সমস্ত প্রশংসা সেই সুমহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালকের, যিনি এই আসমান জমিন তথা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুরই সৃষ্টিকর্তা। অসংখ্য দরূদ ও সালাম সেই মহামানব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন, তাঁর সহচরবৃন্দ (রাঃ) এবং কিয়ামত পর্যন্ত যে সকল মুমিন নর-নারী উত্তমরূপে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলবেন, তাদের পবিত্র রূহ মোবারকের উপর।
দুনিয়াতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালার নিয়ামতের সঠিক হিসাব কোন মানুষের পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামতগুলোর মধ্যে রোযা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। আর সেই রোযা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দয়াময় আল্লাহ তায়ালা বলছেন ঃ
“হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ন্যায় তোমাদের উপরও রোযা অপরিহার্য কর্তব্যরূপে নির্ধারিত করা হল, যেন তোমরা (যে কোন অবৈধ অপতৎপরতা থেকে) সংযমশীল হতে পারো।” (সূরা:বাকারা:১৮৩) আর যে পবিত্র মাসে রোযাকে ফরয করা হয়েছে সেই মাস সম্পর্কেও দয়াময় আল্লাহ বলছেনঃ “রমযান মাস, যার মধ্যে বিশ্বমানবের জন্যে পথ প্রদর্শক এবং সু-পথের উজ্জল নিদর্শণ ও (হক ও বাতিলের) প্রভেদকারী কুর’আন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সে মাসে উপস্থিত থাকে, সে যেন রোযা রাখে এবং যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির তার জন্যে অপর কোন দিন হতে গণনা করেবে; তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না এবং যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তজ্জন্যে তোমরা আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনা কর এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” (সূরা: বাকারা:১৮৫)।
দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা কুরআন নাযিলের মাস হিসেবে রমযানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে কুর’আন নাযিল হওয়াই এ মাসকে মহিমান্বিত করেছে। কাজেই মানুষের চলার পথের কল্যাণময় দিক নির্দেশনা হিসেবে যে কুর’আন প্রেরিত হয়েছে, সেই কুর’আনের বাণী বা নির্দেশনাকে উপলব্ধি করতে এবং নিজ জীবনে রমযানের শিক্ষাকে প্রতিফলিত করতে এ মাসটিতে রয়েছে পূণ্যময় সুযোগ। রোযার এ পবিত্র মাসে আত্মউপলব্ধি ও আত্মগঠনের শিক্ষা ও অনুশীলন কুর’আন থেকেই নিতে হবে। কারণ মানব জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য যাবতীয় সংকট ও সম্ভবনার দিকনির্দেশনা আল-কুরআনেই রয়েছে। অতএব কুর’আনকে পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ না করে কিংবা এর মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা না করে, নিজেকে মুসলমান ভাবা যথার্থ নয়। মানুষ যদি জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে যেমন: ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক. রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যে কোন বিষয়েই হোক, কুর’আন তথা আল্লাহর নির্দেশনাকে না মেনে, অন্য পথ ও মতের উপর চলে, তবে সে যে বিপথগামী হলো, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কুরআনী জীবন, কুরআনী মূল্যবোধ গঠনে রমযানের প্রশিক্ষণ এবং প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও পুরস্কারের যে ঘোষণার কথা জানা যায় কুরআনের সত্যিকার অনুসারী হওয়ার মাধ্যমেই রয়েছে কুরআন নাযিলের মাস রমযান উদযাপনের সার্থকতা। প্রকৃত পক্ষে রোযা এমন এক ইবাদত, যার কোন বাহ্যিক ও দৃশ্যমান কোন রূপ নেই। কেউ তা সঠিকভাবে পালন করে কিনা রোযাদার নিজে ও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়, এ জন্যেই মহান আল্লাহ বলছেন: “রোযা কেবলমাত্র আমারই জন্যে এবং আমিই কেবলমাত্র এর প্রতিদান দিব” (হাদীসে কুদসী) সে কারণে রোযার মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সৃষ্ট বান্দার যে অদৃশ্য বন্ধনের সৃষ্টি হয়, তা নিছক উপবাসের কষ্ট নয়, বরং কষ্টের উর্ধ্বে এক ভিন্নতর প্রাপ্তি ও উপলব্ধি। যা সেই ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ অনুভব করতে পারবে না। আর এ জন্যেই আল্লাহ প্রেরিত প্রাণপ্রিয় রাসূল মানবতার মুুক্তির দূত হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা এবং তদানুযায়ী আমল করা পরিত্যাগ করতে পারলো না, তার (রোযা উপলক্ষে) খানা-পিনা পরিত্যাগ করার মধ্যে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” {আবু হুরাইরা (রা:) কর্তৃক বুখারী থেকে সংগৃহীত} রোযা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে বলেছেন: রোযা এ জন্যেই রাখতে হবে যাতে তাঁর বান্দা-বান্দিগণ যাবতীয় অকল্যাণজনক কাজ থেকে সংযমশীল হতে পারে। আর যা থেকে সংযমশীল হতে হবে সেই বস্তুগুলো যেমন ঃ যেনা-ব্যভিচার, সুদ-ঘুষ, মদ্যপান, জুয়াখেলা, যে কোন মাদকদ্রব্য সেবন, জুলুম, মিথ্যা, পরনিন্দা, গীবত, চোগলখুরী, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, কাউকে অন্যায়ভাবে ধিক্কার দেয়া ইত্যাদি মানুষের যে কোন ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার নামই সংযমশীল হওয়া। আর সে বিষয়গুলোর কথা পবিত্র আল-কুরআনের পাতায় পাতায় লিখা রয়েছে। যেমন আল্লাহ ওয়াতাআলা যেনা ও ব্যভিচার সম্পর্কে বলছেন ঃ “তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হইওনা, কারণ উহা নির্লজ্জ ও নিকৃষ্ট আচরণ ।” (সূরা: বনি ইসরাইল: ৩২) আর সুদ সম্পর্কে আল্লাহর বাণীঃ “যারা সুদ ভক্ষণ করে, তারা শয়তানের স্পর্শে মোহাবিষ্ট ব্যক্তির দণ্ডায়মান হওয়ার অনুরূপ ব্যতীত দণ্ডায়মান হবে না।” (সূরা:বাকারা:২৭৫) আর তাই তিনি সকল মু’মিন নর-নারীকে লক্ষ্য করে বলছেনঃ “হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ! আল্লাহকে ভয় কর, যদি তেমরা মু’মিন হও, তবে সুদের মধ্যে যা বকেয়া রয়েছে তা বর্জন কর।” (সূরা: বাকরা: ২৭৮) আর পর নিন্দা, চোগলখোরী ও গীবত সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা ঃ “দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সন্মুখে লোকের নিন্দা করে।” (সূরা: হুমাযাহ:১)্। সূরা হুজুরাতে আল্লাহ বলছেন ঃ “হে মুমিনগণ! (তোমাদের মধ্যে) কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী যেন অপর কোন নারীকেও উপহাস না করে, কারণ যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারূপ করোনা এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না; ঈমানের পরে মন্দ নামে ডাকা গর্হিত কাজ। যারা এ ধরনের আচরণ হতে নিবৃত্ত না হয় তারাই অত্যাচারী।” (আয়াত: ১১) অপর একটি আয়াতে আল্লাহ বলছেনঃ “হে মু’মিনগন! তোমরা বহুবিধ ধারণা হতে বিরত থাকো; কারণ কোন কোন ধারণা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না।” (হুজুরাত:১২) আর সব চেয়ে যে নিকৃষ্ট বিষয়টি সমস্ত পাপের জননী সেটাই আমাদের সমাজে বেশি ব্যবহৃত হয়, আর তা হচ্ছেঃ সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করা। আর সে ব্যাপারেই মহান আল্লাহর বাণীঃ “আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং সে সত্যকে গোপন করো না, যেহেতু তোমরা তা অবগত আছো।” (সূরা: বাকারা: ৪২) আর তাই উর্পযুক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও আরো অনেক ক্ষতিকর বিষয় রয়েছে, যে গুলো পরিহার করে চললেই কেবল মানুষ এ দুনিয়াতেও মহাকল্যাণ উপভোগ করতে পারবে, তদ্রƒপ আখেরাতেও। আর সেই গর্হিত ধ্বংসাত্মক কাজগুলো থেকে যাতে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, তারই প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্যে দয়াময় প্রতিপালক প্রতি বছরেই রোযাকে মু’মিন বান্দা-বান্দীর সামনে এনে উপস্থিত করেন, যাতে তারা তা থেকে আত্মসংযমের প্রশিক্ষণ নিয়ে কল্যাণ লাভ করে ধন্য হতে পারে। আর তাই রোযার ব্যাপারে আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “রোযা (যাবতীয় গোনাহ হতে রক্ষার জন্যে) ঢাল স্বরূপ, সুতরাং রোযাদার অশ্লীল কথা বলবেনা, জাহেলী আচরণ করবে না। আর কোন ব্যক্তি যদি তার সাথে মারামারি করতে চায়, গালমন্দ করে তাহলে সে যেন দু’বার বলে (দেখুন) আমি রোযাদার। ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেসক্ আম্বরের চেয়েও উৎকৃষ্ট। (আল্লাহ বলেন) সে খানা-পিনা এবং কামভাবকে আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে পরিত্যাগ করে থাকে। রোযা আমার জন্যে এবং আমি তার প্রতিদান দিব। আর নেক কাজের পুরস্কার দশগুন পর্যন্ত (ন্যূনপক্ষে) দেয়া হয়ে থাকে।” (বুখারী আবু হুরায়রা রা: থেকে)
মানুষের সঠিক ও কল্যাণময় জীবন পরিচালনার জন্যেই পবিত্র আল-কুরআনের পাতায় পাতায় বিভিন্ন আদেশ নিষেধ লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেই বিষয়গুলো মেনে চলার জন্যে মানুষ যাতে তাকওয়া অর্জন করতে পারে, তারই প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে আমাদের সামনে প্রতি বছরেই রোযা এসে হাজির হয়। তাই রমযানের এ পবিত্র মাসে সঠিকভাবে তাকওয়া অর্জনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, যখন আমরা আমাদের নিজেদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবো, কেবল তখনই হবে আমাদের রমযানের সিয়াম সাধনা তথা রোযা রাখা, কুরআন তেলাওয়াত করা, সালাতুল কিয়াম তথা ক্কদর উদযাপন, দান-সাদকা প্রদানসহ যাবতীয় ফরজ, সুন্নাত ও নফল ইবাদত করার সার্থকতা।
দয়াময় প্রতিপালক সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের সকল মু’মিন নর-নারীকে সঠিকভাবে রোযার মর্মার্থ বুঝে রোযা পালনের তাওফিক দান করুন, এবং সকলকেই তাকওয়া অর্জনকারী মুত্তাকী বান্দা-বান্দী হিসেবে কবুল করুন। আমিন॥