১১ম পর্ব
একটি হাদীসে আছে, “নিজের ত্রুটিকে উপেক্ষা করে অন্যের ত্রুটি খুঁজে বেড়ানোর মতো খারাপ কিছু আর নেই।” মহা নবীর এই বাণীটি স্মরণে থাকার পরেও অনেকেই কিন্তু এই খারাপ বিষয়টির চর্চা করে থাকে। একথা অনস্বীকার্য যে, মহাপুরুষ ছাড়া কোন মানুষই ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নয়। ফলে আরেক জনের ভুল-ত্রুটি খুঁজে বেড়ানোটা আত্ম-প্রবঞ্চনার শামিল। বিশেষ করে এই প্রবণতাটি যদি স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে দেখা দেয়, তাহলে পারিবারিক বিপর্যয় দেখা দেয়াটাই স্বাভাবিক। তাই পারস্পরিক ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি খুঁজে না বেড়িয়ে বরং ভালো গুণগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিন এবং সেগুলোর জন্যে প্রশংসা করুন। তবেই আপনার সংসার জীবন হয়ে উঠতে পারে সত্যিই এক ‘সোনালী নীড়’। মনে রাখবেন দোষ-ত্রুটি খুঁজতে গেলেই শয়তান প্ররোচিত করবে। আর শয়তানের প্ররোচনা মনের ভেতরে জাগাবে সর্বনাশী চিন্তা-ভাবনা। তাই শয়তানের কুমন্ত্রণায় না পড়ে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করুন এবং পরস্পরের মতামত ও ভালো লাগা-মন্দ লাগার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। এই আহ্বান জানিয়ে শুরু করছি ‘সোনালী নীড়ের’ এবারের পর্বে।
ধরে নেয়া যাক, কোন কোন স্বামীর সত্যি-সত্যিই কিছু প্রাকৃতিক দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতাগুলোকে স্ত্রীদের কেউ কেউ অনেক সময় ত্রুটি হিসেবেই ধরে নেয়ার চেষ্টা করে থাকেন-এটা ঠিক নয়, বরং যেসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা বা সারিয়ে তোলা সম্ভব, সেগুলো থেকে মুক্তি লাভের জন্যে স্ত্রীদের উচিত স্বামীকে সহযোগিতা করা। নাক ডাকার জন্যে কিংবা নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধের জন্যে যদি সংসার ভাঙ্গতে হয়, তাহলে এরচে আর দুঃখজনক ঘটনা কী হতে পারে? অথচ এগুলো মানুষের চিকিৎসাযোগ্য সাধারণ সমস্যা। এই স্বাভাবিক ব্যাপারগুলোকে বহু গৃহিনী অন্যের সাথে তুলনা করে প্রকাশ্যেই বলে বেড়ান আমার যদি এখানে বিয়ে না হতো তাহলে আজ আমাকে এই কষ্ট ভোগ করতে হতো না। কিন্তু এই কথাটি তারা ভাবতে ভুলে যান যে, তাদের স্বামীর যে ত্রুটিটি নেই, সেই ত্রুটিটি অন্য পুরুষটির মধ্যে রয়েছে? ফলে ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো বা অন্যের স্বামীর সাথে তুলনা করে মানসিক যন্ত্রণায় ভোগা খুবই দুঃখজনক। এই ধরণের প্রবণতা থেকে স্ত্রীদের দৃষ্টি চলে যায় ঘরের বাইরে। আপন ঘরকে তখন মনে হয় নরক, আর স্বপ্নিল দৃষ্টিতে দেখেন স্বর্গীয় সুখ। অথচ নদীর ওপারে যে স্বর্গসুখ নেই বরং তা-ই যে জ্বলন্ত নরক, তা ভুক্তভূগীরাই জানেন।
বিয়ের পরে স্বামীর ঘরই হলো স্ত্রীর জন্যে বেহেশত। এই বেহেশতে বসে অন্যদের নিয়ে ভাবলে কিংবা তাদের সাথে আপন স্বামীকে মেলানোর চেষ্টা করলে বহু অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যাবে। তখন যদি স্ত্রীরা এভাবে ভাবতে থাকে-আহা! আমার বিয়েটা যদি অমুকের সাথে হতো, তাহলে কতোই না ভালো হত! কিংবা কী চেয়েছিলাম, আর কী পেলাম! ইত্যাদি। তাহলে আপনাদের মনে অজান্তেই দেখবেন স্বামীর সাথে একটা মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর স্বামী যদি কোনভাবে ঐ দূরত্বের কারণ টের পান, তাহলে আপনাদের স্বামীরাও আপনাদের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এমনকী দ্বিতীয় বিয়ে করার কথাও ভাবতে পারেন।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই কর্মজীবনে বিচিত্র পেশায় নিয়োজিত। সব পেশাই কিন্তু সবার কাছে সমানভাবে পছন্দনীয় নয়। জীবিকার তাড়নায় তাই অপছন্দনীয় হলেও কোন না কোন পেশায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই হয়। পেশা এমন কোন ব্যাপার নয় যে, হুট করেই গায়ের জামা-কাপড়ের মতো পরিবর্তন করে ফেলা যায়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোতে তো পেশা বা চাকুরী প্রাপ্তি সোনার হরিণের মতো দুর্লভ। সেক্ষেত্রে তো পছন্দের প্রশ্নটিই অবান্তর। এ রকম ক্ষেত্রে কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর পেশাগত ব্যাপারে অপছন্দের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে, তখন স্বামী পুরুষটির কী অবস্থা দাঁড়ায় একবার ভাবুন তো! স্বামী যদি চাকুরী ছেড়ে দেয়, তাহলে সংসার অচল হয়ে যাবে। অন্যদিকে চাকুরীটি করলে স্ত্রীর বিষন্ন মুখ দেখতে হবে। তাহলে এর সমাধানটা কী হবে? হ্যাঁ এর একটাই সমাধান। তাহলো স্বামীর পেশার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। তবে স্ত্রীর পছন্দের পেশায় যদি যোগ দেয়ার সুযোগ থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। এ ক্ষেত্রে স্বামী তার ব্যক্তিত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে গ্রহণযোগ্য মনে করলে অবশ্যই স্ত্রীর পছন্দের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কিন্তু স্ত্রীর পছন্দের পেশায় যদি যাবার সুযোগ না থাকে, তাহলে স্ত্রীদের উচিত সহনশীল হওয়া, ধৈর্যশীল হওয়া, বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা। হুট করেই স্বামীর সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করা কিংবা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে চলা মোটেই উচিত নয়। মনে রাখতে হবে স্বামী যে পেশাতেই নিজের শ্রম দিচ্ছেন তা সংসারের জন্যেই।
তো পেশা পরিবর্তন যেহেতু সম্ভব নয়, সেহেতু বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়াই যুক্তিযুক্ত। এতএব স্বামীকে ভর্ৎসনা না করে বরং তাঁর সাথে সহযোগিতা করুন। তাঁর পরিশ্রমকে আন্তরিকভাবে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করুন। কাজ শেষে তিনি যখন বাসায় ফেরেন, তখন তাকে হাসিমুখে স্বাগত জানান। এ রকম আচরণের ফলে স্বামী, স্ত্রীর প্রতি অনেক বেশী অনুরক্ত হবেন। যার ফলে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষেই স্বামী, স্ত্রীর কাছে ছুটে আসতে চাইবেন। এরকম সম্পর্ক স্থাপিত হলে সংসার সত্যিকার অর্থেই সোনালী নীড়ে পরিণত হবে। আর বিপরীত আচরণের ফলে সংসারটি ভেঙ্গে যেতে পারে। কোন স্ত্রী নিশ্চয়ই তাঁর স্বপ্নের সংসারটিকে ভাঙ্গতে চান না। যদি কেউ এর ব্যতিক্রম চিন্তা করে থাকেন, তাহলে তা-ও নিশ্চয়ই সুখের আশায়! আর হ্যাঁ, একথা সর্বজনবিদিত সত্য যে, সংসার ভেঙ্গে কখনোই সুখ পাওয়া যায় না, বরং সংসার গড়েই সুখের একটা পরিবেশ তৈরী করা যেতে পারে। তাই সংসারের স্বার্থে, সুখের স্বার্থে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার মধুর সম্পর্ককে অটুট রাখতে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন-এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ৮ম পর্ব ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব