পূর্বে প্রকাশিতের পর
১০ পর্ব
মনে রাখা প্রয়োজন যে, যে ব্যক্তি যা নয় তাকে তা বলে আখ্যায়িত করা দ্বারা কোন ব্যক্তির সম্মান বাড়ানো যায় না। বরং কোন ব্যক্তি সম্পর্কে এরূপ অতিশয়োক্তি শুধু অন্যায়, অসঙ্গত এবং অপমানজনকই নয়-ধৃষ্টতারও পরিচায়ক।
আমি মনে করি যে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব এবং আল্লাহর প্রতিনিধি বলে ইসলাম মানুষের প্রকৃত মর্যাদা ও সম্মানকেই যথার্থ ও নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে এবং অন্য কোন কথায় এত সুন্দর ও সঠিকভাবে মানুষের আসল মর্যাদা ও পরিচয়কে তুলে ধরা সম্ভবই হতো না। স্থিরপ্রাজ্ঞ এবং চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই অন্তত এক্ষেত্রে আমার সাথে ঐকমত্যে উপনীত না হয়ে পারবেন না বলই আমার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
বিভ্রান্তি, মিথ্যাচার এবং স্বার্থের কলুষ আবহমান কাল ধরে মানুষে-মানুষে ভেদ-বৈষম্যের যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলছিল তার চির অবসান ঘটাতে ইসলাম সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যে কথা ঘোষণা করেছে তার সারমর্ম হলোঃ
* এক জোড়া মানুষ থেকে বিশ্বের সকল মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে, সকল মানুষের সৃষ্টির মূলেও রয়েছে এক-ই উপাদান এবং মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য-ও মাত্র একটিই; সুতরাং জন্মগতভাবে বিশ্বের সকল মানুষ সমান এবং পরস্পর ভ্রাতৃসদৃশ। আল কুরআন
* এক মানুষের উপর অন্য মানুষের এবং এক সমপ্রদায়ের উপর অন্য সমপ্রদায়ের প্রভূত্ব প্রাধান্যকে চুরমার করে দিয়েছে ইসলাম দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট কন্ঠ ঘোষণা করেছেঃ
অনারবদের উপর আরবদের অথবা আরবদের উপর অনরবদের কোন প্রাধান্য নেই। কেননা সকল মানুষকে একই পিতা অর্থাৎ আদম (আৎ) থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। আল হাদীস
* আবহমান কাল ধরে রক্ত, বর্ণ, বংশ, গোত্র প্রভৃতিকে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক বলে প্রচার করত এক মানুষ অন্য মানুষের এবং একদল অন্য দলের উপর প্রভূত্ব ও শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে আসছিলো। শ্রেষ্ঠত্বের এই মিথ্যা দাবীকে নস্যাৎ করে দিয়ে ইসলাম কঠোর ভষায় ঘোষণা করেছে-রক্ত, বর্ণ, বংশ, গোত্র প্রভৃতির দাবীতে কেউ শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। আল্লাহর কাছে এর কোনটাই শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক নয়। আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ ও সম্মানের যোগ্য ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে বেশী ভয় করে এবং বেশী সৎ কার্যশীল। – আল কুরআন
আমার বক্তব্যকে তুলে ধরার জন্যে কয়েকটি মাত্র উদ্ধৃতিই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি গভীর আনন্দ ও উৎসাহের সাথে লক্ষ্য করেছিলাম যে রক্ত, বর্ণ, বংশ, গোত্র, ভাষা, ভৌগলিক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা প্রভৃতি ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও আবহমানকাল ধরে ইসলামকে মহান আদর্শের ভিত্তিতে বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার পথ নির্দেন দিয়ে এসেছে।
যেহেতু উদাহরণ ছাড়া কোন উপদেশ বা পথ-নির্দেশকে যথযথরূপে বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়, অতএব যুগে যুগে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে যখনই কোন সমস্যা জটিল ও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে তখনই সে সব দেশে নবী রাসুলদের আবির্ভাব ঘটেছে। তঁরা সেই সমস্যার আদর্শ ভিত্তিক সমাধান কি হতে পারে তার বাস্তব উদাহরণ স্থাপন করেছেন।
পরিশেষে পৃথিবীর সকল দেশের, সকল যুগেরসকল মানুষের যাবতীয় সমস্যার নির্ভুল, নির্ভুলযোগ্য, পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাঙ্গ-সুন্দর সমাধান নিয়ে এলেন পৃথিবীর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহানপুরুষ হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম।
এই বিশ্ব নিখিলে মানুষের প্রকৃত মর্যাদা কি, কিভাবে মানুষ সেই মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে এবং রক্ত, বর্ণ বংশ গোত্র প্রভৃতির মিথ্যা ও কৃত্রিম দাবীতে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ও পরস্পর শুক্রভাবাপন্ন হয়ে যাওয়া মানুষদের একটি আদর্শের ভিত্তিতে কিবাবে ‘এক দেহ’ ও ‘সীসা-ঢালা প্রাচীর সদশ করে গড়ে তোলা যায়, বিশ্ববাসীর কছে তার বস্তব উদাহরণ তিনি সার্থকভাবে তুলে ধরে ছিলেন।
শত্রু-মিত্র নির্বিমেষে যিনিই আরবের তদানীন্তন ইতিহাস এবং বিশ্বনবী (সাঃ) কর্ম-তৎপরতার সম্পকে কিছু পড়াশুনা করে ছেন তিনিই মুগ্ধ-বিমোহিত হয়েছেন। আমিও মুগ্ধ-বিমোহিত না হয়ে পারিনি এবং পারিনি বলেই আমাকে ইসলাম গ্রহণ করেত হয়েছে।
এখানে প্রসঙ্গের ইতি টানতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু তা করা হলে আমার আসল বক্তব্যই না বলা থেকে যাবে। তাই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ন্যায় ও কর্তব্যের তাড়নায় সর্বোপরি বুকের জ্বালা নিবারণের জন্যে আমাকে বলতে হচ্ছে যে, পরবর্তী সময়ের অজ্ঞতা, স্বার্থের কোন্দল, ভুল, বুঝাবুঝি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুমন্ডুকতা এবং অতি তুচ্ছ এবং অতি নগণ্য বিষয় নিয়ে মতভেদ ও কাদা ছোটাছুড়ির ফলে মুসলমানেরা আজ সহস্রধা বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং ঘোরতর শত্রু ভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে্। ‘বিশ্বেরর সকল মুসলমান একটি দেহ সদৃশ’ এটা আজ বক্তৃতা ও মজলিস গরম করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে; বাস্তবে কুত্রাপি তার সামান্যতম পরিচয়ও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁর পবিত্র জীবনের অক্লান্ত সাধনায় মুসলমানদেরকে দিয়ে “সীসা গলানো প্রাচীর সদৃশ’ নিচ্ছিদ্র, দুর্ভেদ্য ও মহাশক্তিশালী যে জামায় গড়ে গিয়েছিলেন মুসরমানেরা আজ তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।
অবশ্য মুসলমানদের এই অবস্থার জন্যে তাদের দুঃখজনক পরাধীনতা এবং দেশী-বিদেশী শত্রুদের শঠতা-ষড়যন্ত্রও শিকারে পরিণত হয়ে থাকবে আর এত মার খেয়েও তাদের সন্বিৎ ফিরে আসবে না, সেটাই বা কি করে সমর্থনযোগ্য হতে পারে?
মনে রাখা প্রয়োজন যে, সাধারণ মানুষেরা ইতিহাস গড়ে না, ধর্মশাস্ত্র নিয়েও ঘাটাঘাটি করে না-চোখে যা দেখে তাকেই সত্য বলে গ্রহণ করে। তাই মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান হানাফী-মুহাম্মদী ভেদাভেদ, শিয়া-সুন্নীর ঝগড়া, ওহাবী-অওহাবী সংঘর্ষ, খারেজী-মুতাজিলা সংগ্রাম প্রভৃতি কাণ্ডকারখানা স্বচক্ষে দর্শন করত অন্য ধর্মের মানুষ বিশেষ করে হিন্দু সমাজ বিশ্বাস করে যে, তাদের মতো মুসলমানদের মধ্যেও জাতিভেদ প্রথা এবং তার বিষ-ময়তা বিদ্যমান রয়েছে।
অনুরূপভাবে তরীকা-পন্থী অসংখ্যা পীরের অসংখ্য দল এবং ভক্ত-অনুরক্তগণ কর্তৃক পীর ও মাজারপূজার কাণ্ডকারখানা দেখে এটা বুঝতে তাদের মোটেই বিলম্ব হয় না মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান গুরুগিরির ব্যবসাটা তুলনামূলকভাবে হিন্দুদের চেয়ে সমধিক উৎকট এবং সমধিক জমজমাট।
এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে একটি মাত্র তিক্ত ঘটনার উল্লেখ করত প্রসঙ্গাকান্তরে যেতে চাই। ঘটনাটি হলোঃ একদিন কার্যোপলক্ষ্যে গাইবান্ধার জনৈক প্রখ্যাত হিন্দু উকিলের বাসায় আমাকে যেতে হয়েছিল। মক্কেলের ভীড়; তাই ঘরের এক কোণায় চুপচাপ বসেছিলাম। দু-তিনজন বাদে বাকি মক্কেলরা সবাই ছিল মুসলমান।
একটি মামলার আর্জি লেখা হচ্ছিল। মামলাকারী একজন হানাফী মুসলমান। জনৈক মুহাম্মদী (তার ভাষায় রফাদানী) মুসলমানের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ। অভিযোগের বিবরণে প্রকাশঃ স্থানীয় কোন এক হাটের মসজিদে নামাযের সময়ে মুসল্লীরা ওজু করছিলো। সবাই আগন্তুক; অধিকাংশই অপরিচিত। ওজুকারী ব্যক্তিদের মধ্যে হানাফী, মুহাম্মদী, উভয় সমপ্রদায়ের মানুষই ছিলো।
ওজুর এক পর্যায়ে আসামী বাদীর খুঁৎ ধরে এবং ওজুর মছলা নিয়ে তর্ক শুরু করে। তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আসামী হঠাৎ উত্তেজিত হয় এবং নিজের হস্তস্থিত বদনাটিকে সজোরে বাদীর দিকে নিক্ষেপ করে। ফলে বদনা নাকে লেগে বাদী জখম হয় এবং রক্তপাত ঘটে। সাথে সাথে হানাফী-মুহাম্মদী ভেদে মুসল্লীরা দু-ভাগ হয়ে পড়ে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে কিল-ঘুষি চালাতে শুরু করে দেয়। হাটের ইজারাদার এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপের ফলে তখনকার মতো অবস্থা আয়ত্তে আসে। এখন দেখা দিয়েছে শ্রেণীগত মান-সম্মানের প্রশ্ন; এক পক্ষ অন্য পক্ষকে জব্দ করার জন্যে বদ্ধপরিকর। ব্যক্তির প্রশ্ন এখানে গৌণ, মাজহাবের ইজ্জত রক্ষাই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
উকিল বাবু বেশ রসিক মানুষ। তাই তিনি এই মাজহাবী ঝগড়ার কথা শুনছিলেন এবং রসিয়ে রসিয়ে প্রশ্ন করছিলেন।
হঠাৎ আমি এ নিয়ে আপনার কাছে আসিনি। আপনার প্রতিবেশী উকিল সিরাজ উদ্দিন সাহেব একটি বিশেষ পরামর্শের জন্যে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
উকিল বাবু: সেকথা আমি জানি । সিরাজের সাথে আমার কথা হয়েছে। মক্কেলের ভীড়ের মধ্যে সেকথা হবে না, অপেক্ষা করতে হবে। আর অপেক্ষা যখন করতেই হবে, তখনই একটু ধর্মালোচনা করতে দোষ কি? মুসলমানদের মধ্যেও যে জাতিভেদ প্রথা বিদ্যমান সেটা কি আপনি অস্বীকার করতে পারেন?
আমি: এ নিয়ে আমর স্বীকার অস্বীকারের মূল্য কতটুকু? আপনি নিজে ইসলাম সম্পর্কে জানুন এবং মুসলমানদের ইতিহাস পড়ুন, তাহলেই ইসলাম জাতিভেদ প্রথাকে কিভাবে রদ করেছে তা বুঝতে পারবেন। আর সাথে সাথে এ কথাও বুঝতে পারবেন যে, আমি এবং আমার মতো হাজার হাজার মানুষ কেন ইসলাম গ্রহণ করছে।
উকিল বাবু: ওসব পড়া এবং জানার সময় কই? আর তার প্রয়োজনই বা কি? চোখের সম্মুখেই তো সব দেখতে পাচ্ছি। আপনি কি বলতে পারেন, এই যে হানাফী-মুহাম্মদী, শিয়া-সুন্নী, মালেকী-হাম্বলীর বিভেদ আর ঝগড়া এটা জাতিভেদ প্রথা নয়? ওরা কি কখনো এক হতে পারবে? না এক হওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব?
আমি: আমি নিশ্চিতরূপেই বলতে পারি যে, এটা জাতিভেদ নয় এবং এই বিভেদ ইসলাম সমর্থিতও নয়, আর এই বিভেদের কারণও ভিন্ন।
উকিল বাবু: প্রসিদ্ধ ইমাম সাহেবরা এই বিভেদ করে দিয়ে গেলেন আর আপনি বলেন এই বিভেদ ইসলাম সমর্থিত নয়? আশ্চর্য! দেখুন মওলানা সাহেব! আর যাই করুনঃ ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে’ আপনি পারেন না।
আমি: চোখ থাকলেও দেখাটা টিক হচ্ছে না। মুসলমানদের এই বিভেদকে কোনক্রমেই জাতিভেদ বলা যেতে পারে না। বড়জোর সামপ্রদায়িক বিভেদ বলা যেতে পারে।
উকিল বাবু: এটা আপনার মনগড়া কথা। নাম যাই দেয়া হোক আসলে এটা জাতিভেদ ছাড়া আর কিছুই নয়। জিজ্ঞাসা করি আপনার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টা কেন?
দুঃখের বিষয় উপস্থিত মক্কেলবৃন্দও বাবুকে সমর্থন করে বলে উঠলো “মাওলানা সাহেব, আপনি চুপ করুন, বাবুতো ঠিকই বলছেন। জন্মের পর থেকেই হানাফী আর রফাদানীর (দুই হাত উঠনো) বিরোধ দেখে আসছি। কোন দিনই এদের মিল হবে না- হতে পারে না। ” এ সময়ে বাবুও সায় দিয়ে বলে উঠলেন-বুঝাও তোমাদের মাওলানা সাহেবকে একটু ভাল করে বুঝাও যে, কোন দিনই ওদের মিল হবে না। আর মাওলানা সাহেবও যেন গোঁজামিল দিয়ে আমাদের ইসলাম বুঝাতে না আসেন। ”
ঘটনাটি ইংরেজ আমলের, বাবুদের তখন প্রবল প্রতাপ। সামপ্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি মিথ্যা অজুহাতে আমাকে নাজেহাল করতে তাদের বিবেকে মোটেই বাধবে না। তাই মাথা হেঁট করে চলে এসেছিলাম। আর সেই দিন, বুকে যে ব্যথা পেয়েছলাম আজও তার জের কাটিয়ে উঠতে পারিনি, হয়তো সারা জীবনেও পারবো না। (চলবে)
১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ৮ম পর্ব ৯ম পর্ব