পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করা

পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করা

মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় ভূষিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-ই সর্বপ্রথম বিভিন্ন দল-গোত্রে দ্বিধাবিভক্ত মানব জাতিকে সীমাহীন আন্তরিকতায় পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেন।

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করতে এবং কলুষিত সমাজকে সুশৃঙ্খল করতে এর অনুসরণ, অনুশীলন ও বাস্তব প্রয়োগ অনস্বীকার্য। ইসলাম পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুন্দর সম্পর্ক স্থাপনের নীতি উদ্ভাবন করেছে। এই ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্যনীতির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে মুসলিম উম্মাহ বা ইসলামী সমাজ। মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় ভূষিত রাসূলুল্লাহ (সা.)-ই সর্বপ্রথম বিভিন্ন দল-গোত্রে দ্বিধাবিভক্ত মানব জাতিকে সীমাহীন আন্তরিকতায় পরস্পর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেন।

 তিনি এ মর্মে ঘোষণা করেন: সৃষ্টিগতভাবে কারো প্রতি কারো প্রাধান্য নেই; দুনিয়ার সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। এই আদি পিতৃত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর সকলেই নিবিড় ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ। এই নিগূঢ় সত্যের দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: তোমরা আল্লাহর সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু, তিনিই তোমাদের হূদয়কে জুড়ে দিলেন, ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ ও অনুকম্পায় পরস্পর ভাই-ভাইয়ে পরিণত হলে। অথচ তোমরা অবস্থান করছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে সেখান থেকে মুক্তি দিলেন। (সূরা আলে ইমরান-১০৩)

ইসলাম সহযোগিতা ও সহানুভূতি বজায় রেখে শান্তি ও সৌহার্দ প্রতিষ্ঠায় সর্বতো প্রয়াসী। এই শান্তিপ্রতিষ্ঠার মিশনে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো ভ্রাতৃত্বনীতি। কেননা বিশ্বমানবকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারলে অশান্ত পৃথিবীতে এমনিতেই শান্তির সমীরণ প্রবাহিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক স্থাপিত ভ্রাতৃত্বনীতি অবলম্বনে প্রতিষ্ঠিত মদীনার সেই কল্যাণ রাষ্ট্রের বাস্তব নমুনা এর প্রকৃত প্রমাণ। যা সর্বত্র প্রশংসনীয়, সকলের জন্য অনুকরণীয়। যেখানে প্রতিটি মানুষ ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একে অন্যের দুঃখ নিবারণে সমভাবে সচেষ্ট হয়। স্বার্থপরতার মূলোতপাটন করে পারস্পরিক কল্যাণকামিতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। ইসলাম সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনকে যেহেতু প্রাধান্য দিয়ে থাকে সেহেতু সেই ভ্রাতৃত্ববোধ প্রথমই বিশ্বাসীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: নিশ্চয়ই বিশ্বাসীরা পরস্পর ভাই-ভাই; কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও। (সূরা হুজুরাত: ১০)

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন: তিনিই তো নিজের সাহায়তায় ও মুমিনদের মাধ্যমে তোমাকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং মুমিনদের অন্তর পরষ্পরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।  তুমি সারা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও এদের অন্তর জোড়া দিতে পারতে না। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তর জুড়ে দিয়েছেন। অবশ্যি তিনি বড়ই পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী। (সূরা আনফাল: ৬২/৬৩)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : পরস্পর হিংসা করো না, শত্রুতা করো না, লোভ করো না এবং একে অন্যের পেছনে লেগো না। তোমরা পরস্পর ভাই ভাই ও আল্লাহর বান্দাহ। (বুখারী ও মুসলিম)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: একজন মুমিন অপর মুমিনের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, তাকে শত্রুর হাতে তুলে দিবে না, যে তার মুমিন ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন।(বুখারী)

ইসলামের এই ভ্রাতৃত্ববোধ শুধুমাত্র বাহ্যিক একতা নয় বরং এটি বাইরে যেমন সকলকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে, তেমনি ভিতরেও সকলকে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ করে। এ ভ্রাতৃত্ববোধ সর্বব্যাপী বিস্তৃত, ব্যাপক ও সার্বজনীন। এ ঐক্য সংকল্প ও হৃদয়াবেগের ঐক্য, বিশ্বাস ও মানবতার ঐক্য, সীমাহীন ভালবাসা ও আত্মত্যাগের সামগ্রিক ঐক্য। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের এই নিবিড় ভালবাসাকে উপলব্ধিতে আনার জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: নিশ্চয় পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া প্রদর্শনে মুমিনরা একটি দেহের মতো। যখন দেহের কোন একটি অঙ্গ কষ্ট অনুভব করে, তখন তার জন্য সমগ্র দেহই নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকে। (মুসনাদে আহমাদ) ভ্রাতৃত্বের পরিস্ফুটন ঘটবে একে অন্যের প্রতি ভালবাসা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে, উতপীড়িতকে উতপীড়ন হতে রক্ষা করার মাধ্যমে, বিপদ আপদে সর্বদা আপন ভাইয়ের ন্যায়, সঙ্গ দেয়ার মাধ্যমে। পথভ্রষ্টকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা বা পরিচালিত করাও ভ্রাতৃত্বেরই লক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: তোমার ভাই অত্যাচারী হোক কিংবা অত্যাচারিত হোক তাকে সাহায্য কর। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, অত্যাচারিতকে কিভাবে সাহায্য করব তা আমরা জানি; কিন্তু অত্যাচারীকে কিভাবে সাহায্য করব? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: তাকে অত্যাচার হতে বিরত রাখবে। (বুখারী)

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মানবসমাজে একমাত্র ইসলামই ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করেছে। ইসলামের এই ভ্রাতৃত্ববোধ সকল মানুষকে মানবতার ভিত্তিতে একই কাতারে অন্তর্ভুক্ত করে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, উপহাস, পরশ্রীকাতরতা ও সংকীর্ণতার সমাধি রচনা করে এই ভ্রাতৃত্ববোধ মানুষকে গড়ে তোলে পরহিতৈষী, সহনশীল ও কল্যাণকামী। আজ আমরা আল্লাহর সৃষ্টির সেরা মর্যাদা লাভ করেও মনুষ্যত্বের দাবিকে পদদলিত করতে দ্বিধা করি না। আমরা ভুলে গিয়েছি আল্লাহ প্রদত্ত ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শ। যে আদর্শ আমাদেরকে এক জাতিতে পরিণত করে কল্যাণ কামনা, সহানুভূতি, আত্মত্যাগ, সুবিচার, মার্জনা, নির্ভরতা, শ্রদ্ধাবোধ, দয়া ও উদারতার বৈশিষ্ট্যে সমুন্নত করে।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন: হে ঈমানদারগণ! পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রূপ করো না। এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর গোনাহর কাজে প্রসিদ্ধ লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার। যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম। হে ঈমানদাগণ! বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু। (সূরা হুজুরাত: ১১/১২)

রাসূলুল্লাহ (সা) এ সম্পর্কে বলেছেন: মুমিন মুমিনের ভাই, সে তাকে ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে রক্ষা করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তার স্বার্থ দেখে। (তিরমিযী)

কিন্তু দুঃখের বিষয় সামান্য তুচ্ছ ঘটনা বা অকারণে আজ আমরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছি। হানাহানি ও সহিংসতায় মেতে উঠছি, জাতিকে শতধাবিভক্ত করছি। এক কথায় সকল ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্ববোধের অনুপস্থিতির কারণে তা সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে ব্যক্তিগত ও জাতিগতভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ধীরে ধীরে আমরা এক অজানা গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। বর্তমান অশান্ত সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের কোন বিকল্প নেই। কেননা ইসলামই মানুষের জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে, একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে, যিনি সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, মৃত্যুর পর বিচারকর্তা। সমাজের প্রতিটি মানুষ যতদিন পর্যন্ত সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করবে ততদিন পর্যন্ত সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে না। ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগানো। মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে যদি তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ জাগানো না যায় তবে তাদের মধ্যে কোনদিন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। জাহেলী যুগে যখন সমাজে অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা চরমসীমায় পৌঁছেছিল তখন মহান আল্লাহ পৃথিবীর সকল মানুষকে ডেকে বলেছিলেন : তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান: ১০৩) এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলার রজ্জু বলতে কুরআন ও সুন্নাহ তথা আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান ইসলামকে বুঝানো হয়েছে এবং সেই ইসলামকে বাস্তব জীবনে কার্যকর করার মাধ্যমে সকল প্রকার গোমরাহী থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে ভাই ভাই হিসেবে চলার কথা বলা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্ববোধের গুরুত্ব কত অধিক পরিমাণে ইসলাম প্রদান করেছে।

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : লোকদের অধিকাংশ গোপন সলা-পরামর্শে কোন কল্যাণ থাকে না। তবে যদি কেউ গোপনে সাদ্কা ও দান-খয়রাতের উপদেশ দেয় অথবা কোন সতকাজের জন্য বা জনগণের পারস্পারিক বিষয়ের সংশোধন ও সংস্কার সাধনের উদ্দেশ্যে কাউকে কিছু বলে, তাহলে অবশ্য এটি ভালো কথা। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে কেউ এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তাকে আমি বিরাট পুরস্কার দান করবো। (সূরা নিসা: ১১৪) তাই আমাদের আবেগ অনুভূতি ও কামনা-বাসনাকে সংযত রাখতে হবে। লোভ-লালসা থেকে দূরে থেকে, স্থির মস্তিস্কে এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও যথার্থ পরিমিত বিচক্ষণতা ও ফায়সালা করার শক্তি সহকারে কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করে পারস্পরিক সম্পপ্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করার তাওফীক দান করুন। আমীন…

Related Post