চাকুরী জীবনঃ
‘বিশ্বনবী (সাঃ) এর বিশ্ব-সংস্কার’ নামীয় আমার লিখিত ও প্রকাশিত প্রথম বইখানা প্রায় নিঃশেষিত হয়ে আসছিল। অতএব অর্থাভাবের আশঙ্কা করছিলাম। কেননা, উক্ত বই বিক্রয়ের অর্থ দিয়েই কোনরূপে নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের কাজ চালিয়ে আসছিলাম।
প্রতিটি সভায় যথেষ্ট সংখ্যক বই বিক্রয় হতো। একদিকে সভা সমিতিতে বক্তৃতা-প্রদানের উপরে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অন্যদিকে বই নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া এই উভয়টিই ছিল আমার কাছে গভীর বেদনাদায়ক।
অবশ্য তখনো সরকারী নিষেধাজ্ঞা-জারী হয়নি। সভা সমিতির অনুষ্ঠান এবং বক্তৃতা প্রদান করা যেতে পারে এমন বহু স্থানই ছিল। কিন্তু যে কোনো সময়ে নিষেধাজ্ঞা জারী হতে পারে এমন আশঙ্কাও পুরোপুরিই বিদ্যমান ছিল।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সভা-সমিতির সংগঠকদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত বক্তা বা আলেমকে ‘রাহাখরচ’ ‘নজরানা’ ‘হাদিয়া’ ‘পারিশ্রমিক’ প্রভৃতি কোন না কোন নামে অর্থ প্রদান করার রেওয়াজ অন্তত এতদ্দেশ্যে প্রচলিত রয়েছে। অধিকাংশ বক্তা এবং আলেমই এই অর্থ গ্রহণ করে থাকেন।
অনেকে অনন্যোপায় হয়ে এ অর্থ নিতে বাধ্য হন। কেউ কেউ এটাকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। যিনি যেভাবেই এটা গ্রহণ করুন, তাঁদের সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না।
তবে আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি যে, এভাবে অর্থ গ্রহণ করা হলে বক্তৃতা বা ওয়াজের গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। সমাজে এমন মানুষ যথেষ্টই রয়েছে যারা প্রকাশ্যেই কঠোর ভাষায় এসব বক্তা, আলেম এবং পীরদের সমালোচনা করে থাকেন।
সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁরা এমন কথাও বলেন যে, ‘আলেমরা ওয়াজের ব্যবসা-খুলে বসেছেন, আসলে ইসলাম প্রচার ওদের উদ্দেশ্য নয়- উদ্দেশ্য হলো পেটপূজা। ’
সাধারণত স্থানীয়ভাবে চাঁদা সংগ্রহ করত এসব অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে। সঙ্গতি-সম্পন্ন ব্যক্তিদের নিকট থেকে চাঁদার বড় অংশটা পাওয়া যায়। দুঃখের বিষয় ওদের সকলের উপার্জন হালাল নয়।
ওদের উপার্জন যে হালাল নয় ওয়াজ বা বক্তৃতার মধ্যে সে কথা বলা হলে ওরা ভীষণভাবে রুষ্ট হবেন এবং চাঁদা দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। অতএব এই শ্রেণীর আলেম এবং বক্তাদের নিজেদের স্বার্থে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের উপার্জন যে হালাল নয় সে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হয়। অথবা পাশ কাটিয়ে যেতে হয়।
অন্যদিকে যেহেতু উক্তরূপ বক্তা ও আলেমগণ একদিকে ওদের অর্থ গ্রহণ করেন, আবার অন্যদিকে ওদের উপার্জন সম্পর্কেও চুপ থাকেন। অতএব ওদের উপার্জন যে হারাম বা অবৈধ নয় এমন একটা ধারণা ও উক্ত উপার্জনকারীদের মনে সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বক্তা এবং আলেমগণ কর্তৃক এভাবে অর্থ গ্রহণের পক্ষে এবং বিপক্ষে বহু যুক্তিই রয়েছে। এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। তবে এভাবে অর্থ গ্রহণ করা হলে বক্তৃতা এবং ওয়াজের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা যে বহুলাংশে হ্রাস পায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার পরে এমন একটা ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে রয়েছে।
সুতরাং সার্থকভাবে ইসলাম প্রচার করতে হলে জীবিকার জন্যে আমাকে যে এটা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হবে সেকথা আমি বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলাম। অন্য একটি সমস্যাও আমাকে একাজে উৎসাহিত করেছিল।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইতোমধ্যেই প্রায় ষাটজন অমুসলমান আমার কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। আমি লক্ষ্য করে আসছিলাম যে, এইভাবে ইসলাম প্রচার করে প্রকৃতপক্ষে আমি এক গুরুতর সমস্যারই সৃষ্টি করে চলেছি।
কেননা, স্বজন-হারা, নিঃসম্বল ও নিরাশ্রয় এ সব নও-মুসলিমদের একান্ত বাধ্য হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে হয়। পরের আশ্রয়গ্রহণ ও পরের গলগ্রহ হওয়া ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর থাকে না। ইসলাম গ্রহণের পরে ইসলামের সাথে পরিচিত হওয়ারও কোন সুযোগ তারা পায় না।
এসব কথা চিন্তা করত তাদের জন্যে সাময়িক আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার জন্যে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সংকল্প আমি গ্রহণ করি। নিজে মোটামুটি ভাবে স্বচ্ছল ও স্বাবলমস্বী না হয়ে কোন ব্যক্তির পক্ষে তেমন কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যে সম্ভব নয়, সেকথাও আমি বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলাম।
আমাদের দেশে এ ধরনের বহু সংগঠনের গোড়াপত্তন হতে দেখা যায়। আবার কিছুদিন পরে ওগুলোর অনেকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না তার কিছুটা আভাস আমার এই কথার মধ্যে রয়েছে।
‘নও মুসলিম তবলীগ জামাত’ এর প্রতিষ্ঠা এবং শোচনীয় পরিণাম থেকে এর বাস্তব শিক্ষাও আমি পেয়েছিলাম। কাজেই স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যে অতৎপর আমাকে যে সরকারী চাকুরী গ্রহণ করতে হয়েছিল যথাস্থানে সেকথা বলা হয়েছে।
১ম পর্ব ২য় পর্ব ৩য় পর্ব ৪র্থ পর্ব ৫ম পর্ব ৬ষ্ঠ পর্ব ৭ম পর্ব ৮ম পর্ব ৯ম পর্ব ১০ম পর্ব ১১ পর্ব