাগড়ি বর্শার মাথায় ঁেবধে বারিদার হাতে সমর্পণ করলেন। এই পতাকা উড়িয়ে কাফেলা মদীনায় প্রবেশ করলো। “অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষয়তির দ্বারা পরীক্ষা করা হবে। আর আহলে কিতাব ও মোশরেক-উভয় গোষ্ঠির নিকট হতে তোমাদের অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনতে হবে। এ সব পরীক্ষায় তোমরা অবিচল থাকতে পারলে এবং (অসৎ কাজ থেকে) বিরত থাকলে নিঃসন্দেহে সেটা হবে বিরত্বের কাজ।”( আল ইমরান,১৮৬)।
মাক্কী জীবন সমাপ্ত করা হলো। আগামীতে মাদানী জীবন ধারাবাহিক চলবে ইনশাল্লাহ।