ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য এক সর্বজনীন ও শাশ্বত জীবনবিধান ।এতে রয়েছে মানবকল্যাণের এক অনির্বাণ পথনির্দেশনা । ইসলাম আত্মগঠন ও সুশীল সমাজ বিনির্মাণে যে মহান শিক্ষা বিশ্বমানবের সমীপে উপস্থাপন করেছে, তা এ পৃথিবীর প্রচলিত অন্যান্য ধর্মে সত্যিই বিরল । ইসলাম প্রদর্শিত শিক্ষা ও মহৎ গুণাবলির মধ্যে ক্ষমা ও উদারতা এক অনন্যসাধারণ গুণ । ক্রোধের বহ্নিশিখাকে পদদলিত করে ইসলাম মানবজাতিকে সহনশীল, ক্ষমাপ্রবণ ও উদার হওয়ার উপদেশই শুধু দেয়নি, বরং তা কাজে পরিণত করে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । মানুষে-মানুষে হানাহানি, রক্তপাত, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা ও কদর্যতা পরিহার করে ইসলাম সমগ্র মানবজাতিকে ক্ষমা ও উদারতার বন্ধনে আবদ্ধকরণের মাধ্যমে জাতিভেদে সব মানুষকে এক উম্মাহে পরিণত করেছে ।
মহানবী (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির পর ২৩ বছরে নবী জীবনে ক্ষমা ও উদারতার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে । মুসলিম-অমুসলিম সব ঐতিহাসিক অকপটে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, তলোয়ারে নয়, উদারতাতেই ইসলামের দিগন্ত অতি অল্প সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপ্তি লাভ করেছে । আল কোরআন একজন আদর্শ মানুষ ও প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলি মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছে তার মধ্যে ক্ষমা ও উদারতাকে উত্তম গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে । আল কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে, ‘যারা সব অবস্থায়ই নিজেদের মাল খরচ করে খারাপ অবস্থায়ই থাকুক আর মন্দ অবস্থায়ই থাকুক, যারা রাগকে দমন করে এবং অপরের দোষ মাফ করে দেয়, এমন নেক লোক আল্লাহ খুবই পছন্দ করেন (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪)
অনুরূপভাবে আল কোরআনের অসংখ্য আয়াতে সংকীর্ণতা পরিহার করে উদারতা ও ক্ষমা করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে । যেমন বলা হয়েছে, ‘তাদের মাফ করে দেওয়া উচিত এবং তাদের দোষ না ধরা উচিত । তোমরা কি চাও না, আল্লাহ তোমাদের মাফ করুন ।আল্লাহ ক্ষমাশীল ও মেহেরবান (সুরা : আন-নূর, আয়াত : ২২)
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আমি আসমান ও জমিনকে এবং এ দুটির মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুই হক ছাড়া আর কোনো ভিত্তিতে সৃষ্টি করিনি ফয়সালার সময় অবশ্যই আসবে, তাই (হে নবী!) আপনি তাদের ভদ্রভাবে মাফ করে দিন (সুরা : আল-হিজর, আয়াত : ৮৫)
প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যাকে ক্ষমা করা হয় তা-ই প্রকৃত ক্ষমা এরূপ ক্ষমার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ।কেবল এরূপ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা (রা.)তিনি ছিলেন মহান চরিত্রের অধিকারী । তিনি লোকদের অহেতুক অভদ্র ও অশালীন আচরণ সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে সর্বদা ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শন করতেন।কখনো প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না । মুখ দিয়ে খারাপ কথা উচ্চারণ করতেন না কিংবা শাস্তিও দিতেন না । এমনকি তিনি কাউকে বদ্দোয়াও দেননি । ক্ষমা ও উদারতাই ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ । হজরত আয়শা (রা.) নবীজি (সা.)-এর ক্ষমাগুণের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তিনি কখনো নিজের ব্যাপারে কারো থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি । তবে আল্লাহর দ্বীন ও তাঁর বিধিবিধানের অবমাননা করা হলে তিনি সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন (সহিহুল বুখারি)
হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘একদা জনৈক ইহুদি নারী নবীজি (সা.)-এর কাছে বিষমিশ্রিত বকরির ভুনা মাংস আহারের জন্য নিয়ে আসে রাসুল (সা.) ওই মাংস খাওয়া শুরু করলেন তাঁর সঙ্গে আরো কিছু সাহাবিও খাওয়া শুরু করেছিলেন। একবার মুখে দিতেই নবীজি (সা.) সাহাবিদের খাওয়া বন্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, এ মাংসে বিষ মিশ্রিত রয়েছে। তৎক্ষণাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইহুদি মহিলাকে ডেকে পাঠালেন । মহিলা আসার পর নবীজি (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন মাংসে বিষ মিশিয়েছ?’ সে বলল, ‘আপনাকে কে বলেছে যে আমি বিষ মিশ্রিত করেছি?’ তিনি বললেন, ‘আমার হাতের এই মাংসের টুকরোটি সাক্ষী দিচ্ছে ‘ তখন ইহুদি মহিলা বিষয়টি স্বীকার করল এবং বলল, ‘আমি আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য বিষ মিশিয়েছি ‘ এরপর নবীজি (সা.) ওই মহিলাকে তার প্রাণনাশের চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো শাস্তি দেননি, বরং ক্ষমা করে দিয়েছিলেন ‘ একবার রাসুলে করিম (সা.)-কে বলা হলো ‘আপনি মুশরিকদের বা মূর্তিপূজকদের জন্য অভিশাপ দিন ‘ তিনি উত্তর দিলেন ‘আমি জগতের রহমতস্বরূপ পদার্পণ করেছি, অভিশাপস্বরূপ নয়’ (মুসলিম)
মানুষ তাঁর দয়া, উদারতা, ক্ষমা ও সহনশীলতার অনুপাতে আল্লাহর কাছে মর্যাদাশীল হবে । এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা হজরত আবু বকর (রা.)-কে তাঁর বন্ধুদের অভিশাপ দিতে বারণ করে বললেন, সিদ্দিকী বা সত্যবাদী কখনো অভিশপ্তকারী হতে পারে না (মুসলিম)
মর্যাদা ও ঐতিহ্য বৃদ্ধির উপায় হিসেবে রাসুল (সা.) বর্ণনা করেছেন, ‘তোমার সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করে, তুমি তার সঙ্গে ধৈর্যধারণ করো । অত্যাচারীকে ক্ষমা করো । যে তোমাকে নিঃস্ব করল, তুমি তাকে দান করো । যে তোমার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করল, তুমি তার সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করো’ (তাবারানি)
মহানবী (সা.) মাহারিবে খাসফা নামক স্থানে বনু গাতফানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অবস্থান করছিলেন । কাফেররা মুসলমানদের অসতর্কতার সুযোগ খুঁজছিল । এমন সময় নবীজি (সা.) একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করছিলেন । একজন অবিশ্বাসী চুপিসারে এসে তলোয়ার নিয়ে তাঁর শিয়রে দাঁড়িয়ে বলল, এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ’ তৎক্ষণাৎ কাফেরের হাত থেকে তরবারিটি পড়ে গেল । এবার মহানবী (সা.) তরবারিটি নিয়ে তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দিলেন । সে তার শিবিরে গিয়ে সঙ্গীদের বলতে লাগল, ‘আমি সর্বোত্তম ব্যক্তির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এসেছি ‘ এরপর সে ইসলামের ঘোষণা দিয়ে মুসলমান হয়ে যায়।
এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যা প্রমাণ করে মহানবী (সা.)-এর ক্ষমা ও উদারতার বিশেষ গুণের জাহেলি বর্বরতা দূর করতে ক্ষমা ও উদারতা প্রদর্শন করে মানবতা ও নৈতিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি ।
ক্ষমা ও উদারতা দৃঢ় চরিত্রের প্রধান অঙ্গ । এই মহৎ গুণ দ্বারা অনেক ক্ষেত্রেই লাগামহীনভাবে বশীভূত করা যায় । এই মহিমান্বিত মর্যাদা শুধু মনোনীত ব্যক্তিদের আল্লাহ দান করেন ।যুগে যুগে এই মর্যাদার অধিকারীরা অমর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছেন, রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন, নবী-রাসুল হয়েছেন । তাই সর্বদা লক্ষ করা দরকার, অন্যায়ের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আমরা যেন আগ্রহী না হই । কেননা আজকের অন্যায়কারী, কাল মহৎ গুণ কিংবা মহৎ মানুষের ছোঁয়া পেলে মহৎজনে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে তার অনেক নজির আছে । সমাপ্ত