মুসলিম ভাইয়েরা! জাতির জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হওয়া জরুরি যখন আত্মার পরিশুদ্ধি ও তৃপ্তি সম্পন্ন হবে। যখন ঈমানের মাইলফলকগুলো নবায়ন করা হবে। যা কিছু নষ্ট হয়েছে তা সংস্কার করা হবে। যেসব রোগব্যাধি বাসা বেঁধেছে তা সারিয়ে তোলা হবে। রমযান সেই আধ্যাত্মিক মুহূর্ত যেখানে মুসলিম উম্মাহ তাদের বিভিন্ন অবস্থা সংস্কার করার সুযোগ পায়, তাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পায়। তাদের অতীতকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পায়। এটা আত্মিক ও চারিত্রিক বল ফিরিয়ে আনার একটি মাস। আর এ আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শক্তি ফিরিয়ে আনা প্রতিটি জাতিরই কর্তব্য। মুসলমানরা এ মৌসুমের অপেক্ষায় থাকে অধীর আগ্রহে। এটা ঈমান নবায়নের একটা বিদ্যাপীঠ। চরিত্র মাধুর্যম-িত করার সময়। আত্মাকে শানিত করার সময়। নাফসকে সংশোধন করার সময়। প্রবৃত্তিকে কন্ট্রোল করার সময়। কু প্রবৃত্তিকে দমন করার সময়। রমযানে অর্জন হয় তাকওয়া। রমযানে বাস্তবায়ন হয় আল্লাহর নির্দেশমালা। রমযানে অর্জিত হয় ঐক্য, মহব্বত, ভ্রাতৃত্ব, ও মিলমিলাব। এ মাসে মুসলমানরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়ার অনুভূতি অর্জন করে। অনুভব করে ক্ষুধার্তের ক্ষুধা। রমযান ত্যাগ, বদান্যতা ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার সময়। এটা সত্যিই চরিত্রের জন্য সহায়ক। রহমতের প্রগ্রবণ। যে ব্যক্তি সত্যি সত্যি রোযা রাখল তার রুহ পরিচ্ছন্ন হল। তার হৃদয় নরম হল। তার আত্মা পরিশুদ্ধ হল। তার অনুভূতিসমূহ ঠিকরে পড়ল ও শাণিত হল। তার আরচরণসমূহ বিনম্র হল।
আমরা কীভাবে রমযানকে স্বাগত জানাব?
প্রিয় ভাইয়েরা! আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে প্রথমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। সকল পাপ-গুনাহ থেকে তাওবার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। সকল প্রকার জুলুম অন্যায় থেকে বের হয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। যাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে তাদের কাছে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। ভাল কাজের মাধ্যমে রমযানের দিবস-রজনী যাপনের মানসিকতা নিয়ে রমযানকে স্বাগত জানাতে হবে। এ ধরনের আবেগ অনুভূতির মাধ্যমেই আশাসমূহ পূর্ণ হয়। ব্যক্তি ও সমাজ তাদের সম্মান ফিরে পায়। এর বিপরীতে রমযান যদি কেবলই একটি অন্ধ অনুকরণের বিষয় হয়। কেবলই কিছু সীমিত প্রভাবের নিষ্প্রাণ আচার পালনের নাম হয়। যদি এমন হয় যে রমযানে, পুণ্যের বদলে, পাপ ও বক্রতা বেড়ে যায়, তবে এটা হবে নিশ্চয়ই একটি আত্মিক পরাজয়, এটা নিশ্চয় শয়তানের ক্রীড়া, যার বিরূপ প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজের উপর পড়তে বাধ্য।
এই মহান মাসের আগমনে মুসলমানদের জীবনে আসুক সুখ ও সমৃদ্ধি। সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জীবনে এ মহান মৌসুমের আগমনে বয়ে যাক আনন্দের ফল্গুধারা। যারা আনুগত্যশীল, এ মাস তাদের নেক কাজ বাড়িয়ে দেওয়ার মাস। যারা পাপী, তাদের জন্য এ মাস পাপ থেকে ফিরে আসার মাস। মুমিন ব্যক্তি বেহেশতের দরজাসমূহের উন্মুক্তিতে খুশি না হয়ে পারে না? পাপী, দোযখের দরজাসমূহ এ মাসে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুশি হবে এটাই স্বাভাবিক। এ এক বিশাল সুযোগ যা থেকে মাহরুম ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কেউ বঞ্চিত হয় না। সিয়াম ও কিয়ামের মাস রমযানের আগমন মুসলমানদের জন্য বিরাট সুখের সংবাদ। অতঃপর হে আল্লাহর বান্দাগণ! আপনারা সিরিয়াস হোন, ঐকান্তিক হোন, রোযাকে কখনো কঠিন ভাববেন না। রোযার দিবসকে দীর্ঘ মনে করবেন না। রোযা ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকুন। আত্মিক ও বস্তুকেন্দ্রিক সকল প্রকার রোযাভঙ্গকারী বিষয় থেকে বিরত থাকুন।
রোযার হাকীকত
অনেক এমন রয়েছে যারা রোযার হাকীকত সম্পর্কে বেখবর। তারা রোযাকে কেবলই খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকার মধ্যে সীমিত করে দিয়েছে। তাদের রোযা মিথ্যাচারিতায় জিহ্বা লম্বা করতে বারণ করে না। চোখের ও কানের লাগাম তারা উন্মুক্ত করে দেয়। তারা গুনাহ ও পাপে নিপতিত হতে সামান্যও উৎকণ্ঠিত হয় না। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, সে অনুযায়ী কাজ এবং মূর্খতা পরিত্যাগ করল না, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।
কবি সত্যই বলেছেন:
রক্ষিত যদি না হয় কর্ণ.
দৃষ্টিতে না থাকে বাধা.
তবে বুঝে নিও
আমার রোযা কেবলই তৃষ্ণা ও পিপাসা।
যদি বলি আমি আজ রোযা,
মনে করিও আমি আদৌ রোযাদার নই।
রমযান প্রজন্ম গড়ার প্রতিষ্ঠান
রোযাদার ভাইয়েরা! মাহে রমযানে মুসলিম উম্মাহ ঐকান্তিকতার শিক্ষা নেয়, খেল-তামাশা থেকে বিমুক্ত হয়ে সিরিয়াসনেস অবলম্বনের শিক্ষা নেয়, জিহ্বায় লাগাম লাগানো, যা কিছু বললে পাপ হয় সেসব থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা নেয় এই মাহে রমযানে। হৃদয় পরিচ্ছন্ন রাখার, হিংসা, বিদ্বেষ, রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা নেয় রমযানের এই পবিত্র মাসে বিশেষ করে উলামা ও দাওয়াতকর্মীগণ। ফলে বিচ্ছিন্ন হৃদয়গুলো অভিন্ন সুতোয় নিজেদেরকে বেঁধে নেওয়ার সুযোগ পায়। বিচ্ছিন্ন মেহনত-প্রচেষ্টা একীভূত হয় গঠনমূলক কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে, কমন শত্রুকে মোকাবালা করার ক্ষেত্রে। রমযান মাসে আমাদের যুবকদের কাছে প্রত্যাশা, তারা তাদের ভূমিকা যথার্থরূপে পালন করবে। তারা তাদের মিশনকে ভালভাবে আয়ত্ত করবে। তারা তাদের রবের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবে। তারা তাদের সরকার প্রধানদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবে। মাতা-পিতা ও সমাজের অধিকার বিষয়ে সচেতন হবে।
রমযানে মুসলমানদের শাসক ও শাসিতের মাঝে যোগাযোগের একটি উপলক্ষ্য সৃষ্টি হয়। উলামা ও সাধারণ মানুষের মাঝে, ছোট ও বড়’র মাঝে সেতুবন্ধনের লক্ষণসমূহ দৃশ্যমান হয়। সবাই এক হাত হয়ে, এক শরীর হয়ে কাজ করার সুযোগ আসে, ফেতনা ফাসাদ দূর করার স্বার্থে, নির্যাতনে নিপতিত হওয়ার উপলক্ষ্যসমূহ দূরে ঠেলে দেওয়ার স্বার্থে, নৌকা যাতে ফুটো করা না হয়, বিল্ডিং যাতে ভেঙ্গে না পড়ে, সামাজিক ও চিন্তাগত অস্থিরতা যেন জায়গা করে নিতে না পারে সে উদ্দেশ্যে কাজ করে যাওয়ার স্বার্থে।
রমযানে ভাল কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়, হৃদয়ে ঝোঁক সৃষ্টি হয়। এটা দাওয়াতকর্মী ও সংস্কারকদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ। সৎকাজের নির্দেশদাতা ও অসৎ কাজ থেকে বারণকারীদের জন্য বিরাট সুযোগ, যারা অন্যদেরকে দীক্ষিত করে তুলতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে তাদের জন্য বিরাট সুযোগ যে তারা তাদের কল্যাণকর্মসমূহ এ মাসে উত্তমরূপে পালন করতে পারবে। কেননা সুযোগ দ্বারপ্রান্তে, মানুষের হৃদয়েও রয়েছে প্রস্তুতি।
অতঃপর আল্লাহকে ভয় করুন হে আল্লাহর বান্দারা! রমযানের হাকীকতকে জানুন। রমযানের আদব ও আহকামকে জানুন। রমযানের দিবস রজনীকে সৎ কাজ দিয়ে ভরে দিন। রমযানের রোযাসমূহকে ত্রুটি থেকে বাঁচান। তাওবা নবায়ন করুন। তাওবার শর্তসমূহ পূরণ করুন। আশা করা যায় আল্লাহ আপনার পাপসমূহ মার্জনা করে দেবেন। যাদেরকে তিনি তাঁর রহমত ও করুণায় ভূষিত করবেন, দোযখ থেকে মুক্তি দেবেন আপনাকে তাদের মধ্যে শামিল করে নেবেন।
মাহে রমযানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাধিক বদান্য ব্যক্তি ছিলেন। মাহে রমযানে তাঁর দানশীলতার মাত্রা আরো বেড়ে যেত বহুগুণে। ইবনুল কাইয়েম রাহ. বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ছিল পূর্ণাঙ্গতম আদর্শ, উদ্দেশ্য সাধনে সর্বোত্তম আদর্শ। মানুষের পক্ষে পালনযোগ্য সহজতর আদর্শ। আর রমযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সে আদর্শ ছিল: সকল প্রকার ইবাদত বাড়িয়ে দেয়া। এ মাসে জিবরীল ফেরেশতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কুরআন পঠন প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে দান-খয়রাত বাড়িয়ে দিতেন। কুরআন তিলাওয়াত বাড়িয়ে দিতেন। নামাজ ও যিকির বাড়িয়ে দিতেন। এ মাসে তিনি ইতিকাফ করতেন এবং এমন ইবাদতে এ মাসকে বিশেষিত করতেন যা অন্য কোনো মাসে করতেন না।
সালাফে সালেহীনগণও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদর্শ অনুসরণে সচেষ্ট হয়েছেন। তারা উত্তমরূপে রোযা পালনের ক্ষেত্রে সুন্দরতম আদর্শ স্থাপন করেছেন। তারা রোযার উদ্দেশ্য হাকীকতকে ভালভাবে আয়ত্তে এনেছেন এবং মাহে রমযানের দিবস-রজনীকে আমলে সালেহ দিয়ে ভরে রেখেছেন।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!
আপনারা যেভাবে এ মাসটিকে স্বাগত জানিয়েছেন একইরূপে আপনারা তাকে অচিরেই বিদায় দেবেন। আমরা এ মাসকে স্বাগত জানিয়েছি তবে জানি না পুরো মাস রোযা রাখার ভাগ্য আমাদের সবার হবে কি-না। আমরা তো প্রতিদিন বহু মানুষের জানাযা পড়ছি, যাদের সাথে আমরা অতীতে রোযা রেখেছি তাদের সবাই কি আমাদের মাঝে আছে?!
বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি যে রমযানকে আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসেবে নেয়। নিজের বক্রতাকে সোজা করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। মৃত্যু তাকে অতর্কিতে হামলা করার পূর্বেই নিজের নফসকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি বাধ্য করে। আর মৃত্যু যদি চলে আসে তবে সৎকাজ ব্যতীত অন্য কিছু কোনো কাজে আসবার নয়। অতঃপর এ মাসে আল্লাহর সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হোন। তাওবা করুন, লজ্জিত হোন, পাপ-গুনাহ থেকে ফিরে আসুন। নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ও গোটা মুসলিম উম্মার জন্য দুআ মুনাজাতে খুবই পরিশ্রমী হোন।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে মাহে রমযানের হক আদায় করার এবং এখলাছ ও মহব্বতের সহিত রোযা রাখার তৌফিক দান করুন। আমীন ॥