জ্বিনদের হাকীকত
তায়েফের মর্মান্তিক ঘটনার পর রাসূল সা. মক্কাভিমুখে রওয়ানা দিলেন। ফেরার পথে তিনি ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করে শেষ রাতে ফজরের নামায শুরু করেন। ইয়ামানের নছীবাইন শহরের জ্বিনদের এক প্রতিনিধি দলও তখন সে জায়গা অতিক্রম করছিলো। তারা কুরআন পাঠ শুনে থমকে দাঁড়ালো। খুব মনযোগ সহকারে কুরআন পাঠ শুনলো এবং মুসলমান হয়ে তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করলো। এ ঘটনা সূরা আহকাফ- এ এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ “স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনতেছিল, যখন তারা তার (নবীর) নিকট উপস্থিত হলো, তারা একে অপরকে বলতে লাগলোঃ , চুপ করে শ্রবণ কর। অতঃপর যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তখন তারা তাদের স¤প্রদায়ের কাছে সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল। তারা বলেছিলঃ হে আমাদের স¤প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মুসা (আঃ)-এর পরে। এটা ওর পূর্ববতীঁ কিতাবের সত্যায়ন করে, এবং সত্যধর্ম ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের স¤প্রদায়! তোমরা আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি তোমাদের গোনাহ মার্জনা করবেন। কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া না দেয়, তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। এ ধরনের লোকেরাই প্রকাশ্য পথ ভ্রষ্টতায় লিপ্ত।” রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়ত লাভের পর থেকে জ্বিন জাতিকে আকাশের সংবাদ সংগ্রহ থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়। সে মতে তাদের কেউ সংবাদ শোনার জন্যে উপরে গেলে তাকে উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করা হত। জ্বিনরা এই নতুন পরিস্থিতির কারণ উদঘাটনে সচেষ্ট হল এবং তাদের বিভিন্ন দল কারণ অনুসন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। রাসূল (সাঃ) সেদিন ‘বাতনে নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। তিনি যখন ফজরের নামাযে কুরআন পাঠ করছিলেন, তখন জ্বিনদের অনুসন্ধানী দলটি সেখানে গিয়ে পৌঁছল। তারা কুরআন পাঠ শুনে বলতে লাগল, এই সে নতুন ঘটনা, যার কারণে আমাদেরকে আকাশের সংবাদ সংগ্রহে নিবৃত্ত করা হয়েছে। জ্বিনেরা পরস্পর বলতে লাগল, চুপ করে কুরআন শুন। রাসূল (সাঃ) নামায শেষ করলেন জ্বিনরা ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের স¤প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল এবং তদন্তকাজের রিপোর্ট পেশ করে একথাও বলল, আমরা মুসলমান হয়ে গেছি। তোমাদেরও ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। রাসূল (সাঃ) সূরা জ্বিন অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এই জ্বিনদের গমনাগমন এবং তাদের কুরআন পাঠ শুনে ইসলাম গ্রহণের বিষয় কিছুই জানতেন না। পরবর্তীতে আল্লাহ পাক সূরা জ্বিন নাযিল করে তাঁকে এ বিষয় অবহিত করেন। সূরা জ্বিন-এ এর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে। মক্কার কাফেরদের গর্ব অহংকার সেই সাথে ইসলাম গ্রহণ না করে রাসূল (সাঃ) এর প্রতি যে জুলুম করা হয়েছে তার ব্যর্থতা বুঝানোর উদ্দেশ্যে জ্বিনদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। জ্বিনরা অহংকার ও গর্বে মানুষের চেয়েও বেশি, কিন্তু কুরআনের বাণী শুনে তাদের অন্তরও বিগলিত হয়ে গেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করছে। অপর দিকে তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা জ্বিনদের চেয়েও বেশি জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনা দান করেছেন; কিন্তু তোমরা ইসলাম গ্রহণ করছ না।
আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে জ্বিনও একটি বিশেষ সৃষ্টি। জ্বিনদের শরীরী, আত্মাধারী ও মানুষের ন্যায় জ্ঞান এবং চেতনাশীল সৃষ্টজীব। তারা মানুষের দৃষ্টি গোচর নয়। এ কারণেই তাদেরকে জ্বিন বলা হয়। মানবসৃষ্টির প্রধান উপকরণ যেমন মাটি, তেমনি জ্বিন সৃষ্টির প্রধান উপকরণ অগ্নি। এই জাতির মধ্যেও মানুষের ন্যায় নর ও নারী আছে এবং সন্তান প্রজননের ধারা বিদ্যমান আছে। মানুষের ন্যায় জ্বিনদেরও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা আছে। এই কারণে তাদের প্রতিও আল্লাহর দেয়া বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহর ঘোষণা “আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানুষ ও জ্বিন জাতি সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত ৫৬) আর এ কারণে তাদের মধ্যেও ভালো-মন্দ দু‘টি শ্রেণী আছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে যাদেরকে শয়তান বলা হয়েছে, বাহ্যতঃ তারাও জ্বিনদের দুষ্ট শ্রেণীর নাম। জ্বিন ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করা কুফরী। অথচ বর্তমান যুগের বহু লোক এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত আছে যে, জ্বিন বলতে বাস্তবে কিছু নেই। বরং এটি প্রাচীন কালের কুসংস্কার ভিত্তিক বাজে একটি ধারণা। কোন প্রমাণ ছাড়াই তারা ধরে নিয়েছে যে, গোটা বিশ্ব-জাহানে শুধু তা-ই বাস্তব যা অনুভব করা যায় বা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আনা যায়। যে ব্যক্তি মনে করে যে, যা অনুভব করা যায় না তার কোন অস্তিত্ব নেই, আর যার অস্তিত্ব আছে তা অবশ্যই অনুভ‚ত হবে, সে আসলে নিজের বুদ্ধি-বিবেকের সংকীর্ণতারই প্রমাণ দেয়। এ ধরনের চিন্তাধারা অবলম্বন করলে শুধু জ্বিন নয় বরং এমন কোন সত্যকেই মানুষ মেনে নিতে পারবে না যা সরাসরি তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না এবং অনুভব করা যায় না। অবস্থা যদি এমনই হয় তাহলে সত্যকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা আল্লাহর অস্তিত্ব পর্যন্ত তাদের মেনে নেয়া সংশয় দেখা দিতে পারে। মুসলমানদের মধ্যে যারা এরূপ ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে কিন্তু কুরআনকেও অস্বীকার করতে পারেনি তারা জ্বিন, ইবলীস এবং শয়তান সম্পর্কে কুরআনের ¯পষ্ট বক্তব্যকে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিষয়ে পরিণত করেছে। কুরআনুল কারীমে এক জায়গায় নয় বহু জায়গায় জ্বিন ও মনুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে, এরা স্বতন্ত্র একটি জাতি। আবার জ্বিনদের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকে মানব সমাজে নানারূপ আজগুবি ধারণাও চালু রয়েছে। আরবেও জ্বিন সম্পর্কে বিশেষ মতবাদ গড়ে উঠেছিলো। মূর্খ লোকেরা তাদের পূজা করতো, তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতো। তাদের ধারণা ছিল জ্বিনরা গায়েবী বিষয়ের খবর জানে। সাধারণ ওঝা শ্রেণীর লোকেরা তাদের সাথে বন্ধুত্বের দাবি করতো। অসংখ্য দেব-দেবির জ্বিনদেরকেও আল্লাহর ব্যাপারে শরীকদার মনে করতো। যদিও জ্বিনদের কিছু অস্বাভাবিক আচরণের ক্ষমতা আল্লাহ পাক দিয়েছেন কিন্তু মানুষ জ্বিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মাখলুক। যেমন, মানুষের চেয়ে পশুরা কিছু শক্তির অধিকারী। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয়না যে, পশুরা মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম এসে এসব ভ্রান্ত আকীদাহ-বিশ্বাস বাতিল বলে ঘোষণা করেছে এবং আকীদাহ-বিশ্বাস সংশোধন করে দিয়েছে। ইসলামের স্পষ্ট ঘোষণা হলো জ্বিন আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র দখল নেই। সে আপন ক্ষমতাবলে না পারে কারো উপকার করতে আর না পারে কারো ক্ষতি করতে। মানুষের ন্যায় জ্বিনদের প্রতিও আল্লাহর ইবাদত করা ফরজ করা হয়েছে। তাদের মধ্যেও আল্লাহর অনুগত ও অবাধ্য এ দু‘টি শ্রেণী রয়েছে। তারাও মানুষের ন্যায় নিজ নিজ আমলের পুরস্কার বা শাস্তি লাভ করবে। আল্লাহর কুদরতের সামনে তারাও একটি অক্ষম ও অসহায় জীবন মাত্র। রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ দ্বীন জমিনে পাঠিয়েছেন। এ দ্বীনের আনুগত্য যেমন মানুষের জন্যে, তেমনি জ্বিনদের জন্যেও বাধ্যতামূলক। (চলবে…)