রমজান মাসের রোজা ফরজ হয় কখন ?

eid-mubarak-card

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون}[البقرة 183].
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।
(সূরা বাকারা:১৮৩)
উল্লেখিত আয়াতসহ পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা রোজা প্রসংগে বলছেন যে, রোজা এ উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছে। তবে ফরজের এ ধারা নতুন কোনো বিষয় নয়, পূর্ব হতেই এটি চলে আসছে। পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। সুতরাং রোজা আমরা ও পূর্ববর্তী উম্মত উভয়ের ওপরই ফরজ।
আয়াতের তাফসিরে কতিপয় আলেম মন্তব্য করেছেন, রোজা নামের মহান ইবাদতটি আদম আ. থেকে নিয়ে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী ও উম্মতের ওপরই ফরজ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে আলোচনা করেছেন। এর তাৎপর্য হচ্ছে, কঠিন একটি বিষয় যদি ব্যাপকতা লাভ করে তাহলে তার বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়। সকলে সহজভাবে গ্রহণ করে। এবং মানসিক প্রশান্তিও লাভ হয় অধিক।
সুতরাং রোজা সকল উম্মতের বিধান। সকলের ওপরই তা ফরজ করা হয়েছে। যদিও সময় ও ধরনে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
সাঈদ বিন জোবায়ের রহ. বলেন, পূর্ববর্তী যুগে রোজার নির্ধারিত সময় ছিল ইসলামের শুরু যুগের ন্যায় আতামাহ (আঁধার) থেকে নিয়ে পরবর্তী রাত পর্যন্ত।
ইমাম হাসান রহ. বলেন, রমজানের রোজা ইহুদীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা অমান্য করেছে। এবং বছরে কেবল এক দিনের রোজা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস হচ্ছে, এ দিনটিতে ফেরাউনের সলিল সমাধি ঘটেছে। তবে তারা এ ব্যাপারে মিথ্যা বলেছে। কারণ সে দিনটি ছিল, আশুরার দিন।
রোজা খ্রীষ্টানদের ওপরও ফরজ ছিল। দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত তারা তা নিয়মিত পালনও করে। কিন্তু কিছুকাল পর রোজার নির্ধারিত সময়টি প্রচন্ড গরমের মৌসুমে এসে পড়ে। তীব্র গরম তাই রোজা পালন তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দিকে সফর ও রোজগার কঠিন হয়ে যায়। এ নিয়ে তারা পরামর্শ সভার আয়োজন করে। ধর্মযাজক ও নেতৃবর্গের সম্মতিতে শীত ও গরমের মাঝামাঝি মৌসুম-বসন্তকালে রোজা পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আরো সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে রোজার এ সময়টি অপরিবর্তিত থাকবে। আর কখনো পরিবর্তন করা হবে না। শরিয়ত প্রবর্তিত সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনার কাফফারা স্বরূপ, নির্ধারিত ত্রিশ দিনের রোজার সাথে আরো দশ দিন বাড়িয়ে চল্লিশ দিন করা হয়।
{لعلكم تتقون} অর্থাৎ, রোজার মাধ্যমে যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। দেখা যাচ্ছে, রোজার মাঝে নিজেকে দমন ও কামরিপুর অপ অভিলাষকে চূর্ণ করার বিষয়টি বিদ্যমান। তাই রোজা তাকওয়া সৃষ্টিতে ফলদায়ক ভূমিকা রাখে।
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{فمن كان منكم مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين}
অর্থাৎ,তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা।
কেউ কেউ বলেছেন, এগুলো রমজানের বাইরের দিন। আর তা ছিল তিন দিন। আবার অন্যরা বলেছেন, রমজানের দিন। যুক্তি হিসাবে তারা বলেছেন, আল্লাহ তাআলা এগুলোর উল্লেখ এমন এক আয়াতে করেছেন যার পরই বর্ণিত হয়েছে। {شهر رمضان}
শরিয়ত বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইসলামের শুরুতে মুসলমানদেরকে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌রোজা ও ফিদিয়া এর যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে তারা স্বাধীন ছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
{وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين فمن تطوع خيرا فهو خير له وأن تصوموا خير لكم} [البقرة 184]
অর্থাৎ, আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর। {সূরা বাকারা:১৮৪}
অত:পর- فمن شهد منكم الشهر فليصمه} -সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।}(সূরা বাকারা:১৮৫)-
আয়াত নাযিল করে রোজা সকলের জন্য আবশ্যিক করে প্রদত্ত স্বাধীনতাকে রহিত করা হয়েছে। এর হিকমত হচ্ছে, বিধান প্রবর্তণে উম্মতের প্রতি সহজীকরণ ও ক্রমান্বয়িক নীতি পরিগ্রহণ। কারণ সিয়াম একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত । মুসলমানরা আগে থেকে এ ব্যাপারে খুব একটা অভ্যস্ত ছিলেন না। যদি সূচনাতেই এটি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হত তাহলে ব্যাপারটি তাদের জন্য কঠিন হয়ে যেত। তাই প্রথমে রোজা ও ফিদিয়ার মাঝে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অত:পর আস্তে আস্তে তাদের একীন মজবুত হয়েছে, মানসিক অবস্থা স্থিরতা লাভ করেছে এবং ধীরে ধীরে রোজার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। তখন স্বাধীনতা উঠিয়ে নিয়ে কেবল রোজাকে আবশ্যিক করা হয়েছে। কঠিন ও কষ্টসাধ্য বিধি-বিধানের ব্যাপারে ইসলামে এর বহু নজির বিদ্যমান। একে পরিভাষায় ক্রমান্বয়ে প্রবর্তণ বলা হয়।
তবে বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে, সিয়াম পালনে সক্ষম ব্যক্তির পক্ষে এ আয়াত রহিত। আর বার্ধক্য কিংবা আরোগ্য লাভের সম্ভাবনাহীন অসুস্থতার কারণে অক্ষম লোকের পক্ষে রহিত হয়নি। তারা প্রতি দিনের রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাবার দানের বিনময়ে রোজা পালন হতে অব্যহতি লাভ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। এ জন্য তাদের কাজাও করতে হবে না।
তবে সুস্থ হবার আশা আছে এমন অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা সফর জনিত অসুবিধার কারণে রোজা পালনে সাময়িক অক্ষম ব্যক্তিরা এ ছাড়ের আওতাভূক্ত হবে না। রোজার আবশ্যিকতা তাদের উপর বলবৎ থাকবে। সাময়িক অসুবিধার কারণে সময়মত রোজা পালন করতে না পারলেও পরে কাজা করতে হবে।
আল্লাহ বলেন,
{فمن شهد منكم الشهر فليصمه ومن كان مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر} [البقرة 185]
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। (সূরা বাকারা:১৮৫)
রমজান মাসের রোজা হিজরি দ্বিতীয় সালে ফরজ করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বমোট নয়টি রমজানের ফরজ রোজা পালন করেছেন। রমজান মাসের রোজা অবশ্য পালনীয় ও ইসলামের একটি রোকন। এর আবশ্যকীয়তাকে অস্বীকারকারী শরিয়তে কাফের হিসেবে গণ্য । ফরজ বলে স্বীকার করে বিনা ওজরে পালন না করলে গুরুতর পাপী হিসাবে বিবেচিত হবে। এসব লোকদের শাস্তি বিধান ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। আর তাদের করণীয় হচ্ছে তাওবা করা এবং ছেড়ে দেওয়া রোজাগুলোর কাজা করে নেওয়া।

Related Post