আল-কুরআনুল কারীম মর্যাদা, শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা

বাংলা কুরআন

আল-কুরআনুল কারীম মর্যাদা, শিক্ষা ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা

পর্ব-২

প্রখম পর্ব

তিলাওয়াতের আদব ও আহকাম :

১. ইখলাস: সুতরাং লোকের প্রশংসা ও বাহবা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করা যাবে না। এবং একে জীবিকা নির্বাহের উপলক্ষণও বানানো যাবে না। বরং তিলাওয়াত কালে এ অনুভূতি ও আগ্রহ নিয়ে তিলাওয়াত করতে হবে যে, মহান আল্লাহ তাআলা তার মহান কালামের মাধ্যমে তাকে সম্বোধন করছেন। একাগ্রতা ও চিন্তা গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু সময় কাটানো এবং সুন্দর কণ্ঠের ক্বারীদের মিষ্টি আওয়াজ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করা ও শোনা-কোনটিই জায়েজ নেই।

নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: তোমরা কোরআন পড় এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর ; কারণ ভবিষ্যতে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা কোরআনের দ্বারা দুনিয়ার সুখ অন্বেষণ করবে। পরকালের সুখ কামনা করবে না। মুসনাদে ইমাম আহমদ।

২. মিসওয়াক করা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-মিসওয়াকের মাধ্যমে তোমার স্বীয় মুখ সুগন্ধি যুক্ত কর ; কেননা এটি কোরআনের রাস্তা।

৩. পবিত্রতা অর্জন করা: এটি আল্লাহ তাআলার কালামের মর্যাদা প্রদান ও সম্মান প্রদর্শন। অপবিত্রাবস্থায় গোসল না করে কোরআন তিলাওয়াত করা যাবে না। পানি না থাকলে বা অসুস্থতা ও এ জাতীয় কোন কারণে ব্যবহারে অক্ষম হলে তায়াম্মুম করবে। অপবিত্র ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহর জিকির এবং কোরআনের সাথে সামঞ্জস্যশীল বাক্যাবলীর মাধ্যমে দোআ করা জায়েজ। তবে ঐ বাক্যের মাধ্যমে তিলাওয়াত উদ্দেশ্য হওয়া যাবে না, উদ্দেশ্য হবে শুধু দোআ। যেমন-বলল : লাইলা ইল্লা আন্তা সুবহাকা ইন্নী কুন্তু মিনায যালেমীন

৪. তিলাওয়াতের জন্য অন্যায়: অশ্লীল ও অনর্থক কথা-বার্তা এবং হৈ চৈ মুক্ত-পাশাপাশি কোরআনের ভাব মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ স্থান নির্বাচন করা। সুতরাং অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে এবং কোরআন শোনার প্রতি অমনোযোগী সমাবেশে তিলাওয়াত করবে না। কারণ এতে কোরআনের অমর্যাদা হয়। অনুরূপভাবে শৌচাগার ইত্যাদিতেও কোরআন পড়া জায়েজ নেই। তিলাওয়াতের জন্য সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহ-এতে একই সাথে তিলাওয়াত এবং মসজিদ অবস্থান উভয় সওয়াব পাওয়া যাবে। সাথে সাথে ফেরেশতাদের ইস্তিগফারে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে-যখন নামাজের অপেক্ষায় থাকবে অথবা নামাজ আদায় করার পর বসবে।

তিলাওয়াত ও জিকিরের উদ্দেশ্যে যারা মসজিদে বসে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ বলেন: আল্লাহ যে সব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করেছেন এবং সে গুলোতে তার নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন এবং সেখানে সকাল সন্ধ্যায় তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্রয় বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে নামাজ কায়েম করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সে দিনকে যে দিন অন্তর ও দৃষ্টি সমূহ উলটে যাবে।

(তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে) যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রুজি দান করেন। (সূরা নূর-৩৬-৩৮)

৫. খুব আদবের সাথে: বিনম্র ও শ্রদ্ধাবনত হয়ে বসা। শিক্ষক সামনে থাকলে যেভাবে বসত ঠিক সেভাবে বসা। তবে দাঁড়িয়ে শুয়ে এবং বিছানাতেও পড়া জায়েজ আছে।

৬. আল্লাহর আশ্রয়: প্রার্থনার্থে আউযুবিল্লাহ …বলা এবং এটি মোস্তাহাব। আল্লাহ তাআলা বলেন :—

অর্থাৎ যখন তুমি কোরআন পড়ার ইচ্ছা করবে তখন বল- আউযুবিল্লাহি ‍মিনাশ শায়তানির রাজীম

(৭) সূরা তাওবা ব্যতীত অন্য সকল সূরার শুরুতে বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়া।

যদি সূরার মাঝখান থেকে পড়া হয় তাহলে  বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়ার প্রয়োজন নেই।

(৮) উপস্থিত ও সচেতন মন দিয়ে তিলাওয়াত করা। চিন্তা করবে কি পড়ছে। অর্থ বুঝার চেষ্টা করবে। মন বিনম্র হবে এবং ধ্যান করবে যে মহান আল্লাহ তাকে সম্বোধন করছেন। কেননা, কোরআন আল্লাহরই কালাম।

(৯) তিলাওয়াতের সময় কান্নাকাটি করা। এটি নেককার সালেহীনদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ বলেন- যারা এর পূর্ব থেকে ইলম প্রাপ্ত হয়েছে-যখন তাদের কাছে এর তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা নতমস্তক সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। এবং বলে : আমাদের পালনকর্তা পবিত্র, মহান। নি:সন্দেহে আমাদের পালনকর্তার ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা ক্রন্দন করতে করতে নতমস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় ভাব আরো বৃদ্ধি পায়। (সূরা ইসরা ১০৭-১০৯)

এবং যখন ইবনে মাসঊদ রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোরআন শোনাচ্ছিলেন, এবং পড়তে পড়তে – তখন কি অবস্থা হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হতে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী রূপে উপস্থিত করব। (সূরা নিসা:৪১)

-আয়াত পর্যন্ত পৌঁছোলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (ব্যাস, যথেষ্ট) আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখি তার নেত্র-দ্বয় অশ্রুসিক্ত। (বোখারি)

১০. তারতীল তথা ধীরে-ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দর করে পড়া। এভাবে পড়া মোস্তাহাব। কেননা আল্লাহ বলেন, ورتل القرآن ترتيلا অর্থাৎ কোরআন আবৃতি কর ধীরে ধীরে। স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। এভাবে পড়লে বুঝতে ও চিন্তা করতে সহজ হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এমনই পড়তেন, তিলাওয়াত করতেন। উম্মুল মোমিনীন সালমা রা.-ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এমনটিই বলেছেন যে প্রত্যেক শব্দ পৃথক পৃথক ও সুস্পষ্ট ছিল। আবু দাউদ-মুসনাদের রেওয়াতে এসেছে :

:রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক আয়াতের শেষে থামতেন। সাহাবি ইবনে মাসঊদ রা. বলেন

তোমরা কোরআনকে গদ্য আবৃত্তির ন্যায় বিক্ষিপ্তাকারে আবার কবিতার ন্যায় পঙ্‌ক্তি মিলিয়ে তিলাওয়াত করবে না (বরং কোরআনের স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখে তিলাওয়াত করবে) বিস্ময়কর বর্ণনা আসলে থামবে এবং হৃদয় নাড়া দেয়ার চেষ্টা করবে। সূরা শেষ করাই যেন তোমাদের কারো সংকল্প না হয়।

তারতীলের সাথে ধীরে ধীরে স্পষ্টকরে পঠিত অল্প তিলাওয়াত অনেক উত্তম, দ্রুততার সাথে পঠিত বেশি তিলাওয়াত থেকে।

কারণ তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য তো বুঝা ও চিন্তা করা এবং এটিই ঈমান বৃদ্ধি করে। তবে হ্যাঁ, দ্রুততার সাথে পড়তে গিয়ে যদি শব্দের উচ্চারণ ঠিক থাকে তাড়া হুড়ার কারণে কোন রূপ বিভ্রাট-বিভ্রান্তি ও অক্ষরবিয়োগ বা অতিরিক্ত কিছুর সংযোগ-ইত্যাদি সমস্যা না হয় তাহলে অসুবিধা নেই। এরূপ কিছু সৃষ্টি হলে বা উচ্চারণ বিভ্রাট দেখা দিলে হারাম হবে। তারতীলের সাথে পড়ার পাশাপাশি, তিলাওয়াতে রহমতের আয়াত আসলে আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ প্রার্থনা করা, আজাবের আয়াত আসলে তার নিকট আজাব ও বিপদ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং এগুলো থেকে নিরাপদ থাকার দোয়া করা, তার পবিত্রতার বর্ণনা সম্পর্কিত আয়াত আসলে سبحانه وتعالى বা جلت قدرته জাতীয় বাক্য বলে তার পবিত্রতার স্বীকৃতি দেয়া মোস্তাহাব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে সালাত আদায়কালে এমনটিই করতেন। মুসলিম।

(১১) কোরআন তিলাওয়াতের একটি আদব হলো-উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা। এটি মোস্তাহাব ও বটে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

আল্লাহ তাআলা নবীজীর উচ্চকণ্ঠে সুরেলা আওয়াজে কোরআন তিলাওয়াতকে যে রূপ গুরুত্ব সহকারে শ্রবণ করেন এরূপ গুরুত্ব দিয়ে অন্য কিছু শুনেন না।বোখারি ও মুসলিম।

এর দ্বারা কবুল ও পছন্দ করার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নবীজীর সুরেলা ও উচ্চকণ্ঠের তিলাওয়াতকে অন্য সকল আমলের চেয়ে অধিক পছন্দ করেন এবং কবুল করেন। কিন্তু তিলাওয়াত কারীর কাছাকাছি যদি কেউ থাকে এবং আওয়াজের কারণে তার কষ্ট-বিরক্তি বোধ করে-যেমন ঘুমন্ত ও সালাতরত ব্যক্তি-তাহলে আওয়াজ বড় করে তাদেরকে বিরক্ত করা যাবে না। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের নিকট এসে দেখলেন তারা উচ্চ আওয়াজে কিরাআত সহ সালাত আদায় করছে। তখন তিনি বললেন : তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় প্রতি পালকের সাথে একান্ত কথা বলছ। অতএব কোরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে একে অন্যের উপর আওয়াজ বড় কর না। বর্ণনায় ইমাম মালেক রহ.।

(১২) সুন্দর আওয়াজ ও সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: তোমরা স্বীয় আওয়াজের মাধ্যমে কোরআনকে সুন্দর কর। আবু দাউদ।

তিনি আরো বলেন: যে ব্যক্তি সুরেলা কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত করে না (করাকে পসন্দ করে না) সে আমাদের দলভুক্ত নয়। বোখারি শরীফ। তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের টানাটানি ও স্বর দীর্ঘ করার চেষ্টা করবে না।

(১৩) তিলাওয়াত কালে কোরআনের আদব ও ইহতেরামের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অহেতুক কাজ থেকে এবং চোখ, কান, এদিক সেদিক তাকানো থেকে বিরত রাখতে হবে।

(১৪) ধারাবাহিক ও বিরতিহীন তিলাওয়াত করে যাওয়া। প্রয়োজন ব্যতীত মাঝখানে বিরতি না দেয়া। তবে হ্যাঁ সালামের উত্তর, হাঁচির জবাব, এবং এ জাতীয় প্রয়োজনে থামার অনুমতি আছে বরং এগুলো মোস্তাহাব, যাতে সওয়াব থেকে বঞ্চিত না হয়। অত:পর আউযু বিল্লাহ পড়ে নতুন করে তিলাওয়াত শুরু করবে।

(১৫) সেজদার আয়াত পড়লে সেজদা করা। সেজদা ওজু অবস্থায় হতে হবে। আল্লাহ আকবার বলে সেজদায় سبحان ربي الأعلى এবং অন্যান্য দোয়াও পড়বে। সেজদার তিলাওয়াতে সালাম নেই। যদি নামাজরত অবস্থায় সেজদার আয়াত তিলাওয়াত করা হয় তাহলে নামাজেই সেজদা দিতে হবে। আল্লাহু আকবার বলে সেজদায় যাবে এবং আল্লাহু আকবার বলে উঠবে।

(১৬) কোরআন খতম করার পর দোয়া করা। যিনি কোরআন খতম করবেন তার পক্ষে দোয়া করা মোস্তাহাব। সাহাবি আনাস বিন মালেক রা. সম্পর্কে প্রমাণিত যে তিনি কোরআন খতম করলে পরিবারস্থ সকলকে একত্রিত করে তাদের নিয়ে দোয়া করতেন। দারেমী।

(২) কোরআনুল কারীম হিফয করা :

কুরানুল কারীম হিফয করা, কোরআনের গুরুত্ব প্রদান এবং তদানুযায়ী আমলের আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের দলিল বহন করে। তাছাড়া একজন মুসলমানকে দৈনন্দিন জীবনে যে কাজগুলো করতে হয় সেগুলো সুন্দর ও সার্থক ভাবে সম্পূর্ণ করতে হলে কোরআন হিফয ছাড়া উপায় নেই। কারণ তাকে সালাতে ইমামতি করতে হয়। সেখানে কোরআনের প্রয়োজন। ধর্মীয় আলোচনা করতে হয়। খুতবা দিতে হয় সেখানে কোরআন থেকে দলিল উপস্থাপনার প্রয়োজন পড়ে। বাচ্চাদের হিফয করাতে হয়-এতসব কাজ করতে গেলে কোরআন হেফয না করে কি ভাবে সম্ভব ?

তাছাড়া পৃথিবীতে হাফেযে কোরআনরাই কোরআনে কারীমের তিলাওয়াত সবচে বেশি করেন। তারা যখন হেফয করে তখন একটা আয়াত কতবার করে পড়তে হয় ? হেফয শেষ করে ইয়াদ রাখার জন্য সারা জীবন খুব করে তিলাওয়াত করতে হয়। এছাড়া একজন হাফেযে কোরআন কোরআন মুখস্থ থাকার কারণে যখন ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছা…তিলাওয়াত করতে পারেন। যেমন সালাত, চলার পথে, গাড়িতে থাকা অবস্থায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে ইত্যাদি। এ সুযোগ তো হাফেয ব্যতীত অন্যরা পায় না। এত সব কারণে কোরআন হেফয করার ফজিলত সম্পর্কে অনেক গুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

(১) কোরআন ভালভাবে হিফযকারী পূত-পবিত্র। সম্মানিত ফেরেশতাদের শ্রেণিভুক্ত। রসুলুল্লাহ সা. বলেন : হাফেযে কোরআন যিনি সব সময় তিলাওয়াত করেন তার তুলনা লেখার কাজে নিয়োজিত পূত পবিত্র, সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে, আর যিনি কষ্ট স্বীকার করেও নিয়মিত তিলাওয়াত করেন, তার সওয়াব দ্বিগুণ। বোখারি।

(২) হাফেযে কোরআন সালাতে ইমামতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। রাসূল সা. বলেন – আল্লাহর কিতাব সর্বাধিক পাঠকারী অভিজ্ঞরাই লোকদের ইমামতি করবে। (মুসলিম শরীফ) 

৩) হাফেযে কোরআন হেফয করার মাধ্যমে জান্নাতের উচ্চ মাকামে আরোহণ করতে পারে।)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন – কোরআন তিলাওয়াতকারীকে বলা হবে, পড়তে থাক এবং মর্যাদার আসনে উন্নীত হতে থাক এবং তারতীলের সাথে সুন্দর করে পড়। যেরূপ পৃথিবীতে পড়তে। নিশ্চয় তোমার মর্যাদার আসন হবে তোমার পঠিত আয়াতের শেষ প্রান্তে। আহমদ, তিরমিজি।

এ হাদিসে তিলাওয়াতকারী বলতে হাফেযকে বুঝানো হয়েছে। এ দাবির সমর্থনে দুটি যুক্তি পেশ করা যায়। (ক) তাকে বলা হবে- اقرأ অর্থাৎ তুমি পড়। অথচ সেখানে কোন মাসহাফ থাকবে না। (যে দেখে দেখে পড়বে)

(খ) এখানে একটি তুলনা মূলক বিশেষ সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি মাসহাফ থেকে দেখে দেখে তিলাওয়াত করাকেও শামিল করা হয় তাহলে এখানে তার বিশেষত্ব রইল কোথায় ? কারণ তখন তো সকল মানুষই এ মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। সুতরাং এখানে হাফেযে কোরআনই উদ্দেশ্য। তিলাওয়াতকারী হাফেয তার হেফযকৃত অংশ তিলাওয়াত করে এক পর্যায়ে শেষ করে বিরতি দেয় ও থামে। এ ভাবে তার মর্যাদার আসন ও তিলাওয়াত করে সমাপ্তকৃত আয়াতের শেষ প্রান্তে।

(৪) হাফেযে কোরআনকে সম্মানের মুকুট ও মর্যাদার পোশাক পরানো হবে। এবং মহান আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন :— কিয়ামতের দিবসে কোরআন এসে বলবে হে আমার প্রতিপালক : একে (হাফেয) পোশাক পরিধান করাও। তখন মর্যাদার মুকুট পরানো হবে। এর পর বলবে হে মালিক, আরো পরাও। তখন তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। অত:পর (কোরআন) বলবে : হে পরওয়ারদেগার, তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। তখন বলা হবে : পড়তে থাক এবং মর্যাদার ধাপে উন্নীত হতে থাক এবং তাকে প্রত্যেক অক্ষরের বিনিময়ে নেকি বাড়িয়ে দেয়া হবে। (তিরমিজি শরীফ)

(৫) কোরআন মজিদ হেফয করা মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতার উৎকৃষ্ট ও পবিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রশংসিত ঈর্ষণীয় ক্ষেত্র বা বস্তু। নবী সা. বলেন – একমাত্র দুই ব্যক্তির উপর ঈর্ষা করা যায়। এক ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কোরআনের ইলম দান করেছেন, সে দিবা রাত্রি ঐ কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত থাকে। দ্বিতীয় সে ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা ধন-সম্পদ দান করেছেন। সে তা দিনরাত (বৈধ কাজে) খরচ করে। (বুখারী, মুসলিম)

হাদিসে বর্ণিত হাসাদ (হিংসা) এর অর্থ এখানে গিবতাহ। (ঈর্ষা) হাসাদ ও গিবতাহর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে-গিবতাহ বলা হয় : অর্থাৎ অপরের নেয়ামত দেখে সেটি ধ্বংস ও নি:শেষ হয়ে যাওয়ার কামনা না করেই নিজের মধ্যে অর্জন করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা। আর হাসাদ বলা হয়- অর্থাৎ কারো নেয়ামত দেখে তা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কামনা করা। এবং অন্তর জ্বালায় ভুগতে থাকা।

কোরআন হেফয করার এতসব মর্যাদা ও সম্মান ; তাই সংগত কারণেই সকল মুসলমানের উচিত হবে স্বীয় ক্ষমতা ও শক্তি অনুযায়ী কোরআন হেফয করার এ মহৎ কাজে অংশ গ্রহণ করা। পূর্ণ কোরআন না হোক অন্তত যেটুকু পারা যায় সেটুকুই হোক। একে বারে কিছু না হওয়ার চেয়ে অল্প হোক তাও ভাল। এক্ষেত্রে সর্ব প্রথম ও প্রধান আদর্শ হচ্ছেন স্বয়ং রাসূলে কারীম সা.-যিনি সর্ব প্রথম কোরআন হেফযকারী। অত:পর তার সাহাবিবৃন্দ রা. যাদের মধ্যে অনেক হাফেয ছিলেন। কেউ পূর্ণ কোরআন হেফয করেছেন আবার কেউ কিছু অংশ।

বিরে মাউনার যুদ্ধেই তাদের সত্তরজন শহীদ হয়েছেন আর নবুয়্যতের ভণ্ড দাবিদার মুসাইলামাতুল কাযযাব-এর সাথে সংঘটিত ইয়ারমুক লড়ইয়ের আরো সত্তরজন। বিশেষ করে বর্তমান যুগে হেফয করা কত সহজ হয়েছে, যা বিগত দিনে তাদের যুগে ছিল না। বর্তমানে সুন্দর সুন্দর ছাপার মাসহাফ রয়েছে বাজারে। হেফযের প্রশিক্ষকগণ অধিকহারে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন প্রতি নিয়ত। এছাড়া আরো বহু সুযোগ সুবিধা রয়েছে। যা কোরআন হেফয করাকে অতি সহজ করে দিয়েছে। তাই আমাদের সকলেরই এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। এতে করে আমাদের হৃদয় আল্লাহর জিকির দ্বারা আবাদ থাকবে।

এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের সন্তানদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া এবং তাদেরকে কোরআন হেফয করানোর বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কেননা ছোটরা হেফযের ক্ষেত্রে বড় ও বয়স্কদের চেয়ে অধিক সামর্থ্যবান। প্রবাদ আছে : ছোট বয়সে হেফয করা যেমন পাথর খোদাই করে চিত্রাঙ্কন করা। এ বয়সে তাদের মন মস্তিষ্ক থাকে পরিষ্কার। সময় পায় প্রচুর। অবসরে থাকে বিস্তর সময়। তা ছাড়া আমরা তাদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য দায়িত্বশীল। আল্লাহ তাআলা বলেন- হে মোমিনগণ ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর। যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাব ফেরেশতাগণ, তারা আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেন তা অমান্য করেন না, এবং তারা যা করতে আদিষ্ট হয় তা-ই করে। (সূরা-তাহরীম : ৬)

তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, কোরআনুল কারীমের শিক্ষা দেয়া, এবং এটিই হেদায়াত ও হেদায়াতের উপর অটল অবিচল থাকার বড় মাধ্যম এটি এমন একটি ফলদায়ক আমল যার কার্যকারিতা মৃত্যুর পর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

কোরআন হেফয করা যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ঠিক ততটুকু গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে হেফয সমাপন করার পর তা ধরে রাখার জন্য বেশি বেশি ও বার বার তিলাওয়াত করা। কেননা কোরআন স্মৃতি থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- তোমরা কোরআন তিলাওয়াতে খুব যত্নবান হও। কসম সে সত্তার যার হাতে মুহাম্মদের জীবন : নিশ্চয় কোরআন রশিতে আবদ্ধ উটের চেয়েও অধিক পলায়নপর। বোখারি-মুসলিম।

তৃতীয়ত: কোরআন বুঝা ও গবেষণা করা:

কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াত ও হেফয করার গুরুত্ব অপরিসীম। এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার জো নেই। তবে শুধুমাত্র তিলাওয়াত ও হেফযই যথেষ্ট নয়। কারণ আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত কোরআন নাজিল করেছেন তদনুযায়ী আমল করার জন্য। আর না বুঝে আমল করা অসম্ভব। এমনি করে বুঝার জন্য চিন্তা ও গবেষণা অপরিহার্য। গভীর চিন্তা ও গবেষণা ব্যতীত কোরআন থেকে উপকৃত হওয়ার আশা করা যায় না। আল্লাহ তাআলা বলেন :—এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার অনুধাবন করার মত অন্তর রয়েছে। অথবা যে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে। (সূরা : ক্বাফ : ৩৭)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে জীবিত ও সক্রিয় অন্তর সম্পন্ন লোক ছাড়া কেউ কোরআন দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন –এটি একটি উপদেশ ও সুস্পষ্ট কোরআন বৈ অন্য কিছু নয়। যাতে তিনি সতর্ক করতে পারেন জীবিতকে। (সূরা : ইয়াসীন : ৬৯-৭০)

এখানে জীবিত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবন্ত অন্তর। কোরআন বুঝার জন্য জীবন্ত অন্তরের পাশা পাশি নিবিষ্ট চিত্তে শ্রবণের প্রয়োজন রয়েছে। যেমনি ভাবে প্রয়োজন রয়েছে পূর্ণ একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে মনোযোগী হওয়ার। অন্য কাজে ব্যস্ত থেকে ও অন্য ধ্যানে মগ্ন হয়ে কোরআন শোনাতে কোন লাভ নেই। এতে কিছুই বুঝে আসবে না বরং তার জন্য প্রয়োজন সব কিছু থেকে ফারেগ হয়ে এক মনে ও এক ধ্যানে নিমগ্ন থাকা ও গভীর মনোযোগী দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। তাদাব্বুর তথা চিন্তা ও গবেষণার অর্থ হচ্ছে, কোরআনের অর্থ ও তাৎপর্য, প্রমাণ ও নির্দেশনা, ঘটনাবলী ও কিচ্ছা কাহিনি, শিক্ষা ও উপদেশ এবং আদেশ ও নিষেধের ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা ও অনুধাবন করা। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বহু জায়গায় এরূপ চিন্তা ও গবেষণাকে ওয়াজিব বলে বর্ণনা করেছেন। যেমন এ জায়গায় বলেন :— এটি একটি কল্যাণময় কিতাব। যা আমি আপনার উপর অবতীর্ণ করেছি। যাতে মানুষ এর আয়াত সমূহ অনুধাবন করে এবং বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা : ছোয়াদ : ২৯)

মুনাফেকদের প্রত্যাখ্যান করে বলেন :— তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না। না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ ? (সূরা মুহাম্মদ : ২৪)বুঝা যাচ্ছে : কোরআন অনুধাবন ও চিন্তা গবেষণা পরিত্যাগ করার কারণে মুনাফেকদের সাথে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

Related Post