এই তো ক’দিন পূর্বে আমরা রোযা রাখা শুরু করেছিলাম, দেখতে দেখতে মাহে রমযান চলে গেল। এই মাসটি বিশেষ কিছু বান্দাহ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনা করেছেন। দিনে রোযা রাখার সঙ্গে সঙ্গে রাতে তারাবীর নামায ও কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ নামাযেও ব্রতি ছিলেন। আমাদের সবার কাছ থেকেই মাহে রমযান বিদায় নিয়েছে, জানিনা আগামী রমযান আমরা পাবো কিনা। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত এই মাহে রমযানের কৃত আমলকে ধরে রেখে বাকী এগারোটি মাস অতিক্রম করা। সালফে সালেহীনগণ ছয় মাস পূর্ব থেকেই রমযানের বরকত পাওয়ার জন্য দোয়া করতেন। রমযান মাস পাওয়ার পর ছয় মাস দোয়া করতেন যেন আল্লাহ রমযানে কৃত আমল কবুল করেন। অবশ্য মাহে রমযানে সাধারণ মুসলমানের দ্বীনের প্রতি আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখে অন্তরে খুশির বন্যা বয়ে যায়। কারণ যে দিকেই চোখ ফিরানো হয় সেদিকেই দেখা যায় নেক আমলের ঢল। মনে হয় ইসলামের জয় জয়কার। কিন্তু…? ঈদ ও তার পরবর্তী দিনগুলো উক্ত সুধারণার সত্যায়ন করে, অথবা সব ধারণা গুণাহমিশ্রিত আনন্দে ভেস্তে যায়।
যে ব্যক্তি মাহে রমযান ও রমযান পরবর্তী মানুষের অবস্হা নিয়ে গবেষণা করবে তখন সে আশ্চর্য না হয়ে পারবে না। কেননা রমযানের পর লোকজন ইবাদতে অলসতা বরং ইবাদত থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে। মনে হয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে- ইবাদত, তওবা ও সকল নেক আমল শুধুমাত্র মাহে রমযানের সাথেই সম্পৃক্ত। তারা এ কথা জানেনা যে, আল্লাহ তা‘আলা রমযানসহ সবকয়টি মাসের রব। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমযান হলো আনুগত্য ও ধৈর্যের অনুশীলন মাত্র। এ মাসে ঈমানি শক্তি সঞ্চয় করে বাকি এগার মাস চলতে হয়।
হ্যাঁ, তবে রমযান মাসে ইবাদতের বিশেষ গুরুত্ব আছে এবং রমযান অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু রমযান মাসই কেবল ইবাদতের জন্য নির্ধারিত নয়। আর এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময়ই দান-সদকা করতেন, তবে রমযানে তার দানের পরিমাণ অন্যান্য মাসের তুলনায় বেড়ে যেত। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে এই দুআ পাঠ করে আশ্রয় চেয়েছেন- আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি ধ্বংস ও অগ্নি থেকে…
পবিত্র কালামে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন: “তোমরা ঐ নারীর মত হয়ো না, যে সুতা দিয়ে মজবুতভাবে কাপড় তৈরি করার পর সুতাগুলো কাটতে শুরু করল। ” (সূরা নহল : ৯২)
অতএব, কল্যাণমূলক কাজগুলো কেবল রমজানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সব সময়ই আমাদের রবের ডাকে সাড়া দিতে হবে। এরশাদ হচ্ছে “মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত তুমি তোমার রবের ইবাদতে নিয়োজিত থাক” (সূরা হিজর : ৯৯)। অতএব, মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ ইবাদত ও নৈকট্য অর্জনের সমাপ্তি নেই।
ঈদে মানুষের বৈধ-অবৈধ পন্হায় আনন্দ-উল্লাস ও শরীয়তের সীমালঙঘনের প্রতি দৃষ্টি দিলে মনে হবে না যে, তারা তাদের রমযানের নেক আমলগুলো প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে ভয় করছে, অথবা যে ঈদের মাধ্যমে আল্লাহ তাদের সম্মান দান করেছেন তার ব্যাপারে তারা শুকরিয়া আদায় করছে। আর এ কারণেই তাদের অবস্হা ঐ নারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে যে সুতা বুনার পর তা কেটে ফেলে।
মানব প্রকৃতি হলো যদি সে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার সাথে ব্যস্ত থাকে তাহলে কখনো সে, আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, এমন কোন কাজে লিপ্ত হবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “নিশ্চয় যারা হেদায়েত স্পষ্ট হওয়ার পর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে শয়তান তাদের প্ররোচিত করে এবং আশা দেয়” (সূরা মুহাম্মদ : ২৫)।
আসলে যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যকে ভালোবাসত তাহলে চোখের এক পলকের জন্যও তা থেকে দূরে থাকত না। পূর্ব যুগে বলা হত : “যে ব্যক্তি ইয়ামানের রাস্তার আশেক, সে কখনো সিরিয়ার দিকে তাকাবে না। ”
শুনে রাখুন, কেউ অলস ও দুর্বল হয়ে গেলে কিন্তু সাধনা করতে পারবে না। আর যদি কেউ তারাবির নামাজ নিয়ে গর্ব করে, তাহলে নিজে নিজে শেষ হয়ে যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিজেকে ইবাদাত ও দৃঢ়তার উপর সংযত রাখা, কঠিনভাবে নিজেকে ইবাদতে আটকে রাখা।
হে মুসলিম ভাইগণ! রমযানে অনেক ইবাদত করেছি এ কথা ভেবে ধোঁকায় পড়া ঠিক হবে না। এই ধোঁকাই বাকী এগারো মাস ইবাদত বন্দেগী থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। কেননা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে চক্রান্তে ফেলে দেয়। যুদ্ধের ময়দানে এমন অনেক বীর পুরুষ ধোঁকায় পড়ে, ফলে সে এমন এক পরিস্হিতির শিকার হয়, যা সে কখনো কল্পনাও করেনি। যে ব্যক্তি আমল করে কিছদূর গিয়ে আবার অলস হয়ে স্হির হয়ে যায় সে ব্যক্তি কখনো শান্তি পায় না। কেননা প্রবাদ বাক্যে বলা হয়- যদি তুমি ক্লান্ত হতে না চাও তাহলে তুমি করতে থাক, যাতে তুমি ক্লান্ত না হও।
এক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার বাণী সবচেয়ে অর্থবহ, এরশাদ হচ্ছে “অতঃপর তুমি যখন ফারেগ হবে, তখন তুমি নামাজে দাড়িয়ে যাও” (সূরা ইনশিরাহ : ৭)।
নফসকে শাসন করার মূলমন্ত্র হলো আমলের প্রতি দৃঢ় সংকল্প করা। কেননা সংশয়ের কারণেই কাজ ধ্বংস হয়ে যায়। মুজাহাদা একটি আশ্চর্যজনক পদক্ষেপ। তাইতো দেখা যায় যারা নফসকে যা ইচ্ছা তা-ই করার জন্য ছেড়ে দেয়, নফস তাদেরকে অপছন্দনীয় কর্মকাণ্ডে ফেলে দেয়। আর যারা সর্বদা নফসের বিরোধিতা করে তাদের নফস কষ্ট পেলেও তারা সফল হয়ে যায়। আরবি কবি যথার্থই বলেছেনঃ “নফস হলো ছোট্ট শিশুর মত, তাকে ছেড়ে দিলে সে দুধ পান করার জন্য উদগ্রীব থাকে, আর তাকে দুধ পান করা থেকে ছাড়িয়ে ফেললে, ছেড়ে দেয়। ”
একথা সত্য যে দুনিয়ার জীবন কষ্ট-ক্লেশ থেকে কখনো পৃথক হয় না। জীবন চলার পথে অনেক মুসীবতের সম্মুখীন হতে হয়। মানব জীবনে সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো পরিণতি সম্পর্কে অনুভূতি না থাকা। বরং এর চেয়েও নিকৃষ্ট হলো পূর্ণমাত্রায় ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত হওয়ার পর ইবাদত কমিয়ে দিয়ে তার উপর সন্তুষ্ট থাকা, অথবা গুণাহ থেকে তওবা করে আবার গুণাহে ফিরে আসা। যার অবস্হা এমন সে কখনো ইবাদত করে কামিয়াব হতে পারে না। যদি কেউ মৌসুমী ইবাদতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে, তাহলে সে কঠিন শাস্তিতে নিমজ্জিত হবে, আর তা হলো ইবাদতের মজা ও আল্লাহর সাথে নিবির মুনাজাতের মিষ্টতা আস্বাদন করার সুযোগ না পাওয়া। মুমিন নারী ও পুরুষ যারা প্রতিটি মাসে রবের ইবাদত করে, প্রত্যেক মাসেই তাদের বাহির ও ভিতর সমান। তাদের শাওয়াল মাস রমযানের মতই।
অল্প আমল নিয়মিত করার মাঝে বরকত আছে। এটি আল্লাহ তা‘আলা খুব পছন্দ করেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “হে লোক সকল! তোমরা যতটুকু আমল নিয়মিত করতে পারবে তা-ই গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রতিদান দিতে বিরক্ত হন না, বরং তোমরাই বিরক্ত হয়ে যাও। নিশ্চয় আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল হলো যা নিয়মিত করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়। ”
তবে আমল নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার অর্থ আবার এই নয় যে, অবহেলা করে আমল ছেড়ে দেবে। বরং এর উদ্দেশ্য হলো মধ্যম পন্হা অবলম্বন করে আমল চালিয়ে যাওয়া। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বলেন : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন : “হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুক ব্যক্তির মত হয়ো না, যে রাত জেগে ইবাদতের অভ্যাস করে আবার তা ছেড়ে দিল। ”
আল্লাহ তাআলা মৃত্যু আসার পূর্ব পর্যন্ত নেক আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর নবীকে। এরশাদ হচ্ছে- “আর তুমি তোমার রবের ইবাদত কর, তোমার নিকট মৃত্যু আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত” (সূরা হিজর : ৯৯)। তাই আসুন আমরা সবাই আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হই। এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে অটল থাকার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমীন।