হজের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। হজ আদায়ের লক্ষ্যে বায়তুল্লাহ অভিমুখে হজযাত্রীদের পবিত্র সফরও আরম্ভ হয়েছে। যাদের আল্লাহতায়ালা হজ আদায় করার তাওফিক দিয়েছেন এবং হজে যাওয়ার নিয়ত করেছেন,তারা তো এ উপলক্ষে সার্বিক প্রস্তুতিও গ্রহণ করেছেন। হজযাত্রা মূলত একটি আধ্যাত্মিক সফর,আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যলাভ করাই এ সফরের মূল উদ্দেশ্য। এ সফর যেমন অনেক দূরত্বের, তেমনি অনেক কষ্টের। তাছাড়া হজের বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমসাধ্য ইবাদত, বড় ধরনের আর্থিক বয়ের পাশাপাশি অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এই ইবাদত পালন করতে হয়। তাই এই ইবাদত যেন সুচারুরূপে আদায় করা হয় এবং হজের আমলগুলো সুন্দর ও যথাযথভাবে পালন করা হয়। এ জন্য এ সম্পর্কিত দ্বিনি হেদায়াত ও সঠিক দিকনির্দেশনা জানা জরুরি। অনুরূপভাবে উত্তমভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করাও আবশ্যক।
হজের সফরের জন্য দুই ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। একটা যাহেরি বা বাহ্যিক প্রস্তুতি। অর্থাত্ বৈষয়িক বিষয়াদির প্রস্তুতি গ্রহণ। নানা প্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী সংগ্রহ করেন নিজ ঘর থেকে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার যাবতীয় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি বাতেনি ও রুহানি তথা অভ্যন্তরীণ ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি। যারা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করে, অনেক দূরত্বের পথ অতিক্রম করে, অনেক দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করে হজের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ সফরে যাবেন। তাদের জন্য রুহানি প্রস্তুতি গ্রহণ করা অধিকতর প্রয়োজন ও আবশ্যক। তাদের উচিত সফরের বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকে নিজেদের অন্তর ও হৃদয়কে আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি মনোযোগ দেয়া হজের মৌলিক গুণ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য লাভ করাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়া।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো হজ উপলক্ষে মানুষ বৈষয়িক প্রয়োজনগুলো পূরণ করার চিন্তা করে, শারীরিক চাহিদা ও দাবি মেটাতে এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশের কথা ভেবে, এমনকি রুচিসম্মত খাবারের জন্য নানা রকম আচার, চাটনি সঙ্গে নিয়ে যায়। ১০-২০ জোড়া জামা-কাপড় বানিয়ে নেয় এবং কয়েক মাস পূর্ব থেকে এসব বস্তু প্রস্তুত করার আয়োজন চলতে থাকে। অথচ হজের জন্য রুহানি বা আত্মিক প্রস্তুতির প্রয়োজনই বোধ করে না। ফলে অধিকাংশ হজযাত্রী যেভাবে যায়, সেভাবে ফিরে আসে। তাদের জীবনে হজের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। তাদের জীবনাচারে হজের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তাদের কাজকর্মে কোনো পরিবর্তন আনে না।
বৈষয়িক চাহিদা ও প্রয়োজনগুলোর ব্যবস্থা করা যদিও জায়েজ, প্রয়োজনীয় পরিমাণ তো আবশ্যক। কিন্তু এটা হজের প্রকৃত প্রস্তুতি নয়। হজের প্রকৃত প্রস্তুতি হলো হজের আহকাম ও মাসায়েল শিখে নেয়া, তার নিয়ম-পদ্ধতি ও আদব-কায়দা জেনে নেয়া এবং তার যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। নিজ দেশে থেকে গমন ও প্রত্যাগমন পর্যন্ত পুরো সফর, হজ জিয়ারতসহ সব আমল কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করা, স্বীয় হৃদয় ও অন্তরকে হজের বারাকত ও কল্যাণ ধারণের উপযোগী করে তোলা।
বিশেষ করে হজে যাওয়ার ব্যাপারে যাদের চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে গেছে। যাদের আবেদন গৃহীত হয়েছে, তাদের জন্য হজে যাওয়ার আগে হজের পরিপূর্ণ বিধান এবং নিয়ম-কানুন অবশ্যই শিক্ষা করা উচিত। হজের জন্য প্রতিটি ভাষায় অসংখ্য বই-কিতাব রয়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ওলামায়ের মাধ্যমে হজের প্রশিক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেগুলোতে অংশগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করা উচিত। হজের আবেদন গৃহীত হওয়া ও হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার মাঝে সাধারণত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান থাকে, হজের আদব-আহকাম শেখার জন্য এ সময়ই যথেষ্ট। অনেকে এদিকে মনোযোগ না দিয়ে হজে চলে যায় এবং এত বড় অংকের অর্থ ব্যয় করে কষ্ট সহ্য করে সঠিক পন্থায় হজ থেকে বঞ্চিত হয়। হজ করার নিয়ম-কানুন না শিখে হজে আদব-আহকাম না জেনে হজ করার অর্থ হলো নিজের শারীরিক পরিশ্রম ও কষ্ট ক্লেশ এবং টাকা-পয়সা নষ্ট করা।
হজের বিধান বাস্তবায়িত করার জন্য অতি আবশ্যক যে, হজ যাত্রীরা তাদের করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে অবহিত হবেন, হজের আমলগুলো একাগ্রতার সঙ্গে পালন করবেন। হজকে উন্নত ও সুন্দর করার আগ্রহ ও গুরুত্ববোধ প্রথমে অন্তরে সৃষ্টি করবেন। প্রভুর সান্নিধ্যে মনকে নিবিষ্ট করে রাখবেন। দুনিয়ার সবকিছু থেকে কিছু সময়ের জন্য আল্লাহর দরবারে নিবন্ধ রাখবেন। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা… নিজের উপস্থিতি, হজ, কোরবানি সবকিছুতে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা ও প্রার্থনা করবেন। হজের প্রাণশক্তি সৃষ্টি করার এবং প্রথাগত হজকে জীবন্ত হজে পরিণত করার এটাই সর্বোত্কৃষ্ট উপায়।
যদি ইখলাস বিশুদ্ধ নিয়ত ও সঠিক পদ্ধতিতে হজ পালন করা হয়, সেই হজ অবশ্যই মানুষের অন্তরে এক বিপ্লব সৃষ্টি করে। তার প্রভাব গোটা জীবনের ওপর পড়ে। তখন তার জীবনযাপন পদ্ধতি আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যময় হয়ে যায়। কারণ সেই হজের প্রভাবে তার অন্তরে নম্রতা, আল্লাহর সঙ্গে সুসম্পর্ক, খোদাভীতি এবং আখেরাতের চিন্তা-ভাবনা জাগ্রত হয়, হজলব্ধ চেতনা ও মনোবৃত্তি তাকে পাপ কাজ ও অন্যায় অপরাধ থেকে বিরত রাখে। তবে শর্ত হলো যদি তা শুভ, বাহ্যিক ও প্রথাগত না হয়ে বরং ভেতরে-বাইরে এবং আকার-আকৃতিতে ও প্রাণশক্তিতে শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় হয়, এ জন্যই সবকিছুর আগে হজের জন্য রুহানি প্রস্তুতি আবশ্যক। হজ যদি আমাদের জীবনে কোনো প্রভাব সৃষ্টি না করে, হজ-পরবর্তী জীবনে কোনো পরিবর্তন না আনে, তাহলে বুঝতে হবে তার কারণ একটাই, সেই হজের রুহ বা প্রাণশক্তি বিলীন হয়ে গেছে। কেননা যে ইবাদত শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও নৈকট্যলাভের উদ্দেশ্যে হয় এবং সঠিক পন্থায় আদায় করা হয়, কেবল তাতেই মানুষের আত্মিক সংশোধন ও মনের উত্কর্ষতা সাধিত হয়। রুহানি প্রস্তুতি কেন অপরিহার্য? শুধু হজ নয়, নামাজ, রোজা, জাকাতসহ প্রতিটি ইবাদতের রুহানিয়ত বা প্রাণশক্তি অপরিহার্য। রুহানিয়তমুক্ত ইবাদত অন্তঃসারশূন্য, অমূল্য ও গুরুত্বহীন হয়ে যায়, যা রুহানিয়ত যুক্ত ইবাদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান থাকে। কারণ আল্লাহর সঙ্গে মানুষের বিশেষ সম্পর্ক শুধু আত্মিক বা রুহানি দিক থেকে যেটাকে সহজ ভাষায় বলা হয় ‘তা আল্লুক মা’ আল্লাহ কলবের সঙ্গে।
সুতরাং যে হজের মাধ্যমে আমরা নিজেদের আত্মিক উন্নতি সাধন করব, আল্লাহতায়ালার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করব এবং তার বিশেষ সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহের অধিকারী হবো, তার জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করা অধিকতর আবশ্যক নয়? যে সামান্য কষ্ট স্বীকার করে, কিছু সময় ব্যয় করে হজের আহকাম ও নিয়ম-কানুন শিখতে অক্ষম তার জন্য এত শারীরিক পরিশ্রম ও আর্থিক ব্যয়ের মাধ্যমে হজের লৌকিকতার প্রয়োজন কী? আল্লাহতায়ালা আমাদের হেদায়াত নসিব করুন এবং সঠিক বুঝ দান করুন।