মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে কোরবানির সূত্রপাত। যুগে যুগে মানুষ তার প্রিয়জনের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হয়নি। এমনকি কল্পিত দেব-দেবীর সামনে জীবন দান করাকে নিজের জন্য সৌভাগ্য মনে করে থাকে। আর এটাই হচ্ছে কোরবানির উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আল্লাহ এভাবে জীবনদানকে পছন্দ করেন না। জীবনদানকে আল্লাহ তাঁর নিজের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি ছাড়া অন্য কারও জন্য জীবন উত্সর্গ করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তোমার রবের উদ্দেশে সালাত আদায় কর ও কোরবানি কর।’ (সূরা কাউসার : ২)
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম (আ.)-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি [কোরআনে বলা হয়েছে ‘এবং তাদেরকে আদম (আ.)-এর দুই ছেলের কাহিনী সঠিকভাবে শুনিয়ে দাও। যখন তারা দু’জনে কোরবানি করল, একজনের কোরবানি কবুল হলো, অপরজনের হলো না।’ (সূরা আল মায়েদা : ২৭)
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যত শরিয়ত নাজিল হয়েছে সেসবের মধ্যে কোরবানির হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের জন্য ইবাদতের এ ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য অংশ।
‘এবং আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওইসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদের দান করেছেন।’ (সূরা হজ্জ : ৩৪) অর্থাত্ কোরবারি প্রত্যেক শরিয়তের ইবাদতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরিয়তে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোরবারির নিয়ম-পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সব শরিয়তে এ বিধান ছিল যে পশু কোরবানি শুধু আল্লাহর জন্যই করতে হবে এবং করতে হবে তাঁর নাম নিয়েই।
কোরবানি হজরত ইসমাইল (আ.)-এর ফিদিয়া
আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কোরবানি করে তা প্রকৃতপক্ষে হজরত ইসমাইল (আ.)-এর ফিদিয়া। আল্লাহ বলেন, ‘যখন সে (ইসমাইল) তার সঙ্গে চলাফেরার বয়সে পৌঁছল তখন একদিন ইব্রাহিম (আ.) তাকে বললেন, প্রিয় পুত্র! স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে যেন জবেহ করছি। বল দেখি কী করা যায়? পুত্র বলল, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শিগগির করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল দেখতে পাবেন। অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে নিজেরদের আল্লাহর কাছে সোপর্দ করলেন এবং পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন জবেহ করার জন্য, তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো। আমরা সত্কর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এক সুস্পষ্ট অগ্নিপরীক্ষা। আর অমরা বিরাট কোরবানি ফিদিয়াস্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাইলকে) উদ্ধার করেছি। আর অমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইব্রাহিমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইব্রাহিমের ওপর, এভাবে জীবন দানকারীদের আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল। (সূরা আস সাফ্ফাত : ১০২-১১১)
কোরবানি প্রকৃতপক্ষে ত্যাগ ও ভালোবাসার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর দেয়া এবং তাঁর পথেই তা উত্সর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইঙ্গিত হলেই বান্দা তার রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ অনুভূতির সঙ্গে আল্লাহর পথে জীবন উত্সর্গ করার নামই ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।
কোরবানি ও জীবনদানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্য নবী (সা.)-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বল [হে মুহাম্মদ (সা.)] আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং সর্বপ্রথম আমি তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারী।’ (সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩)
আল্লাহর ওপর পাকাপোক্ত ঈমান এবং তাঁর তাওহিদের ওপর দৃঢ়বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সব চেষ্টা-চরিত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট হবে। আর সে ওই সবকিছুই তাঁর পথে কোরবান করে তার ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করব। কোরবানির আসল স্থান তো সেটা যেখানে প্রতি বছর লাখ লাখ হাজী তাদের নিজ নিজ কোরবানি পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ তাদেরও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজে শরিক হয়নি। কোরবানির আদেশ শুধু তাদের জন্য নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ করে, বরং এ এক সাধারণ নির্দেশ, এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্য। আর একথা হাদিস থেকে প্রমাণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (সা.) দশ বছর মদিনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কোরবানি করতে থাকেন। (তিরমিযি, মেশকাত)
নবী (সা.) বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছে না আসে। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)
হজরত আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) ঈদুল আজহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করেছে তাকে ফের কোরবানি করতে হবে। যে নামাজের পর করেছে তার কোরবানি পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
একথা ঠিক যে, ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। হজরত অবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলেন, নবী (সা.) ঈদগাহতেই কোরবানি করতেন।
কোরবানির ফজিলত
নবী (সা.) কোরবানির অনেক ফজিলত ও অসংখ্য সওয়াবের উল্লেখ করে বলেন— ১. নাহারের দিন অর্থাত্ জিলহজ মাসের দশ তারিখ কোরবানির রক্ত প্রবাহিত করা থেকে ভালো কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু, তার শিং, খুর ও পশমসহ হাজির হবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়। অতএব মনের আগ্রহসহ এবং সন্তুষ্টচিত্তে কোরবানি কর। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
২. সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এ কোরবানি কী বস্তু? নবী বললেন, এ তোমাদের পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! এতে আমাদের জন্য কী সওয়াব আছে? নবী বললেন, তার প্রত্যেকটি পশমের জন্য এক একটি সওয়াব পাওয়া যাবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
৩. হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন যে, নবী (সা.) হজরত ফাতেমা জোহরাকে (রা.) বললেন ফাতেমা! এসো তোমার কোরবানির পশুর কাছে দাঁড়িয়ে থাক, এজন্য যে তার যে রক্ত কণা মাটিতে পড়বে তার বদলায় আল্লাহ তোমার আগের গোনাহগুলো মাফ করে দেবেন। হজরত ফাতেমা (রা.) বললেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায়েতের জন্য নির্দিষ্ট না সব উম্মতের জন্য? নবী (সা.) বললেন, আমাদের আহলে বায়েতের জন্যও এবং সব উম্মতের জন্যও। (জামেউল ফাওয়ায়েদ)