প্রতিটি মানুষ আল্লাহর গোলাম বা দাস। জীবনের সকল স্তরে এই দাসত্ব বজায় রাখাটাই মানব জীবনের সার্থকতা। মানব জীবনে অনেকগুলো স্তর পার হতে হয়। যেমন, শৈশবকাল, কৈশোরকাল, যৌবনকাল ও পারিবারিক জীবন ইত্যাদি। পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করার মাধ্যমেই মানুষের পূর্ণতা ঘটে। মানব জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল পারিবারিক সূত্রের পথ ধরেই। যে পরিবারের প্রথম বিন্যাস ছিল স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যামে। তারপর তা ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করেছে। স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন সকলেই পারিবারিক জীবনের সদস্য। সকলের সাথে সুসম্পর্ক ও অধিকার নিশ্চিত করার ওপরই পারিবারিক জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমেই একটি সুন্দর ও সুষ্ঠ জীবন গড়ে ওঠে, তাই পারিবারিক পবিত্রতা ও সুস্থতার ওপরই নির্ভর করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বময় মানবজাতির কল্যাণ। আল্লাহর দেয়া বিধান মতে যারা এ অধ্যায় পরিচালনা করতে পারেন তাদের নেতৃত্বেই এ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যার পদচারণা ও দর্শন আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে তিনি হচ্ছেন প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)। যার গোটা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই মানবজীবনের আদর্শ বিরাজমান। যেহেতু তিনি উম্মতের জন্য উত্তম আদর্শ, তাই তার পারিবারিক জীবনধারাও উম্মতের জন্য আদর্শ। রাসূল (সা.)-এর পারিবারিক জীবন ছিল ন্যায় ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি স্ত্রীদের সাথে যে রকম ব্যবহার করেছেন, তার সবকিছুই উম্মতের জন্য শিক্ষণীয়। রাসূল (সা.) পঁচিশ বছর বয়সে পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করে পৃথিবীতে পারিবারিক জীবনের মহান আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজে যেমন পরিবারের সকলের অধিকার বাস্তবায়ন করেছেন, তেমনিভাবে অন্যকে এ অধ্যায়ে সফলতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদের বলেছেন, আমার রাত ও দিনের সকল কাজ কর্মসমূহ মানুষের মাঝে প্রকাশ করে দাও যাতে মানুষেরা আমার অনুসরণ করতে পারে। তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।
রাসূল (সা.)-এর বৈবাহিক জীবন শুরু হয় খাদীজা (রা.)-কে দিয়ে। তার মৃত্যুর পর আরও দশজন স্ত্রী তিনি গ্রহণ করেন। একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাদের সকলের ন্যায্য অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। তিনি সকলকে সমানভাবে তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। রাত কাটানোর ক্ষেত্রেও তিনি সর্বাধিক সচেতনতা অবলম্বন করেছেন। রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী ছিলেন এগারো জন। ইসলাম প্রচার ও উম্মতের বৃহত্তর প্রয়োজনে তিনি এসকল মহিয়সী নারীদেরকে বিয়ে করেন। তাদের মধ্যে দুজন খাদিজা ও যায়নব (রা.) মহানবীর জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। বাকীরা সবাই রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে ইন্তেকাল করেছেন।
রাসূল (সা.)-এর পুণ্যবান স্ত্রীগণ হলেন:
যথাক্রমে, ১. খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ, ২. সাওদা বিনতে যুমআহ, ৩. আয়শা বিনতে আবু বকর, ৪. হাফসা বিনতে উমার, ৫. উম্মে সালামা ( হিন্দা বিনতে আবু উমাইয়্যা), ৬. জুয়াইরিয়া বিনতে হারেস, ৭. যায়নাব বিনতে জাহাস, ৮. যায়নাব বিনতে খুজায়মা, ৯. উম্মে হাবীবা ( রামলা বিনতে সুফিয়ান), ১০. সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই বিন আখতাব, ১১. মাইমুনা বিনতে হারেস, রাদিয়াল্লাহু তায়া‘লা আনহুন্না আজমায়ীন।
উল্লেখ্য যে, উপর্যুক্ত স্ত্রীগণ ব্যতীত আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে রাসূল (সা.)-এর বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু তাদের সাথে বাসর রাত হয়নি যেমন, উম্মে শুরাইক বিনতে জাবের এবং রাইহানা বিনতে যায়েদ। বলা হয়ে থাকে যে, তারা দাসীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। অনুরুপভাবে, মিশরের বাদশাহ মারিয়া কিবতিয়্যাহ নামক এক রমণীকে রাসূল (সা.)-এর জন্য হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়েছিলেন যার গর্ভে ইব্রাহীম জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ সুবহানাহু অতা‘য়ালা তাঁর মহান হিকমত বাস্তবায়নের জন্য তাঁর প্রেরিত শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়েছেন ও তাঁর জন্য বিশেষভাবে বৈধ করেছেন। যা অন্যান্য মুসলমনদের জন্য শুধুমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে সর্বোচ্চ চারজন নারীকে বিবাহ বন্ধনে রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণকে ‘উম্মাহাতুল মু‘মিনীন’ তথা সকল মু‘মিনদের মা’ হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
রাসূল (সা.)এর তিন ছেলে ও চার মেয়েসহ মোট সাতজন সন্তান ছিল। তাদের মধ্যে ছয়জন সন্তানই খাদিজা (রা.) গর্ভে জন্ম নেয়, শুধুমাত্র ইব্রাহীম যিনি মারিয়া কিবতিয়্যার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যান্য সন্তানদের নাম ছিল, কাসেম, আব্দুল্লাহ, যার উপাধি ছিল তাইয়্যেব এবং তাহের। মেয়েদের নাম ছিল, যায়নাব, রুকাইয়্যা, উম্মে কুলসূম ও ফাতেমা (রা.)।
রাসূল (সা.)-এর বহুবিবাহ ও বিভ্রান্তির অবসান
ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষীরা তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য রাসূল (সা.)-এর নবুয়্যাত থেকে শুরু করে যে সকল বিষয়সমূহকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাঁর বহুবিবাহ সম্পর্কে অপবাদ। এর মাধ্যমে তারা চাচ্ছে যে, রাসূল (সা.)-এর রেসালাত ওপর ঈমান আনা থেকে মানুষ বিরত থাকুক এবং মুসলিমরা তাদের ধর্ম ও নবীর ব্যাপারে সন্দেহে পতিত হোক। যাতে ঈমানের দাবী বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হয়। তাই যদি না হবে তাহলে গোটা আরব বিশ্ব যখন রাসূল (সা.)-এর ঘোরতর বিরোধীতায় লিপ্ত ছিলো, তাকে পাগল, মিথ্যুক, কবি, গণক ও জিনে ধরা রুগী বলতেও দ্বিধাবোধ করতোনা। এমনকি তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিলো। এতটা শত্রুতা করার পরও তারা তখন তাঁর চরিত্র নিয়ে কোন ধরণের অপবাদ দিতে পারেনি। রাসূল (সা.)-এর বহুবিবাহ যদি প্রবৃত্তির তাড়নায়ই হতো তাহলে এ সুযোগ তৎকালীন আরবরা কিছুতেই হাত ছাড়া করতো না। তাহলে আজকের দিনে যারা তাঁর এ বিষয় নিয়ে অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করছে, তারা কি রাসূল (সা.) সম্পর্কে আরবদের চেয়েও বেশি বুঝে? সত্য চিরদিনই সত্য, আর মিথ্যা সাময়িক প্রপাগাণ্ডা থাকলেও তা কোন দিনও সত্যে পরিণত হবে না। আর তথাকতিথ কাল্পনিক অপবাদের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় তারা সফল হতে পারবে না। অতএব, আজকের জাহেলরা যতই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর বানোয়াট তৎপরতা চালাক না কেন, কোন দিনও তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না।
রাসূল (সা.)-এর বহু বিবাহের মাহাত্ম্য ও উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিলো: নারী-পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষা কার্যক্রমকে উন্মুক্ত করা, সাম্যনীতি প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় বিধান স্পষ্ট করা, ধনী-গরীবের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক কৌশল, ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণে কিছুই করেননি। যে সকল মহিয়সী নারীদেরকে তিনি বিবাহ করেছেন তাদের প্রত্যকের জীবন বৃতান্তসহ বিবাহের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করলেই কপোটধারীদের বিবেক খুলে যাবে। আমরা এখানে সামান্য কিছু ইশারা দেয়ার চেষ্টা করছি, বিস্তারিত পরিসরে উল্লেখ করা এখানে সম্ভব নয়। (অত্র পত্রিকা অর্থাৎ মাসিক আল-হুদায় ধারাবহিকভাবে এসব মহিয়সী নারীদের জীবনী সবিস্তারে মহিলা সাহাবী ও আদর্শ নারী শিরোনামে প্রচারিত হয়ে আসছে)
প্রথমত: মানুষের জীবনের দুটি দিক রয়েছে, এক বাহিরের দিক, দুই আভ্যন্তরীণ দিক। কারো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে জীবনের এই উভয় দিকই উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। প্রকাশ্য জীবন হচ্ছে সকলের সামনে যা মানুষ করে থাকে। আর আভ্যন্তরীণ জীবন হচ্ছে তার পারিবারিক জীবন। আর পারিবারিক জীবন দ্বারাই একজন মানুষের চারিত্রিক নির্মলতা নির্ণয় করা যায়। কারণ, একজন মানুষের সত্যিকারের চরিত্র তার পরিবারের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি ভাল জানে। রাসূল (সা.)-এর প্রকাশ্য জীবন কেমন ছিলো সে সম্পর্কে তাঁর লক্ষ লক্ষ সাহাবায়ে কেরামগণের বর্ণনা দ্বারা জগৎবাসীর সামনে উন্মোচিত হয়েছে। অপর দিকে রাসূলের পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে খোলা-মেলা আলোচনা করেছেন তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ। পরিবার-পরিজনের সাথে তাঁর আচার-আচরণ কেমন ছিলো, রাতের ইবাদত কেমন করতেন, বিবিদের হক ঠিকমত আদায় করতেন কিনা ইত্যাদি বিষয় জগৎবাসীর নিকট স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর স্ত্রীগণ। সেখানেতো একজন স্ত্রীও তাঁর বিরুদ্ধে কোন ত্রুটির কথা বর্ণনা করেননি? তাহলে বিভ্রান্তকারীদের কেন এত দুশ্চিন্তা? মক্কার কুরাইশগণ যখন প্রস্তাব দিয়েছিলো যে, আপনি যদি ক্ষমতা চান তাহলে ক্ষমতা দেয়া হবে, বা কোন নারী লোভী হন তাহলে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারী দেয়া হবে, আপনি কি সম্পদ চান তাহলে সবচেয়ে বড় ধনী বানিয়ে দেয়া হবে, অথবা যদি জিনে ধরা রোগী হন তাহলে চিকিৎসা দেয়া হবে। এর চেয়েতে লোভনীয় প্রস্তাব আর কি হতে পারে? কই তিনিতো সেগুলোর একটিও গ্রহণ করেননি? বরং তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন, আমার এক হাতে যদি আকাশের চাঁদ আর অন্য হাতে সূর্য এনে দেয়া হয় তাহলেও আমি তাতে রাজি হব না এবং আমার মিশন থেকে কেউ আমাকে বিরত রাখতে পারবে না। তাহলে কেন তার বিরুদ্ধে আজকে অপবাদ দেয়া হচ্ছে ? আর এ অপবাদের বিশ্বাস যোগ্যতাই বা কি থাকতে পারে?
দ্বিতীয়ত: তিনি প্রবৃত্তির তাড়নায় বিয়ে করেন নি। যদি তাই হতো তাহলে পচিঁশ বছরের যুবক কেন চল্লিশ বছর বয়সী নারী খাদীজা (রা.)-কে বিয়ে করবেন। যা বর্তমান যুগে কল্পনাও করা যায় না। এমন কি খাদীজার সাথে পচিঁশ বছর সংসার করলেন, তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোন বিয়েও করলেন না। খাদীজার ইন্তেকালের পর রাসূল (সা.) জীবিত ছিলেন মাত্র তের বছর। এই তের বছরে রাসূল (সা.) বাকী দশজন স্ত্রী গ্রহণ করেছেন। প্রবৃত্তির কারণেই যদি হতো তাহলে যৌবনের সেই সোনালী দিনগুলোতেই একাধিক বিবাহ করতেন। একজন বৃদ্ধার সাথে যৌবন পার করতেন না।
তৃতীয়ত: হযরত আয়শা (রা:)-এর ব্যাপারে অল্প বয়সের অপবাদ। তাকে ছয় বছর বয়সে বিবাহ করেন এবং নয় বছর বয়সে রাসূল (সা.)-এর সাথে বাসর হয়। ডাক্তারী বিজ্ঞানেও প্রমাণিত যে, একজন মহিলা নয় বছরেও বালেগা হতে পারে। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে মানুষের শারিরীক কাঠামো বর্তমান সময়ের মানুষের সাথে তুলনীয় হতে পারে না। অন্যদিকে একেক দেশের মানুষের দৈহিক গঠন ও সক্ষমতা একেক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন, বর্তমানেও আরব দেশসমূহের মানুষের গঠন আর বাংলাদেশের মানুষের গঠন এক নয়। কাজেই বয়সের হিসেবেই সব দেশের মানুষের শারিরীক কাঠামো এক করে তুলনা করা নিতান্তই বোকামী ছাড়া আর কিছইু না। কাজেই একে অসম বিবাহ বলার কোন সুযোগই নেই। বরং সত্য উদঘাটনে অপবাদ কারীরা কুরআন- হাদীস ও বিভিন্ন সীরাত গ্রন্থে হযরত আয়শা (রা.) সহ রাসূলের প্রত্যেক স্ত্রীর জীবন বৃত্তান্ত ও তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব, চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে পারেন। তাহলেই তাদের সব ধরণের বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে। সর্বপরি কথা এটাই যে, রাসূল (সা.) কোন মহিলাকে ততক্ষণ পর্যন্ত বিয়ে করেননি যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি এসেছে। হযরত আয়শা (রা:)-এর বিবাহও ছিলো আল্লাহর আদেশে। আল্লাহ তায়‘ালা আমাদের সকলকে জীবনের প্রতিটি স্তরে রাসূল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণে জীবন গড়ার তাওফিক দিন এবং বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারীদের দূরভীসন্ধি থেকে মানুষকে হেফাজত করুন।