Main Menu

লোক দেখানো আলহাজ্ব ডিগ্রী অর্জনের জন্য হজ্ব নয়, এক পবিত্র মহাশিক্ষা গ্রহণের জন্য হজ্ব

লোক দেখানো আলহাজ্ব ডিগ্রী অর্জনের জন্য হজ্ব নয়, এক পবিত্র মহাশিক্ষা গ্রহণের জন্য হজ্ব

লোক দেখানো আলহাজ্ব ডিগ্রী অর্জনের জন্য হজ্ব নয়, এক পবিত্র মহাশিক্ষা গ্রহণের জন্য হজ্ব

সামনে মুসলমানদের পবিত্র হজ্ব মৌসম। ইতোমধ্যে হজ্বে গমনেচ্ছুক মু’মিন নর-নারীগণ তাদের হজ্ব সম্পন্ন করার জন্য নিজ নিজ প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। আমরা আজও অনেকে হজ্বব্রত পালন করছি, কিন্তু সেই হজ্বের মাধ্যমে যে শিক্ষা গ্রহণ করার কথা, অনেক হাজীই সেই শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হচ্ছি না। ফলে হজ্বের পূর্বে একজন হাজীর চরিত্র যেমন থাকে, হজ্ব করে বাড়িতে ফেরত আসার পরও তার সে চরিত্র বদলায় না। ক’এক বছর পূর্বের কথা, সবেমাত্র আমার এক সহকর্মী হজ্বব্রত পালন শেষে নিজকর্মস্থলে পৌঁছেছেন। হজ্বের পর মু’মিনদের আচার-আচরনে সামান্যতম হলেও একটু পরিবর্তন হওয়ার কথা, যদি তিনি প্রকৃত পক্ষে হজ্বের সঠিক অর্থ বুঝে তদানুসারে হজ্বব্রত পালন কর থাকেন। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত হজ্ব সম্পাদনকারী আমার সহকর্মী হাজী সাহেবের মধ্যে সেই পরিবর্তনের কোন চিহ্নই দেখা গেল না। হজ্বে যাওয়ার পূর্বে তার চরিত্র এবং আচার-আচরণ যেমন ছিল, হজ্ব করে ফেরত আসার পরও তার সেই একই অবস্থা। মনে মনে ভাবলাম তিনি তাহলে কেমন হজ্ব করলেন? তাই কৌতুহলবশতঃ আমার সহকর্মী হাজী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম ঃ
“ভাইসাহেব! হজ্বে গেলেন, হজ্ব থেকে কী নিয়ে আসলেন ? তিনি উত্তর দিয়ে বললেনঃ কী আর আনবো ভাই! আমি যে টাকা পয়সা নিয়ে গিয়েছি তাতো প্রায় শেষের পথে, পরে আমার কাছে যা অবশিষ্ট ছিল তা এবং সাথের এক ভাই’র কাছ থেকে আরো কিছু টাকা কর্জ নিয়ে বড় মেয়ের জন্যে হাত কানের জিনিস এবং ছোট মেয়েটির জন্যে এটা সেটা কোন রকমে কিনে এনেছি। টাকার অভাবে বেশী কিছু আনতে পারিনি।”
আমি বললাম, আল্লাহ বলেছেনঃ “মানুষ তাই পায়, যা সে চেষ্টা করে।” আপনিও যা আনতে হজ্বে গিয়েছেন তাইতো এনেছেন। ভদ্রলোক এবার একটু সজাগ হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেনঃ ভাই আপনার কথাতো বুঝলাম না? অমি বললামঃ না বুঝার কিছুই নেই। হজ্ব হচ্ছে মু’মিনের জন্যে একটি বিশ্বভ্রাতৃত্বের মহামিলন তথা শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে অনেক কিছু শিখার আছে, আমি আপনার কাছে সেটাই জানতে চেয়েছিলাম যে, হজ্ব থেকে কী আনলেন? আমি এ কথা জানতে চাইনি যে, মক্কা-মদিনা থেকে ছেলে-মেয়েদের জন্যে কী কী জিনিস নিয়ে এসেছেন? ভদ্রলোক এবার থতমত খেয়ে বললেনঃ ভাই আপনি যেভাবে প্রশ্ন করেছেন, আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।” এই হচ্ছে আমাদের হজ্বের অবস্থা।

হজ্বের মাধ্যমে মু’মিনদের জন্য মূল শিক্ষা হচ্ছে, পরস্পর একে অন্যের সাথে পরিচিতি, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতি এবং সহমর্মিতার শিক্ষা লাভ। কারণ মানবজাতি পৃথিবীর যে যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, প্রত্যেকেই এক আদম (আঃ)-এর সন্তান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা তার এই সুন্দর পৃথিবী আবাদ করার জন্য বিভিন্ন জনকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রেখেছেন। তারা পরস্পর আত্মার আত্মীয়, পরম বন্ধু ও আদিপিতার মাধ্যমে জন্মসূত্রে সহোদর ভাই। আর পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে একে অন্যের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যেই মূলতঃ এই মহামিলনের আয়োজন। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলছেনঃ
“হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে ভয় কর; যিনি তোমাদেরকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার সহধর্মিণী সৃষ্টি করেছেন। এবং তাদের উভয় (যুগল) হতে বহু নর ও নারী (সৃষ্টি করে সমস্ত দুনিয়ায়) ছড়িয়ে দিয়েছেন। এবং সেই আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামের দোহাই দিয়ে তোমরা একে অপরকে তাগাদা কর এবং আত্মীয়তাকেও ভয় কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের তত্ত্বাবধানকারী।”(সূরাঃ আন্নিসাঃ ১)
দয়াময় প্রতিপালক আরও বলছেন ঃ
“হে মানবমণ্ডলী ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী {পিতা আদম ও মা হাওয়া (আঃ)} হতে; পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে (আত্মীয়তার বন্ধনে) পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকী। আল্লাহ সবকিছু জানেন সব কিছুর খবর রাখেন।”(সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)

কিন্তু আমরা সে শিক্ষা লাভ করতে পারছিনা বলেই আমারা মানবজাতি পবিত্র হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেও পরস্পর একে অপরের ভাই হওয়ার পরিবর্তে হয়ে উঠছি একে অন্যের মহাশত্রু। ফলে চোখের সামনে একজন আর একজনকে বিভিন্ন প্রকার ধারালো অস্ত্র দিয়ে দিনে দুপুরে গরু ছাগলের মত জবাই করছি এবং লাঠি-সোঠা, লগি-বৈঠা দিয়ে নিরপরাধ মানুষগুলোকে পিঠিয়ে মেরে ফেলার নেতৃত্ব দিচ্ছি। নিরপরাধ মু’মিন নর-নারীকে কুর’আন সুন্নাহর বিধান মানতে বিভিন্নভাবে বাধা দিচ্ছি এবং যারা আল্লাহর পবিত্র বিধান মেনে চলার চেষ্টা করছেন, তাদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করছি। এতে করে আল্লাহর পবিত্র বিধান লঙ্ঘন করে নিজেও নাফরমান হচ্ছি, আর একজনকেও নাফরমান বানাচ্ছি। আমাদের আচরণ দেখে মানব জাতির মহাশত্রু শয়তান ইবলীসও হয়তো লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে। আর এই সমস্ত অপকর্ম হতে বিরত থেকে মানুষ যাতে একে অন্যের আত্মার আত্মীয়, পরম বন্ধু ও ভাই ভাই হয়ে দুনিয়ায় বসবাস করতে পারি, সেই মহাশিক্ষা প্রদানের জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে এ মহামিলনের মহাআয়োজন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা এ ব্যাপারেই বলছেনঃ
“এবং আমি কা’বাগৃহকে মানবজাতির জন্যে মিলন কেন্দ্র ও সুরক্ষিত স্থান করেছি…. (সূরাঃ বাকারাহঃ ১২৫)
আমাদের মানবতার মহান নেতা, আল্লাহর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎকালীন অন্ধকার সমাজে হাবু-ডুবু খাওয়া মানবজাতির মুক্তির এক মহানবার্তা নিয়ে আল্লাহর আদেশে মানব সমাজে উপস্থিত হন। উদ্দেশ্য, তাঁর আলোকে মানব জাতিকে চিরকল্যাণের পথে পথ দেখানো। আর তিঁনি তাঁর ২৩ বছরের নবুওয়তী জীবনে তা বাস্তবায়নও করে গেছেন। তারপর আগত ও অনাগত মানবজাতি যেন কেয়ামত পর্যন্ত তার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দুনিয়া ও আখেরাতে মহাকল্যাণ লাভ করে ধন্য হতে পারেন, তারই সুব্যবস্থা করে রাখার নিমিত্তে তিঁনি তাঁর বিদায় হজ্বের পবিত্র ভাষণে দিয়ে গেলেন এক মহাকল্যাণের পথপরিক্রমা। যা প্রত্যেক হজ্ব পালনকারী মু’মিন নর-নারীর জন্য এক বিশেষ শিক্ষণীয় বিষয়। আমরা হজ্ব পালন করছি, কিন্তু আজও অনেকেই সেই মহান পথ-পরিক্রমা সম্পর্কে অজ্ঞতায় রয়ে গেছি। তাই এ পর্যায়ে সেই মহামূল্যবান ঐতিহাসিক পথ-পরিক্রমাটি সকলের অবগতির জন্যে উপস্থাপন করছি, যাতে আমরা প্রত্যেক হজ্ব পালনকারী মু’মিন নর-নারী পবিত্র হজ্বে গিয়ে আরাফার মাঠে দেয়া বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণে যে কথাগুলি বলে গিয়েছেন সেই মহান শিক্ষা গ্রহণ করে সকলেই উপকৃত হতে পারি। ওয়ামা তাওফিকী ইল্লাহ-বিল্লাহ।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের ভাষণ
৯ই জিলহজ্ব দশম হিজরী শুক্রবার। আরাফাহ্ ময়দানের পূর্বদিকে “নমিরা” নামক স্থানে তাঁবু স্থাপন করা হলে, মিনা থেকে ফজরের সালাত আদায় করে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুর্যোদয়ের পর সেখানে পৌঁছেন এবং দুপুর পর্যন্ত তথায় তাঁবুতে অব্স্থান করেন। তারপর তিনি কচোয়া নামক উষ্ট্রীর উপর আরোহন করে আরাফা’র সন্নিকটে “আরনা” প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে প্রায় একলক্ষ বিশ হাজার লোকের সমাবেশে মানবজাতির মহাকল্যাণের ভবিষ্যৎ পথ-পরিক্রমা হিসেবে তাঁর ঐতিহাসিক বিদায় হজ্বের খুতবা বা ভাষণ প্রদান করেন। তাঁর প্রতিটি বাক্যই রাবিয়া বিন উমাইয়া বিন খালাফ (রাঃ)-কর্তৃক পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। আল্লাহকে কৃতজ্ঞা জানিয়ে মানবতার মহান নেতা ও পরম বন্ধু, আল্লাহর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ

মানুষের রক্ত তথা জান ও মাল এবং পরকাল সম্পর্কে

১। হে মানব মন্ডলী! তোমরা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শ্রবণ কর; কেননা, আমি এবছরের পর এ স্থানে তোমাদের সাথে পুনরায় নাও মিলতে পারি।
২। আগত ও অনাগতকালের হে মনবমন্ডলী! যতক্ষন পর্যন্ত তোমরা তোমাদের প্রভুর সাথে মিলিত না হচ্ছো, তোমাদের রক্ত ও তোমাদের ধন-সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতই পবিত্র।
৩। নিশ্চয়ই তোমরা তোমাদের প্রভূর সাথে মিলিত হবে। যখন তোমাদের প্রভূ তোমাদের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন এবং আমি তোমাদেরকে তাঁর সংবাদ পৌঁছে দিয়েছি।

সামজিক কর্তব্য সম্পর্কে

৪। যে ব্যক্তি অন্যের ধন-সম্পদের অভিভাবক বা আমানতদার তার উচিত (নির্ধারিত সময়ে মূল মালিককে) তার ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া।
৫। সুদের লেনদেন হারাম, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। কারও প্রতি অত্যাচার করোনা ও অত্যাচারিত হয়োনা।
৬। আল্লাহর সিদ্ধান্ত, সুদ বাতিল এবং আব্বাস বিন আব্দুল মোত্তালিবের যে সমস্ত সুদ পাওনা রয়েছে, তা সবই বাতিল।
৭। অজ্ঞতা যুগের খুনের ক্ষতিপুরণ সবই বাতিল হলো।
৮। এর পর হে মানব মন্ডলী! শয়তান এদেশে পুজিত হওয়ার আশা ত্যাগ করেছে, সে অন্য দেশে মান্য হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের বিশ্বাস (ঈমান) সম্পর্কে সতর্ক থাকবে। যেন তোমাদের ভাল কাজগুলো অন্য লোকের দ্বারা নষ্ট হয়ে না যায়।
৯। হে মানব মন্ডলী! পবিত্র মাসের রহিত করন অন্ধকার যুগেরই ধারা। যারা অবিশ্বাস্য পছন্দ করে, তারা বিভ্রান্ত। তারা বলে এক বছর পবিত্র মাস, পরের বছর অপবিত্র। তারা আল্লাহ কর্তৃক পবিত্র মাসের সংখ্যা ঠিক রাখার জন্য পবিত্র মাসকে অপবিত্র বলে। সময় ঘুরছে, যে দিন থেকে আসমান ও জমিন সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহ কর্তৃক মাসের সংখ্যা ১২ ,তার মধ্যে ৪টা পবিত্র, ৩টা পরপর এবং জমাদিউস সানি ও শা’বানের মধ্যবর্তী মাস।

“স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে”

১০। এরপর হে মানব মন্ডলী! তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি তোমাদের অধিকার আছে; তাদেরও তোমাদের প্রতি অধিকার আছে। ঐ ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ, যে তার স্ত্রীর নিকট শ্রেষ্ঠ। এটা তাদের অবশ্য কর্তব্য তাদের সতীত্ব রক্ষা করা এবং অশ্লীলতা ত্যাগকরা। যদি তারা দোষী হয়, তবে তোমরা তাদের সাথে সহবাস (সঙ্গম) করো না। তোমরা তাদের সংশোধনার্থে প্রহার কর-কিন্তু যেন ক্ষত-বিক্ষত না হয়ে যায়। যদি তারা অনুতপ্ত হয় (তাওবা করে) তবে তাদের ক্ষেতে দাও পরতে দাও, তাদের সঙ্গে তখন ভাল ব্যবহার কর। তোমরা একে অন্যকে উপদেশ দিও তোমাদের স্ত্রী-জাতির প্রতি ভাল ব্যবহার করার জন্য। কেননা তারা তোমাদেরই অংশ বা অন্তর্ভূক্ত ও তাদেরকে আল্লাহর আমানত রুপে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাক্য দ্বারাই তাদেরকে তোমাদের জন্যে বৈধ করা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে

১১। সুতরাং হে মানব মন্ডলী ! তোমরা আমার কথাগুলো ভালভাবে অনুধাবন কর, যার জন্য আমি আমার কথাগুলো তোমাদের জন্য রেখে গেলাম। যদি তোমরা এটা দৃঢ় ভাবে ধারণ কর, তাহলে তোমরা কোনদিনই বিপথগামী হবেনা। আর সে ধারণকৃত জিনিস দু’টি হচ্ছে আল্লাহর নাযিলকৃত “আল-কুরআন” ও “আমার সূন্নাহ” (মানব জাতির জন্য ধর্মীয় নীতিমালা ও জীবন ধারা)।
১২। হে মানব মণ্ডলী! তোমরা আমার কথাগুলো অনুধাবন কর নিশ্চিত করে বুঝতে। তোমরা শিক্ষা পেয়েছ প্রত্যেক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, সকল মুসলমানই এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। এটা কোন মানুষের জন্যই অবৈধ নয়, অনুমতি ব্যতীত অন্যের জিনিস গ্রহণ করবে না। সুতরাং কেউ কারো প্রতি অবিচার করো না।

দন্ডবিধি ও আনুগত্য সম্পর্কেৎ

১৩। একজনের অপরাধে অন্যকে দন্ড দেয়া যায় না। অতঃপর পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা চলবে না।
১৪। যদি কোন নাক কান কাটা হাবসী কৃতদাসকেও তার যোগ্যতার কারণে তোমাদের আমির (নেতা) করে দেয়া হয়, তোমরা সর্বতোভাবে তার অনুগত হয়ে থাকবে। তার আদেশ মান্য করবে।

ধর্ম সম্পর্কে

১৫। সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
১৬। তোমরা ধর্মভ্রষ্ট হয়ে পরস্পর পরস্পরের সংগে ঝগড়া ও রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। তোমরা পরস্পর পরস্পরের ভাই।

মানুষ ও জাতি সম্পর্কে

১৭। এক দেশের মানুষের উপর অন্যদেশের মানুষের তথা অনারবদের উপর আরবদের এবং আরবদের উপর অনারবদের প্রাধান্যের কোন কারণই নেই। সমস্ত মানুষ এক আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। মানুষের প্রাধান্য মানুষের যোগ্যতার ভিত্তিতে।
১৮। জেনে রেখো! এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাই সমগ্র বিশ্বের মুসলমান এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃ সমাজ।

শেষ নবী সম্পর্কে

১৯। হে লোক সকল! শ্রবন কর, আমার পর কোন নবী নেই। তোমাদের পর আর কোন উম্মত (জাতি) নেই। এ বছরের পর তোমরা হয়তো আর আমার সাক্ষাত পাবেনা। ইল্ম বা অহী (ঐশী জ্ঞান) উঠে যাওয়ার পূর্বে আমার নিকট থেকে শিখে নাও।
২০। চারটি কথা স্মরণ রেখোঃ
(ক) র্শিক (আল্লাহর অংশী) করো না।
(খ) অন্যায় ভাবে নর হত্যা করো না।
(গ) চুরি করো না।
(ঘ) ব্যভিচার করো না।

দাস দাসী এবং মজুরের অধিকার সম্পর্কে

২১। হে মানব বৃন্দ! কোন দূর্বল মানুষের উপর অত্যাচার করো না, গরীবের উপর অত্যাচার করোনা, সাবধান! কারো অসম্মতিতে কোন জিনিস গ্রহণ করো না। সাবধান! মজুরের শরীরের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার মজুরী মিটিয়ে দিও। তোমরা যা খাবে ও পরবে তা তোমাদের দাস-দাসীদের খেতে ও পরতে দিও। যে মানুষ দাস-দাসীদের ক্ষমা করে ও ভালবাসে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করেন ও ভালবাসেন।
২২। যে ব্যক্তি নিজ বংশের পরিবর্তে নিজেকে অন্য বংশের বলে প্রচার করে। তার উপর আল্লাহর, ফেরশতাগণের ও মানব জাতির অভিসম্পাত।

প্রকৃত মুসলমান

২৩। মাহানবী (সঃ) বলেন- মুসলমান ঐ ব্যক্তি। যার মূখ ও হাত থেকে অন্যান্যরা নিরাপদ থাকে। ঈমানদার বা বিশ্বাসী ঐ ব্যক্তি-যার হাতে সকল মানুষের ধন ও প্রাণ নিরাপদ থাকে। ঐ ব্যক্তি পূর্ণ মু’মিন হতে পারেনা যে দুবেলা পেট পূর্ণ করে আহার করে, আর তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকে। ঐ ব্যক্তি মুসলমান হতে পারেনা-যখন সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তা অন্যের জন্যেও পছন্দ করে না।

একতা সম্পর্কে

২৪। আমার উম্মতের মধ্যে যে আগে ঝগড়া ও বিসংবাদ করতে বের হয়, তার বুকে আঘাত কর। একত্রে খানা-পিনা কর। আলাদা আলাদা ভাবে আহার করোনা। কেননা একত্র খাওয়াতে বরকত আছে। যে বিভেদ সৃষ্টি করে, তাঁর স্থান জাহান্নামে। আমি তোমাদের পাঁচটি আদেশ করছিঃ
(ক) একতা রক্ষা কর।
(খ) নেতার অনুগত থাক।
(গ) প্রয়োজনে হিজরত কর।
(ঘ) উপদেশ শ্রবন কর।
(ঙ) আল্লাহর পথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ কর।

ঘুষ ও হিংসা-প্রতিহিংসা সর্ম্পেকে

২৫। যাকে আমরা শাসনকার্যে নিযুক্ত করি, আমরা তার ভরন পোষনের ব্যবস্থা করি। এরপরও যদি সে কিছু (অবৈধ ভাবে অতিরক্ত) গ্র্রহন করে, তা বিশ্বাস ভঙ্গ বা ঘুষ বলে গন্য হবে এবং ঘুষ গ্রহণ মহাপাপ।
২৬। তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ কর। কেননা আগুন যেমন জ্বালানী কাটকে ভষ্মীভূত করে। হিংসা তেমনি মানুষের সৎ গুনকে ধ্বংস করে।

পরিশ্রমী ও ভিক্ষুক সম্পর্কে

২৭। যে ব্যাক্তি নিজ হাতের কোন কাজ দ্বারা খাদ্য সংগ্রহ করে,তা অপেক্ষা উত্তম খাদ্য আর নেই। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ভিক্ষা করে, সে যদি এক গাছি দড়ি (রশি) নিয়ে পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে বিক্রি করে, আল্লাহ তার মূখ রক্ষা করবেন। এটাই তার জন্য উত্তম।
আমল নামা সর্ম্পকে
২৮। তোমাদের প্রত্যেককেই আল্লাহর সম্মুখে হাজির হতে হবে এবং আপন আপন ভাল মন্দের হিসাব-নিকাশ (আমল নামা) পাঠ করতে হবে। তোমরা সাবধান! সেইদিন কেউ কাউকেও সাহায্য করতে পারবেনা।

জ্ঞান সর্ম্পকে মহাবানী

২৯। তোমরা জেনে রেখো-যে ব্যক্তি জ্ঞানের পথে পরিভ্রমন করে, আল্লাহ তাকে স্বর্গের পথে পথ দেখান জ্ঞান অনুসন্ধান কর। (বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্ত অপেক্ষা মূল্যবান) দ্বীনের জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।
ব্যবহার সর্ম্পকে
৩০। সমাজে তোমার আচরন ঐ রূপ হবে, যেমন আচরন তুমি অন্য থেকে কামনা কর। সমাজে তোমার ব্যাবহার ঐরূপ হবে, যেরূপ ব্যবহার তুমি নিজে পেলে খুশি হও।

পিতা-মাতা সর্ম্পকে

৩১। হে মানববৃন্দ! তোমরা জেনে রেখো। তোমাদের মাতা-পিতার সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি। মাতা-পিতার অসন্তুষ্টিই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। তোমাদের বেহেশ্ত তোমাদের মায়ের পায়ের তলে অবস্থিত।

শ্রেষ্ট মানুষ সর্ম্পকে

৩২। হে মানব সন্তান! তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, যে মানুষের উপকার করে।

উম্মাতে মুহাম্মাদী তথা সকল ম’ুমিন নর-নারী’র প্রতি বিশেষ-নির্দেশ
৩৩। “যারা উপস্থিত আছো। তারা অনুপস্থিতদের নিকট আমার এই পয়গাম পৌঁছে দিবে। হয়তো উপস্থিতদের কিছু লোক অপেক্ষা অনুপস্থিতদের কিছু লোক বেশী উপকৃত হবে।”

হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম ভাষনের কথাগুলো বলার সংগে সংগে রাবিয়া বিন উমাইয়া বিন খাল্ফ (রাঃ) বিশাল জনতাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনারা কি জানেন এটা কোন দিন? তারা উত্তর দিলেন, এটা পবিত্র হজ্বে ¡র দিন। তার পর তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেনঃ আপনারা কি জানেন আল্লাহ আপনাদের জীবন, মাল ও সকল কিছু পবিত্র করেছেন? যতক্ষন আপনারা তার সাথে মিলিত না হচ্ছেন? তাঁরা উত্তর দিলেন-হ্যাঁ! এভাবে তিনি বাক্যের পর বাক্যগুলো বলতে থাকলেন।
যখন হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে উঠলেনঃ হে আল্লাহ! আমি কি আপনার রিসালাতের গুরুভার ও নবুয়তের গুরুদায়িত্ব বহন করতে পেরেছি ? হে আল্লাহ! আমি কি আমার কর্তব্য পালন করেছি ? সংগে সংগে বিশাল জনতা উচ্চস্বরে বলে উঠলেনঃ হ্যাঁ! তখন আল্লাহর রাসুল হযরত মুহা¤মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে উঠলেনঃ হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেক।
(তথ্যসূত্র ঃ “বিশ্বনবীর জীবনী” সম্পাদনা মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রশিদ যশোরী এম, এ এবং “মহানবী’র সীরাত কোষ” লেখক খান মোসলেহ উদ্দিন আহাম্মদ।)

উপসংহার ঃ

জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের, সর্বশ্রেষ্ঠ সাধকের ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুলের পবিত্র মূখনিঃসৃত সেই ভাষণের কথাগুলো ছিলো দয়াময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা‘র, যার জবান ছিল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর। তাই সে পবিত্র ভাষণ চিরদিনের জন্য চির সবুজ ও চির নবীন। সুতরাং মানব কল্যাণে, বিশ্ব কল্যাণে, বিশ্ব শান্তিতে ও শ্রীবৃদ্ধিতে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র এ বিদায় হজ্বের বিদায়ী ভাষণের সামাজিক গুরুত্ব অসামান্য, অভাবনীয়, অসীম, অচিন্তনীয়, অপূর্ণ ও অনবদ্য। যতদিন এ দুনিয়াতে মানুষের সামাজিক ব্যবহার বলে কোন কিছু থাকবে, ততদিন আগত হতে অনাগতকাল পর্যন্ত মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠতম বিদায় হজ্বে দেয়া ভাষণের চরম মুল্যায়ন হতেই থাকবে।

পরিশেষে একথাই বলছি যে, আমাদের সমাজে অনেক মুসলমান নামধারী নেতা-নেত্রী পবিত্র হজ্ব ও ওমরাহ পালনকালে সাধারণ মানুষকে ধর্মের ধোঁকায় ফেলার জন্যে লোক দেখানো হিজাব-নিকাব পরিধান করেন এবং মাথায় মূখে পাগড়ী-পট্টি বেঁধে প্রতারনামূলক হজ্ব ও ওমরাহ পালন করেন। আবার তাদের সেইসব চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করে বিভিন্ন মিডিয়ায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ফলাও করে প্রচারও করেন এ উদ্দেশ্যে যে, যাতে সরল সোজা সাধারন মানুষগুলো মনে করতে পারেন যে, আমরা আসল মুসলমান নেতা-নেত্রীর দেখা পেয়ে গেছি। এরাই সত্যিকারের খাঁটি ঈমানদার এবং প্রকৃত মুসলমান। কিন্তু আল্লাহর পবিত্র ঘরে হজ্ব ও ওমরাহ পালন শেষে দেশে ফিরে এসে সেই সকল নেত্রী-নেতাগণ দিবালোকে প্রকাশ্যে জনসন্মুখে নিজের পোষা বাহিনীর মাধ্যমে লগি-বৈঠা, লাঠি-সোঠা, কোঁচ-বল্লম দিয়ে নিরস্ত্র আদম সন্তান তথা আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুসলমানদেরকে সাপের মত পিটিয়ে মারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় নির্বাহী ক্ষমতাবলে তাদের কুক্ষাত বাহিনীর দ্বারা ছুড়ি, চাকু, কিরিচ, দা, চাপাতি, কুড়াল, ছেনা, রামদা প্রভৃতি জাতের ধারালো অস্ত্র দিয়ে দিনে দুপুরে আদম সন্তানদেরকে গরু-ছাগল, হাস-মুরগীর মত জবাই করাচ্ছেন। এবং কারো কারো হাত পায়ের রগ কেঁটে দিয়ে চির জীবনের জন্য মানুষকে পঙ্গু করে নিজের দোষগুলো নির্দোষ প্রতিপক্ষের ঘারে চাপিয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ধোঁকায় ফেলছেন। মনে হচ্ছে মানুষ মেরে ফেলার পর বিজয়ীবেশে তারা আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য নফল ওমরাও পালন করছেন। তারাই আবার ক্ষমতার জোড়ে আইন পাশ করে মুসলমানদের কলিজা থেকে আল্লাহর একত্ববাদের ধর্ম বিশ্বাস তুলে দিয়ে সকলকে ধর্মহীন বানানোর পায়তারা করছেন। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে মু’মিন নারীদের হিজাব-নিকাব ব্যবহার বন্ধ করে তাদেরকে জন সম্মুখে উলঙ্গ করার প্রয়াস চালাচ্ছেন এবং কুটকৌশলে মুসলমানদেরকে কুর’আন শিক্ষা থেকে বিভিন্নভাবে বিরত রাখছেন। আবার তারাই বড় বড় জনসমাবেশে জোড় গলায় নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলছেনঃ যারা যে দল করছেন তারা তাদের নেতার উম্মত, আর আমরা যারা বিশেষ দল করছি, তারা সকলেই খাঁটি মুসলমান এবং মহানবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর খাঁটি উম্মত।

Related Post