Main Menu
أكاديمية سبيلي Sabeeli Academy

মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচনা

মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচনা বক্ষমান প্রবন্ধে রাসূল (সা.) মাক্কী জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়্যাতের মক্কী জীবন ও পর্যালোচনা
বক্ষমান প্রবন্ধে রাসূল (সা.) মাক্কী জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

পূর্বে প্রকাশিতের পর

চতুর্থ স্তরঃ ঈমানের অগ্নী পরীক্ষা
বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেন ঠিকই কিন্তু এবার তার চেয়েও কঠিন যুগের সূচনা হলো। যে শেষ আশ্রয়টি এ যাবত পরম স্নেহে রাসূল সা. কে শত্রুদের কবল থেকে রক্ষা করে আসছিল এবং কোন চাপ ও উস্কানীর কাছে নতি স্বীকার না করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সকল চক্রান্ত প্রতিহত করে আসছিল, সে আশ্রয়টি হারিয়ে গেল। অর্থাৎ চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করলেন। এর কিছু দিন পরই খাদীজা রা.ইন্তেকাল করলেন। যিনি শুধু স্ত্রী-ই ছিলেন না, ওহী নাযিলের আগ থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সত্যের পথে রাসূল সা.এর যথার্থ জীবন সংগিনীর ভূমিকা পালন করে গেছেন। ইসলাম প্রসারের জন্য তিনি প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছেন। পদে পদে পরাপর্শও দিয়েছেন এবং আন্তরিকতা সহকারে সহযোগিতাও করেছেন। এই বাহ্যিক দু’টি শক্তি হারিয়ে যাওয়ায় বিরোধিতা আরো প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। এবার বিরোধিতা ও নির্যাতন নিপীড়ন অতীতের সমস্ত রেকর্ড যেন ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু অল্লাহর ইচ্ছা সম্ভবত এই ছিল যে, ইসলাম নিজের হেফাজত নিজেই করুক, নিজের চলার পথ নিজেই তৈরী করুক এবং নিজের পায় দাড়াতে শিখুক। দুনিয়াবী সহায়গুলো এভাবে হটিয়ে না দিলে হয়তো সত্যের প্রাণশক্তি পুরোপুরি দৃশ্যমান হতে পারতোনা। এখন কুরাইশরা চরম অসভ্য আচরণ শুরু করে দিল। বখাটে ছেলেদেরকে তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিতে লাগলো। রাসূল সা. যখন নামায পড়তেন, তখন হাতে তালি দিত। পথে চলার সময় তাঁর ওপর নোংরা বর্জ্য নিক্ষেপ করা হতো। দরজার সামনে কাঁটা বিছানো হতো। কখনো তাঁর গলায় ফাঁস লাগানো হতো। কখনো তাঁর গায়ে পর্যন্ত হাত দেয়া হতো, প্রকাশ্যে গালাগালি করতো। মুখের ওপর মাটি ও থুথু নিক্ষেপ করতো। একবার আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল রাসূল সা. কে হত্যার উদ্দেশ্যে হাতে পাথর নিয়ে হারাম শরীফে ঢুকে পড়লো। রাসূল সা. হারাম শরীফে তার সামনেই ছিলেন। কিন্তু অল্লাহ তাঁকে হেফাজত করলেন, উম্মে জামিল তাঁকে দেখতেই পেলনা। অগত্যা সে ক্রোধ উদগীরণ করে কবিতা আবৃত্তি করলো “ আমরা নিন্দিত ব্যক্তির আনুগত্য প্রত্যখ্যান করেছি, তার আদেশ অমান্য করেছি এবং তার ধর্মের প্রতি শক্রতা পোষণ করেছি।” বস্তুত নাম বিকৃত করা এবং খারাপ শব্দ প্রয়োগ করা নৈতিক নীচতা ও অধোপতনের লক্ষণ। শত্রু যখন ইতরামির সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়, তখন এই সব নোংরা অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকে। অনুরূপভাবে একবার আবু জাহল পাথর দিয়ে আঘাত করে রাসূল সা. কে হত্যা করার মতলবে তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু অল্লাহ আবু জাহলকে সহসাই এমন ভীত ও সন্ত্রস্থ করে দেন যে, সে কিছুই করতে পারেনি। একবার শত্রুরা সদলবলে রাসূল সা. এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এই মর্মান্তিক ঘঁটনার বর্ণনায় আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আ‘স বলেন যে, রাসূল সা.এর ওপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে এমন বাড়াবাড়ি আর কখনো দেখিনি। এই দুঃখজনক ও দুঃসহ পরিস্থিতির কারণেই এ বছরটা দুঃখের বছর নামে আখ্যায়িত হয়। রাসূল সা.শুধু এতটুকুই বল্লেন যে, যে যুলুম নির্যাতনের ছুরি তোমরা আমার উপর চালাচ্ছো, ইতিহাসের শ্বাশত বিধান আল্লাহর আইন শেষ পর্যন্ত তোমাদের এই যুলুমের রাজত্ব একেবারেই খতম হয়ে যাবে। আর আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দ্বীনের ধারক-বাহকদের সাহায্য করে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন।
তায়েফে হৃদয়বিদারক ঘটনা
মক্কার পরিবেশ দিন দিন খারাবের দিকেই যাচ্ছিল। চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর রাসূল সা. মক্কায় বাহ্যত একেবারেই সহায়হীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিলেন। এখন কুরাইশরা মুসলমান ও মুহাম্মাদ সা.এর প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে উৎপীড়ন চালাতে শুরু করলো। তাইএবার তিনি মক্কার বাহিরে অল্লাহর বাণী প্রচার করার ফয়সালা করলেন। যায়েদ বিন হারেসাকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে রওনা দেন। পথিমধ্যে যে সব গোত্রের বসতবাড়ী দেখতে পান তাদের সবার কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। আসা যাওয়ায় তাঁর প্রায় এক মাস সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তায়েফের অধিবাসীরা ছিল খুবই স্বচ্ছল, সুখী এবং অত্যধিক ভোগবিলাস ও আরাম আয়েশে মত্ত। আর্থিক সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের অধিকারী হলে মানুষ সাধারণত আল্লাহকে ভুলে যায় এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার কাজে নিয়োজিত হয়। এর ফলে তায়েফবাসীরা ছিলো বেপরেরায়া ধরনের। অপর দিকে সুদখোরীর কারণে তাদের মানবতাবোধ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গিয়েছিলো। এদিক থেকে তায়েফ ছিলো মক্কার চেয়েও খারাপ জায়গা। প্রথমে তিনি তায়েফ গমন করে তায়েফের বড় বড় বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু সম্পদ ও ক্ষমতা যেমন প্রায়শই সত্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, এখানেও ঠিক তা-ই হলো। রাসূল সা.এর দাওয়াত প্রথ্যাখ্যান করে জনৈক তায়েফ সর্দার বিদ্রুপ করে বললো, ‘আল্লাহ কি তাঁর রাসূল বানাবার জন্যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাননি? সত্যিই যদি আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কা‘বা ঘরের গেলাফের অবমাননা করতে চান।’ আর এক জন বললো, ‘কী আশ্চর্য! আল্লাহ তাঁর রাসূল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কোন উপযুক্ত লোক পেলেন না!’ তৃতীয় জন বললো, ‘আমি তোমার সাথে কথাই বলতে পারিনা। কারণ, তুমি যদি সত্যবাদী হও তো তোমার সঙ্গে কথা বলা আদবের খেলাফ। আর যদি মিথ্যাবাদী (নায়ুজুবিল্লাহ) হও তাহলে তো তোমার সাথে কথা বলা যায় এমন যোগ্যতাই তোমার নেই।’ প্রতিটি কথা রাসূল সা.এর বুকে বিষমাখা তীরের মত বিদ্ধ হতে লাগলো। তিনি পরম ধৈর্য সহকারে মর্মঘাতী কথাগুলো শুনলেন। এর পর তারা শহরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বখাটে তরুণ, চাকর-নকরদেরকে রাসূলের পেছনে লেলিয়ে দিল এবং বলে দিল যে, যাও, এই লোকটাকে লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এসো।’ বখাটে যুবকদের এক বিরাট দল আগে পিছে গালি দিতে দিতে, হৈ চৈ করতে করতে ও পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে চলতে লাগলো। তারা তাঁর হাঁটু লক্ষ্য করে পাথর মারতে লাগলো, যাতে তিনি বেশী ব্যথা পান। পাথরের আঘাতে আঘাতে এক একবার তিনি অচল হয়ে বসে পড়ছিলেন। কিন্তু তায়েফের গুন্ডারা তার বাহু টেনে ধরে দাঁড় করাচ্ছিল আর পুনরায় হাঁটুতে পাথর মেরে হাতে তালি দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। ক্ষতস্থান গুলো থেকে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছিল। এভাবে জুতার ভেতর ও বাহির রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। তবুও জালিমরা অবিরাম তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ ও গালি- গালাজ বর্ষণ করতে থাকে। নির্যতনের চোটে অবসন্ন ও সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার পর যিনি রাসূল সা. কে ঘাড়ে করে শহরের বাইরে একটি আঙ্গুরের বাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই যায়েদ বিন হারেসা ব্যথিত হৃদয় বললেন, ‘ধাপনি এদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করেন।’ রাসূল সা. বললেন,“আামি ওদের বিরুদ্ধে কেন বদদোয়া করবো? ওরা যদি আল্লাহর ওপর ঈমান নাও আনে, তবে আশা করা যায়, তাদের পরবর্তী বংশধর অবশ্যই আল্লাহর ইবাদত করবে।” এই সফরকালেই জিবরীল এসে বললেন, ‘পাহাড় সমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতারা আপনার কাছে উপস্থিত। আপনি ইংগিত করলেই তারা ঐ পাহাড় দুটোকে এক সাথে যুক্ত করে দেবে, যার মাঝখানে মক্কা ও তায়েফ অবস্থিত। এতে উভয় শহর পিষ্ট ও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মানবতার দরদী মহান নবী এতে সম্মত হননি।
আঙ্গুরের বাগানে আশ্রয়কালে হুঁশ আসার পর দু‘রাকাত নামায পড়ে তিনি আল্লহর দরবারে দোয়া করলেনঃ ‘হে আমার রব! আমি আমার দুর্বলতা, সম্বলহীনতা ও জনগণের সামনে অসহায়ত্ব সম্পর্কে কেবল তোমারই কাছে ফরিয়াদ জানাই। দরিদ্র ও অক্ষমদের প্রতিপালক তুমিই। তুমিই আমার মালিক। তুমি আমাকে কার কাছে সঁপে দিতে চাইছ? আমার প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে, নাকি শত্রুর কাছে? তবে তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না থাক, তাহলে আমি কোন কিছুর পরোয়া করিনা। কিন্তু তোমার পক্ষ থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা পেলে সেটাই আমার জন্য অধিকতর প্রশস্ত। আমি তোমার আযাবে পতিত হওয়ার আশংকা থেকে তোমার সেই জ্যোতি ও সৌন্দর্য্যরে আশ্রয় কামনা করি, যার কল্যাণে সকল অন্ধকার দূরীভূত এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তোমার সন্তোষ ছাড়া আমি আর কিছু কামনা করিনা। তোমার কাছে ছাড়া আর কোথাও থেকে কোন শক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।”এহেন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির পর তিনি দাওয়াত দানের উদ্দেশ্যে ‘উকাজ’ নামক এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন। পথে ‘নাখলা’ নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে ফজরের নামাযে তিনি কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। এমনি সময় জ্বিনদের একটি দল ঐ দিক দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা মুহাম্মদ সা.এর কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায় এবং তারা সাথে সাথে ঈমান আনে যা সূরা আহকাফ-এ বর্ণিত হয়েছে। এঘটনার কথা পরবর্তীতে আল্লাহ পাক সূরা জ্বিন নাযিল করে রাসূল সা.কে জানিয়ে দেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে জানিয়ে দিলেন যে, মানুষেরা যদি ইসলামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে আমার সৃষ্টি জগতে এমন বহু জীব আছে, যারা আপনার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। (চলবে)

Related Post