এ বিশাল পৃথিবীটা যখন অশান্তির চরম দুঃসময় অতিক্রম করছিল, পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করছিল এমন একজন মুক্তিকামী মহামানবের জন্য, যিনি পৃথিবীর অবিন্যস্ত অবয়বটি পাল্টে দিয়ে নতুন করে ঢেলে সাজাবেন পৃথিবীকে। ঠিক সেই মুহূর্তে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: পৃথিবীতে আগমন করলেন সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য মহান আল্লাহপাকের অপার রহমত হিসেবে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে বিশ্বনবী সা:- কে উদ্দেশ করে ইরশাদ হয়েছে ‘আমি (আল্লাহ) আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি’। (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭)।
মহানবী সা: সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য শ্রেষ্ঠতম আদর্শেরও নিদর্শন। গোটা মানবজাতির সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বাধিক সম্মানিত এবং সব নবী-রাসূলের নেতা পরিশেষে আগমন করেন। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না এবং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। কারণ তাঁর পর দুনিয়ায় আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না। এই মর্মে রাসূল সা: ইরশাদ করেন ‘অন্য নবীরা তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সব মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’
মহানবী সা: আরো ইরশাদ করেছেন ‘আমি শেষ নবী, আমার পরে আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না।’ মহানবী সা: মানবগোষ্ঠীর প্রতি সত্য প্রচারে নিবিষ্ট হন এবং সত্যভ্রষ্ট, পাপাসক্ত মানব সমাজকে তিনি দেখিয়েছিলেন পরম কল্যাণ ও কামিয়াবির পথ। যাতে তারা ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে শান্তি ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। আর অনাগতকাল ধরে তাঁর সে আদর্শের ছায়াতলে পরম শান্তি ও নিরাপদ আশ্রয় পেতে পারে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ।
মহানবী সা: পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এমন এক কঠিন সময়ে যখন সমগ্র পৃথিবী আইয়ামে জাহেলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। কোথাও শান্তি ছিল না, স্বস্তি ছিল না, ধর্মের নামে অধর্ম বিরাজ করছিল সর্বত্র। শিরক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সবাই। নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছিল অবলীলায়, কন্যাসন্তানকে দেয়া হচ্ছিল জীবন্ত কবর। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল, পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ সা:-কে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে প্রেরণ করলেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন ‘হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁরই দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং প্রদীপ্ত চেরাগরূপে।’ (সূরা আহজাব, আয়াত-৪৫-৪৬)।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: বিশ্ব মানবতার জন্য সত্যিকার শান্তির পথ, আল্লাহপাকের মনোনীত বান্দা হওয়ার সত্যিকার পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি মানুষে মানুষে হানাহানি দূর করে বিশ্বজনীন মানব সমাজ গড়ার পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন ‘কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের অথবা কোনো আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোনো কালোর ওপর কোনো সাদার অথবা কোনো সাদার ওপর কোনো কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি, শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হলো আল্লাহভীতি।’
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা: মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন, মানবতার কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে সম্প্রীতি ও সমবেদনার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন ‘সুন্দর আখলাকের পরিপূর্ণরূপ দিতে আমি প্রেরিত হয়েছি।’ পৃথিবীর সব মানুষের চেয়ে তিনি ছিলেন সুন্দরতম ও সর্বোত্তম আখলাকের অধিকারী।
উম্মুল মুমেনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা: ইরশাদ করেন ‘আমি কখনই এমনটি দেখিনি যে, হজরত রাসূলুল্লাহ সা: নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশে কোনো অন্যায়কারীকে শাস্তি প্রদান করেছেন।
তিনি ছিলেন সবার আদর্শ, তাঁর ধৈর্য, আত্মত্যাগ, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, বিনয় ও নম্রতা, দানশীলতা, আন্তরিকতা ও উদারতা বিশ্বের সব মানুষকে দান করেছে অতুলনীয় আদর্শ। তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী হতে শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত আয়েশা রা: বলেছেন ‘রাসূল সা: সব কাজ নিজ হাতে করতেন, নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, বকরির দুধ দোহন করতেন, নিজের কাজকর্ম নিজেই সম্পন্ন করতেন।’
রাসূলুল্লাহ সা: তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে বিশাল জনসমুদ্রে ঘোষণা করেছিলেন ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এর অনুসরণ করবে তত দিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব (আল-কুরআন) এবং তাঁর প্রেরিত রাসূলের সুন্নাহ।’ (মিশকাত শরিফ)।
বস্তুত বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধবিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য নষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য এবং আচার-আচরণের ভিন্নতা সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুপম আদর্শ ও সর্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই সমগ্র পৃথিবীতে এবং বিভিন্ন সমাজে বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।