হজের গুরুত্ব ও ফজিলত

mecca1_19253[1]

হজ একটি ফরজ ইবাদত। নামাজ, রোজা, জাকাত যেমন ফরজ ইবাদত, তেমনি সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য হজ একটি অন্যতম বরকতপূর্ণ অবধারিত কর্তব্য। হজ মুসলমানদের দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মান ও ইজ্জতের আসন দান করে, সৌভাগ্যের দরোজা খুলে দেয় প্রকৃত হাজীর জীবনে।

পবিত্র বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত শরিফের একটি হাদিসে আছে, আমাদের প্রিয়নবী হুজুর  সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যখন তুমি হাজীদের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন তুমি তাকে সালাম করবে, মুসাফাহা করবে এবং তার বাড়িতে প্রবেশের আগে তাকে তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুরোধ করবে। কেননা তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত।’

হজরত রাসূলে কারিম সা:-এর হাদিস থেকে একজন হাজী সাহেবের বড় ধরনের সামাজিক মর্যাদার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকৃত হাজীদের ব্যবসায়-বাণিজ্য, ওয়াজ-নসিহত, লেনদেন, কথাবার্তা মানুষ ভক্তির সাথে গ্রহণ করে। অবশ্য কোনো কোনো হাজী মানবীয় দুর্বলতা হতে মুক্ত হতে না পক্ষে রে হাজী সাহেবানদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় এমন কর্মকাণ্ডও করে বসেন। এ ধরনের হীনমন্যতা থেকে হাজীদের পবিত্র থাকতে হবে।

একইভাবে সত্যিকারের হাজীদের জন্য আখিরাতে রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কারের সুসংবাদ। নবীজী সা: ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি কামাচার ও অন্যায় কার্যাদি হতে বিরত থেকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার রেজামন্দির উদ্দেশ্যে হজ আদায় করে, সে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিক্ষাশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফেরে’ (বুখারি, মুসলিম)।হজরত রাসূলে মাকবুল সা: আরো বলেছেন,‘জান্নাতই হচ্ছে একমাত্র মাকবুল (বা গ্রহণযোগ্য) হজের পুরস্কার’(মিশকাত)।

মুমিন মুসলমানমাত্রই পবিত্র হজ ও উমরা পালনের মাধ্যমে পবিত্র খানায়ে কাবার জিয়ারত, পুণ্যভূমি আরবের বিভিন্ন বরকতময় স্থান পরিদর্শন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর পবিত্র মাজার শরিফ জড়িয়ে ধরে সালাম প্রদর্শনের জন্য পূত তামান্না পোষণ করেন। গরিব মুসলমানেরা আজীবন সে স্বপ্ন নিয়ে নামাজে-কালামে পরওয়ারদিগারের কাছে মোনাজাত করেন।

অনেক সামর্থ্যবান হাজী একবার ফরজ হজ সম্পাদন করা সত্ত্বেও পুনঃ পুনঃ হজ ও উমরা করেন,আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনে ও নবীপাক সা:-এর মুহাব্বতে। আসলে মুমিনদের মনমানসিকতা এমন হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এর ব্যতিক্রম স্বভাবের মানুষও নিতান্ত কম নয়। যাদের আল্লাহ অশেষ অনুগ্রহ করেছেন, দিয়েছেন ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা, ব্যবসায়-বাণিজ্য। এসবের পয়লা নম্বর দাবি হলো আল্লাহ পাকের ঘরের জিয়ারত। কিন্তু দেখা যায়, এ ধন-সম্পত্তিই যেন তার জন্য কাল হয়েছে। তার চাহিদা এবং ব্যস্ততা এত বেড়ে গেছে যে, হজে যাওয়ার তার সময়ই হয়ে ওঠে না।

আমার জানা মতে, এমন অনেক দুর্ভাগা ধনী রয়েছেন, যাদের আল্লাহ তায়ালা কোটি কোটি টাকা দেয়া সত্ত্বেও জীবনে হজ নসিব হয়নি; কেউ কেউ যথেষ্ট বয়স পাওয়া ও দুনিয়াদারি করার সুযোগ ভোগ করা সত্ত্বেও হজের সুযোগ গ্রহণ না করে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। শরিয়তের দৃষ্টিতে এ এক দুর্ভাগ্যের সংবাদ।

নবীজী হজরত রাসূলে কারীম সা: হাদিস শরিফে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর গৃহ (কাবাঘর) পর্যন্ত পৌঁছার উপযুক্ত ধনসম্পদ ও সাওয়ারির মালিক হওয়া সত্ত্বেও হজ আদায় করল না সে ইয়াহুদি হয়ে মরুক আর নাসারা হয়ে মরুক, তাতে আল্লাহর কিছু আসে যায় না’(তিরমিজি)।

ইসলামি শরিয়তে হজ ফরজ হওয়ার জন্য সাতটি পূর্বশর্ত রয়েছে। যেমন

(১) মুসলমান হওয়া

(২) জ্ঞানবান হওয়া

(৩) বালিগ হওয়া

(৪) আজাদ বা স্বাধীন হওয়া

(৫) আর্থিক দিক থেকে হজ পালনে সক্ষম হওয়া

(৬) হজ ফরজ হওয়ার ইলম থাকা (৭) হজের সময় হওয়া (শামী-২)।

একইভাবে হজ আদায় ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলি ৫টি

(১) শারীরিক সুস্থতা

(২) রাস্তাঘাট নিরাপদ হওয়া

(৩) কারাবন্দী না হওয়া

(৪) মহিলার ক্ষেত্রে স্বামী কিংবা অন্য কোনো (বিবাহ নিষিদ্ধ পুরুষ) ‘মাহরিম’ সাথে থাকা এবং

(৫) মহিলাদের ইদ্দত পালনের অবস্থা হতে মুক্ত হওয়া (প্রাগুক্ত)।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলদেশ থেকে প্রকাশিক্ষাত ফাতাওয়া ও মাসাইলের চতুর্থ খণ্ডের ১৪৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে : কোনো ব্যক্তির ওপর হজ ফরজ হয়েছিল কিন্তু বিনা ওজরে সে হজ আদায় করেনি। পরে গরিব এবং নিঃস্ব হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তার জিম্মায় হজ বাকি থেকে যাবে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হজ আদায় করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তার ওপর অপরিহার্য হবে।

উল্লেখ্য, জীবনে হজ একবারই ফরজ হয়। যে বছর হজ ফরজ হয় ওই বছরই তা আদায় করা ফরজ। শরিয়ত স্বীকৃত কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলে ওই বছরই আদায় করতে হবে। অকারণে বিলম্ব করা জায়েজ নয়। যদি পিতামাতা ব্যতীত ছোট শিক্ষাশুকে দেখার মতো কেউ না থাকে, তাহলে পিতামাতা এই কারণে হজ আদায়ে বিলম্ব করতে পারেন। শিক্ষাশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকুক বা খারাপ থাকুক উভয় অবস্থাতে এই হুকুম প্রযোজ্য হবে।

যদি কারো জিম্মায় হজ ফরজ অথচ তার পিতামাতা অসুস্থ অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে তার খিদমতের মুখাপক্ষে ক্ষী হয়ে পড়ে, তবে সে ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি ছাড়া সন্তানের হজে গমন করা মাকরুহ। আর যদি খিদমতের প্রয়োজন না থাকে, তাদের অনুমতি ছাড়া হজে গমন করতে কোনো দোষ নেই।

পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদীর ক্ষেত্রেও এ হুকুম প্রযোজ্য হবে। সুবাহানাল্লাহ। ইসলামি শরিয়ত ময়-মুরুব্বীদের সেবাযতেœ কত বেশিক্ষা গুরুত্বারোপ করেছে। শুধু পিতামাতা, দাদা-দাদীর সুখ-শান্তির কথা বিবেচনা করে বহু ইবাদত-বন্দেগি ইসলামি শরীয়তে সংক্ষিপ্ত করার বিধান রয়েছে। শরিয়ত নফল হজ আদায়ের ক্ষেত্রে মাতাপিতার অনুমতি ছাড়া সর্বাবস্থায় মাকরুহ সাব্যস্ত করেছে। রাস্তা নিরাপদ হোক বা না হোক এবং তাদের খিদমতের প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক সর্বাবস্থায় এ হুকুম প্রযোজ্য হবে।

উল্লেখ্য, যদি কারো স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং যাদের খোরপোষ তার দায়িত্বে রয়েছে, তারা যদি হজে যাওয়ার ব্যাপারে নারাজ থাকে এবং তাদের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা না থাকে, তবে হজে যাওয়াতে কোনো দোষ নেই। আর যাদের খোরপোষ তার দায়িত্ব নয়; এরূপ লোকেরা হজে যাওয়ার ব্যাপারে নারাজ থাকলে এবং হজে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা থাকলে এ অবস্থায়ও হজে যাওয়াতে কোনো দোষ নেই।

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে যদি এ পরিমাণ মাল থাকে যার দ্বারা সে ঋণ পরিশোধ করতে সামর্থ্য-এরূপ ব্যক্তি যদি ঋণ পরিশোধ না করে হজে যেতে চায়, তবে হজে যাওয়া তার জন্য মাকরুহ। কিন্তু ঋণদাতারা অনুমতি দিলে হজে যাওয়া জায়েজ হবে।

কেউ যদি কর্জের জামিন হয় এবং ঋণদাতা ব্যক্তির অনুমতিসাপক্ষে ক্ষ হয় তবে কর্জদাতা এবং জামিনদার ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া সে হজে যেতে পারবে না। আর যদি ঋণদাতা ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া কেউ জামিনদার হয় তবে কর্জদাতা, ঋণদাতার অনুমতি ছাড়া ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি হজে যেতে পারবে না। কিন্তু জামিনদারের অনুমতি অপরিহার্য নয় (আলমগিরী-১)।হজে যাওয়ার সময় উপরোক্ত মাসলা-মাসায়িলগুলো আমাদের গোচরীভূত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদের জীবনে হজে মাকবুল নসিব করুন।

Related Post