হযরত উম্মে আম্মারা (রাঃ)

হযরত উম্মে আম্মারা (রাঃ)

হযরত উম্মে আম্মারা (রাঃ)

তার আসল নাম নাসীবা। কিন্তু আরবের রেওয়াজ অনুযায়ী নামের চেয়ে তার কুনিয়াত বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি ছিলেন আনসারী মহিলা। খাযরাজ কবীলার নেজার বংশের সাথে তার বংশ সম্পৃক্ত ছিল। বংশধারা এই, নাসীবা বিনতে কা’আব ইবনে আওফ ইবনে মাবযুল ইবনে আমর ইবনে গানাম ইবনে মায়েন ইবনে নেজার। হিজরতের  প্রায় ৪০বছর আগে মদীনায় তার জন্ম হয়।
চাচাতো ভাই যায়েদ ইবনে আছেম-এর সাথে তার প্রথম বিয়ে হয়। এ পক্ষে দু’জন পুত্র জন্ম গ্রহণ করে- আব্দুল্লাহ্ ও রাজীব। যায়েদ-এর ইন্তিকালের পর আরবা ইবনে আমর-এর সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। এ পক্ষে এক পুত্র সন্তান তামীম এবং এক কন্যা সন্তান খাওলা জন্ম গ্রহণ করে।
ইসলাম তখনও আপন পায়ে দাঁড়ায়নি, সত্য ও ন্যায়ের আওয়াজের সাথে দুনিয়া তখনও পরিচিত হয়নি; রাসূল (সা.) অবিরাম চেষ্টায় নিয়োজিত। শেষ পর্যন্ত তিনি মক্কাবাসীদের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি আল্লাহর রহমত সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন, তাই ইসলামের প্রচার কার্য অব্যাহত রাখেন। এ সময় মদীনার ৬জন লোক নবীজীর দরবারে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। পরবর্তী বছর আরও ৬জন লোক যোগ দেয়। রাসূল (সা.) বার জনের এ ক্ষুদে মুসলিম দলের সাথে হযরত মুসআব ইবনে উমাইরকে ইসলাম প্রচারের জন্য মদীনায় প্রেরণ করেন। এ ক্ষুদে নিবেদিত প্রাণ দলের চেষ্টায় মদীনার অনেক বড় লোক ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত উম্মে আম্মারা এবং তার পরিবার এদের মধ্যে ছিল। এমনিভাবে ইসলাম গ্রহণের ফলে হযরত উম্মে আম্মারা দু’টি মর্যাদা লাভ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম, দ্বিতীয়ত: তিনি ছিলেন আনসারী মহিলা।
হযরত উম্মে আম্মারার জীবনের প্রথম স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে; আকাবার বায়আতে অংশ গ্রহণ। আকাবা বলা হয় ঘাটিকে। এর বিস্তারিত বিবরণ হলো এই যে, ইসলামের ক্রমবিকাশের তৃতীয় বর্ষে মদীনার আনুমানিক ৭৫জন মুসলমানের একটি দল নবীজীর সাথে সাক্ষাত করার জন্য মক্কায় রওয়ানা হয়। হজ্বের দু’তিন দিন পর একটি পাহাড়ী ঘাটিতে রাতের শেষ প্রহরে তারা নবীজীর সাথে মিলিত হয়ে তার হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে এটা আকাবার বায়আত বলে খ্যাত ও পরিচিত। তারা শপথ আর প্রতিজ্ঞা করে বলেন, আপনি মদীনা আগমন করুন। আমরা জান-মাল-আওলাদ সবই আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যের জন্য উৎসর্গ করবো। এদের মধ্যে দু’জন নারীও আম্মারার স্বামী আরাবা ইবনে আমর এ সময় দু’জন মহিলাকে ডেকে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দু’জন নারীও আমাদের সাথে বায়আতের জন্য হাযির হয়েছে। নবীজী বললেন, যে প্রতিজ্ঞায় আমি তোমাদের বায়আত গ্রহণ করেছি, সে প্রতিজ্ঞায় তাদেরও বায়আত গ্রহণ করছি। হাত মিলানোর প্রয়োজন নেই। আমি নারীদের সাথে হাত মিলাই না।
এ নাজুক মুহূর্তের আগে অর্থাৎ যখন মুসলমানরা বিজয়ের পথে ছিল এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিপুল বিক্রমে দুশমনের মুকাবিলা করছিল, তখনও উম্মে আম্মারা অলস অবস্থায় বসেছিলেন না। তিনি মশকে পানি নিয়ে মুজাহিদদেরকে পান করাতেন। আর এখন এ নাজুক মুহূর্তে নবীজীর হেফাযতের জন্য একেবারে বুক পেতে দিয়েছেন। কাফেরদেরকে অগ্রসর হতে দেখলে তিনি তীর-তরবারী দিয়ে প্রতিহত করতেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজে বলেন, আমি ঢাল দিয়ে দুশমনদের হামলা প্রতিহত করতাম। আমি এ কৌশল অবলম্বন করতাম যে, কোন সওয়ার হামলা করলে আমি ঠেকাতাম। আর সামনে অগ্রসর হলে আমি পেছনে থেকে এমনভাবে হামলা করতাম যে, ঘোড়সওয়ারসহ মাটিতে লুটিয়ে পড়তো। এ অবস্থা দেখে হযরত (সা.) আমার ছেলে আব্দুল্লাহকে ডেকে আমার সাহয্যে নিয়োজিত করেন। আমরা উভয়ে মিলে তখনই অশ্বারোহী কাফেরদের কর্ম সারা করতাম।
এ যুদ্ধে হযরত উম্মে আম্মারার বীরত্বপূর্ণ সেবার আলোচনা উঠলে নবীজী বলতেন, আমি ওহোদ যুদ্ধে তাকে সব সময় আমার ডানে-বাঁয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি। যুদ্ধ তখনও থামেনি। কাফেররা বিপুল বিক্রমে হামলা চালাচ্ছে। একজন কাফেরের পাথরের আঘাতে নবীজী দান্দান মুবারক শহীদ হয়। ইতোমধ্যে ইবনে কেমইয়া তরবারী দিয়ে আক্রমণ করে। নবীজী চেহারা মুবারকে আঘাত পান। দরদর করে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। উম্মে আম্মারা এ অবস্থা দেখে মরিয়া হয়ে ইবনে কেমইরিয়ার ওপর আঘাত হানেন। কিন্তু এর কোন ফল হয়নি। কারণ, তার পরিধানে ছিল লৌহ নির্মিত বিশেষ পোশাক। এরপর সে তরবারী দিয়ে আঘাত হানলে তার কাঁধে তরবারী বিদ্ধ হয় এবং তিনি মাটিতে পড়ে যান। ইবনে কেম্ইয়া পলায়ন করে, কিন্তু উম্মে আম্মারা ভীষণ আঘাত পান। তার দেহ রক্তাপ্লুত হয়ে পড়ে। হযরত (সা.) সামনে উপস্থিত থেকে উম্মে আম্মারার ক্ষত স্থানে পট্টি বাঁধান। তিনি কয়েকজন বীর সাহাবীর নাম উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আজ উম্মে আম্মারার অবদান এদের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উম্মে আম্মারা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য দোয়া করুন, যাতে আমি জান্নাতে আপনার সাথী হতে পারি। নবীজী দোয়া করলে তিনি বলেন ঃ ما أبالي ما أصابني من الدنيا
এখন দুনিয়ার কোন বিপদেরই আমি আর পরওয়া করি না। এ যুদ্ধে তিনি এমন মরিয়া হয়ে অংশ গ্রহণ করেন যে, তার পুত্র হযরত আবদুল্লাহ আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তিনি নিজ হাতে পট্টি বেঁধে বললেন, হে বৎস! এবার যাও, লড়াই কর।
নবীজী বললেন, উম্মে আম্মারা!  তোমার মধ্যে যে ক্ষমতা আছে, তা আর কার মধ্যে থাকতে পারে? হযরত (সা.) তার খেদমতের এতটা মূল্য দিতেন যে, যুদ্ধ শেষে সকলে যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনে কা’আব মাযেনীকে পাঠিয়ে তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত না হয়ে তিনি গৃহে ফিরে যাননি অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য জীবন চরিতকার লিখেন, হযরত উম্মে আম্মারা ওহোদ যুদ্ধ ছাড়াও হোদায়বিয়া, খায়বর এবং হোনাইনের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন এবং নবীজীর সঙ্গে ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে সা’আদ বলেন ঃ وشهدت أحدا والحديبية وخيبر وعمرة القضية وحنينا ويوم اليمامة.
তিনি ওহোদ, হোদায়বিয়া, ওমরাতুল কাযা, হোনাইন ও ইয়ামামার যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন।
এখানে ইয়ামামার যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে “ নবীজীর ওফাতের পর ইয়ামামার সর্দার মুসাইলামা কাযাযাব মোর্তাদ হয়ে যায়। সে ছিল বড় যালেম এবং বিরাট প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার কবীলার প্রায় চল্লিশ হাজার লোক ছিল যুদ্ধ করার মতো। এরা সকলেই তাকে সমর্থন করে। আপন শক্তি বলে মদমত্ত হয়ে সে নবী হওয়ার দাবি করে বসে এবং জোর পূর্বক সকলের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করতে শুরু করে। তাকে নবী বলে স্বীকার না করলে নানা প্রকার নির্যাতন চালাতো। হযরত উম্মে আম্মারার পুত্র হাবীব ইবনে যায়েদ মদীনা থেকে ফেরার পথে মুসাইলামার হাতে পড়েন। সে তাকে কাবু করে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহ্র রাসূল। তিনি বললেন হ্যাঁ, সে বললো, না বরং তুমি সাক্ষ্য দাও যে, মুসাইলামা আল্লাহ্র রাসূল। তিনি কঠোরভাবে অস্বীকার করলে তার একটা হাত কেটে ফেলে। পুনরায় অস্বীকার করলে অপর হাতটি কেটে ফেলে। মোটকথা, সে তার এক একটি অঙ্গ কেটে ফেলে। কিন্তু তিনি প্রাণের বিনিময়েও সত্য ত্যাগ করেননি। হযরত উম্মে আম্মারা এ ঘটনা শুনে বুকে পাথর বেঁধে ধৈর্য ধারণ করেন এবং প্রতিজ্ঞা করে বলেন যে, মুসলমানরা এর বিরুদ্ধে কোন বাহিনী পরিচালিত করলে আমি আপন তরবারীর আঘাতে তাকে হত্যা করবো ইনশা আল্লাহ।
মুসাইলামার এসব বাড়াবাড়ি সম্পর্কে হযরত আবূ বকর (রা.) জানতে পেরে রিদ্দার ফেৎনার মূলোৎপাটনের জন্য তিনি হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদের নেতৃত্বে ৪ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরণ করেন। উম্মে আম্মারা এটাকে এক মোক্ষম সুযোগ মনে করে খলীফাতুল মুসলেমীনের অনুমতি নিয়ে সৈন্য বাহিনীর সাথে গমন করেন। উভয় সৈন্য বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। মুসাইলামার বাহিনীর বীর বিক্রমে লড়াই করে। ১২ শত মুসলাম শহীদ হন। কিন্তু সত্য চির উন্নত থাকে। অনেক কাফের নিহত হয়। ইতিহাস গ্রন্থের এদের সংখ্যা ৮/৯ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংঘর্ষকালে হযরত উম্মে আম্মারা মুসাইলামাকে দেখে ফেলেন। বর্শা এবং তরবারী চালনা করে সারী ভেদ করে আঘাতের পর আঘাত খেয়ে তিনি মুসাইলামার নিকটে পৌঁছেন। এ সময় তার দেহে বর্শা এবং তরবারীর ১১টি আঘাত লাগে। কনুই পর্যন্ত একটা হাতও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তার ধৈর্যে এতটুকুও ফাটল ধরেনি। মুসাইলামার উপর আঘাত হানার জন্য তিনি সম্মুখে অগ্রসর হন। এসময় এক সঙ্গে দুটি তরবারীর আঘাত পড়ে মুসাইলামার উপর। আঘাত হানার জন্য তিনি সম্মুখে অগ্রসর হন। এসময় এক সঙ্গে দুটি তরবারীর আঘাত পড়ে মুসাইলামার দেহে। সে আহত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায়। তিনি ভালোভাবে তাকিয়ে দেখেন, পুত্র আবদুল্লাহ পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি পাপীকে হত্যা করেছে? জবাবে তিনি বললেন, এক তরবারী আমার পড়েছে আর এক তরবারী ওয়াহশীর। জানিনা, কার তরবারীর আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুতে উম্মে আম্মারা অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তখনই শুকরিয়ার সিজদা আদায় করেন।
তিনি যেহেতু ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন, একটা হাতও কেটে গিয়েছিল, খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। সিপাহসালার হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালীদও তার বীরত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেন এবং তাকে সম্মান করতেন। অত্যন্ত যত্নের সাথে তার সেবা করেন এবং চিকিৎসায় বিন্দু মাত্রও ত্রুটি করেন নি। তিনি সুস্থ হয়ে হযরত খালেদের প্রশংসা করে বলতেন, তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল, ভদ্র ও বিনয়ী সিপাহসালার। অত্যন্ত সহানুভূতি সহকারে তিনি আমার সেবা করেছেন।
একজন বীর-সাহাবী নারীর চরিত্র সম্পর্কে বেশি আলোচনা করার তেমন প্রয়োজন পড়েনা। স্বয়ং বীরত্বই এমন এক গুণ, যাতে নিহিত রয়েছে অনেক গুণাবলী। হযরত (সা.) তার কাছে এলে তিনি খাবার পেশ করেন। আল্লাহর রাসূল বললেন, তুমিও খাও। তিনি বললেন, আমি রোযা রেখেছি। নবীজী বললেন ঃ إن الصائم اذا اكل عنده صلت عليه الملئكة.
রোযাদারের কাছে কিছু খাওয়া হলে ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করেন।
এতো হচ্ছে তার প্রতি নবীজীর ভালোবাসার পরিচয়। নবীজীর পর হযরত আবূ বকর তাকে দেখতে যেতেন। হযরত উমর (রা.) তাকে অনেক সম্মান করতেন। তার খেলাফতকালে একবার গনীমতের মালের সাথে কিছু মূল্যবান কাপড়ও আসে। এর মধ্যে সোনালী কারুকার্য খচিত অতি মূল্যবান দোপাট্টাও ছিল। কেউ কেউ মত প্রকাশ করলো যে, এটা তার পুত্র হযরত আবদুল্লাহ্র বউকে দেয়া হোক। কেউ বললো, তার ধাত্রী কুলসুম বিনতে আলীকে দেয়া হোক। কিন্তু হযরত উমর বললেন, আমি উম্মে আম্মারাকে এজন্য সবচেয়ে বেশি হকদার মনে করি। কারণ, ওহোদ যুদ্ধের দিন আমি নবীজীকে বলতে শুনেছি ঃ ما التفت يوم أحد يمينا ولاشمالا إلا أراها تقاتل دونى .
-ওহোদ যুদ্ধের দিন আমি যেদিকেই তাকিয়েছি, সব দিকেই উম্মে আম্মারাকে দেখতে পেয়েছি। তিনি আমার হেফাযতে যুদ্ধ করেছিলেন।
সুতরাং দোপাট্টা তার কাছে প্রেরণ করা হয়।
নবীজী থেকে তিনি কয়েকটি হাদীসও বর্ণনা করেছেন। আব্বাস ইবনে তামীম ইবনে যায়েদ, হারেস ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে কা’আব এবং ইকরামা ও লায়লা তার সনদে এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন।
তার মৃত্যুকাল সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। মুসাইলামা কাযযাবের সাথে যুদ্ধের পরও তার বেঁচে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ইয়ামামা যুদ্ধের পর তিনি কত দিন জীবিত ছিলেন, তা জানা যায় না।

Related Post