সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আব্দুল্লাহ জুলবেযাদইন (রাঃ)

সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আব্দুল্লাহ

সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আব্দুল্লাহ

তাঁর নাম আব্দুল্লাহ জুলবেযাদইন (রাঃ)। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি আব্দুল উজ্জা নামে পরিচিত ছিলেন। আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় নাম “আব্দুল্লাহ”। তাঁর এই নামটি রাখেন রাসূল (সা.)। হযরত আব্দুল্লাহ ছিলেন এতিম সন্তান। শৈশবে তাঁর পিতা ইন্তেকাল করলে তিনি চাচার তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেন। এমনি সময়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবভূমিতে নবী ও রাসূল রূপে আর্বিভূত হলেন। হযরত আব্দুল্লাহ হৃদয় দিয়ে রাসূলকে (সা.) ভালোবেসে ফেলেন। কিন্তু সেই ভালোবাসার কথা কাউকে অবহিত করলেন না। তিনি মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সময়ের প্রয়োজনে আল্লাহর হুকুমে রাসূল (সা.) মদীনায় হিজরত করলেন। হযরত আব্দুল্লাহ আর অপেক্ষা করলেন না। একদিন চাচার দরবারে হাজির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন; মুহাম্মদ যে আল্লাহর নবী বলে দাবী করেন এ ব্যাপারে আপনার মত কী?  জবাবে চাচা বললো; আমারতো মনে হয় তিনি আল্লাহর নবী। তাহলে আপনি কি তাঁর উপর ঈমান আনবেন? চাচা জবাবে বললো কক্ষনো না। এই জবাব শুনে ভাতিজা বললেন চাচাজান! বছরের পর বছর অপেক্ষামান ছিলাম, আপনার অধীনে ছিলাম বলে ইসলাম গ্রহণ করা হয়নি। আর আমার ইচ্ছা ছিলো আপনি আগে ঈমান আনবেন অতঃপর আমি। কিন্তু আপনি যখন ঈমান আনলেন না, আর আনবেন না বলে ঘোষণা দিলেন। তাই আপনাকে সাক্ষী রেখে আমি ঘোষণা করছি; “লা – ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” ( আল্লাহ ছাড়া কোন সত্যিকারের ইলাহ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)
চাচা চিজ্ঞেস করলো এর পরিণাম জানো কি? হযরত আব্দুল্লাহ জবাব দিলেন না জানিনা! তাহলে শোনো, তুমি যে আমার বাড়িতে থাকো, এই বাড়ি ছাড়তে হবে, আমি বাড়ি ছাড়তে রাজি আছি। উট, ছাগল, ভেড়া ঘোড়া যা দিয়েছি সব ফেরৎ দিতে হবে। তিনি বললেন আমি এসব ফেরৎ দিতেও রাজি। অতঃপর চাচা বললো শুধু তাই নয় তোমার পড়নে যে জামা কাপড় রয়েছে তাও আমার টাকায় কেনা, এগুলোও খুলে দিতে হবে। আব্দুল্লাহ বললেন, আমার ঈমানকে বাঁচাতে হলে আমি এসব কিছু ফেরৎ দিতে প্রস্তুত আছি, এ কথা বলেই চাচার সামনেই পড়নের কাপড় খুলে ফেললেন। মায়ের কাছে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার এই অবস্থা কেনো? বললেন ঈমান আনার কারণে আমার এই অবস্থা মা! মাকে বললেন, মা আমাকে এক টুকরো কাপড় দিন যা গায়ে দিয়ে রাসূলের (সা.) দরবারে হাজির হতে পারি। মা তাঁকে একটি পুরনো কম্বল দিলেন, কম্বলটি দু’টকরো করে এক টুকরো গায়ে জড়িয়ে আর এক টুকরো লজ্জাস্থান আবরণ করে মদীনার পথে চললেন।
অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময় তিনি মদীনায় পৌঁছান। তিনি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে এক কোনে বসে পড়লেন। মসজিদে রাসূল (সা.) এসে দেখলেন মলিন চেহারা, অগুছালো চুল ক্লান্ত শরীর এক যুবক মসজিদের কোনে বসে আছে। নবীজী কাছে গিয়ে দরদী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি, তোমার বাড়ি কোথায়, তোমার এই অবস্থা কেন? আমি আব্দুল উজ্জাহ, আমি মক্কা থেকে এসেছি, ঈমান আনার কারণে আমাকে বাড়ি ঘর সহায় সম্পত্তি সব ছাড়তে হয়েছে। এমন কি পড়নের জামা কাপড়ও। আসার সময় মায়ের কাছ থেকে শুধু এই কম্বলটি নিয়ে এসেছি। রাসূল (সা.) তাঁকে আসহাবে সুফ্ফার অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। সাহাবাদের নির্দেশ দিলেন তাঁকে কুরআন শেখানোর জন্য। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন তোমার নাম আজ থেকে আব্দুল্লাহ, আব্দুল উজ্জাহ নয়।
হযরত আব্দুল্লাহ উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কোনো কোনো সাহাবী রাসূল (সঃ)-এর নিকট অভিযোগ করেন, যে ইয়া রাসূলাল্লাহ! আব্দুল্লাহ এতো জোরে কুরআন তেলাওয়াত করে যে অন্যান্যদের সমস্যা হয়। জবাবে রাসূল (সা.) বলেন; হে সাহাবাগণ! তাঁকে জোরে পড়তে দাও, বাঁধা দিওনা। তাঁর ঈমান যে বড় দামে কেনা! ঈমানের সওদায় সে সর্বস্ব হারিয়েছে।
তাবুকের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। রাসূল (সা.) জিহাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। ৩০ হাজার মুজাহিদ সমেত রাসূল (সা.) তাবুকের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। এর মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ এসে আরজ করলেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ! আসন্ন জিহাদে নারী পুরুষ সকলে সামর্থানুযায়ী আপনাকে সহায়তা করেছে। কিন্তু আমি আল্লাহর এমন এক বান্দাহ, আমারতো দেওয়ার মত কিছুই নেই। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন, যেন আমি এই জিহাদে আল্লাহর রাহে শহীদ হতে পারি।  তাঁর কথা শোনে রাসূল (সা.) বললেন; তুমি গাছের একখানা ছাল নিয়ে এসো। গাছের ছাল আনা হলো। রাসূল (সা.) তা হযরত আব্দুল্লাহর হাতে দিয়ে বললেন; “হে আল্লাহ! আমি আব্দুল্লাহর রক্ত কাফেরদের জন্য হারাম ঘোষণা করলাম। হযরত আব্দুল্লাহ কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন; হে আল্লাহর রাসূল! আমি শহীদ হবার দোয়া চাইলাম, আর আপনি আমার রক্ত কাফেরদের জন্য হারাম ঘোষণা করলেন! প্রিয় নবী তাঁকে শান্ত¡না দিয়ে বললেন; “হে আব্দুল্লাহ এখন যদি তোমার মৃত্যু জ্বরে আক্রান্ত হয়েও হয়, তবুও আল্লাহ তোমাকে শহীদ হিসেবে পরিগণিত করবেন।”
কিছুদিন পর তাঁর নিকট সংবাদ এলো, আব্দুল্লাহ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশে তাঁর কাফন দাফনের ব্যবস্থা হলো। রাতের বেলা দাফন হবে। একজন লোক টিমটিম আলোর বাতি নিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন কবরের ভেতরে নেমেছেন, দু’জন লাশ বহন করে নিয়ে আসছেন। যিনি কবরের ভেতরে দাঁড়ানো তিনি বললেন, “হে লাশ বহনকারীগণ! সাবধান! লাশের সাথে বেআদবী করো না তোমাদের ভায়ের লাশের প্রতি আদব রক্ষা করো” এই বলে তিনি লাশটি ধরে কবরে সমাহিত করলেন। যিনি কবরে দাড়িয়ে লাশটি সমাহিত করলেন তিনি আর কেউ নন স্বয়ং বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আর যে দু’জন লাশ বহন করে ছিলেন তারা হলেন হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রা.)। আর যিনি চেরাগ নিয়ে কবরের পাশে দাড়িয়ে ছিলেন তিনি ছিলেন হযরত বেলাল।
রাসূল (সা.) লাশ কবরে সমাহিত করে দু’হাত দিয়ে কবরের মাটি ঠিক করতে করতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে আরজ করলেন; হে আল্লাহ! আজ সন্ধা পর্যন্ত আমি আব্দুল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম, তুমিও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ পাশে দাঁড়ানো ছিলেন তিনি আফসোস করে বললেন; হায় এই কবরে যদি আব্দুল্লাহর লাশ না হয়ে আমার লাশ হতো, তাহলে আমার ভাগ্যটা খুলে যেতো। হযরত আব্দুল্লাহ জুলবেযাদইন (রাঃ) সেই অনন্য সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যাঁকে রাসূল (সা.) নিজ মুবারক হাতে কবরে শায়িত করেছিলেন।

Related Post