শ্রমজীবী ও পরিশ্রমী মানুষকে আল্লাহপাক ভালোবাসেন। এই পৃথিবীর সভ্যতার আসল কারিগর হলো পরিশ্রমী মানুষরাই। কষ্টের পর কষ্ট, যাতনার পর যাতনা সহ্য করেই এই পৃথিবীতে শ্রমিক শ্রেণীর খেটে খাওয়া মানুষগুলো কাজ করে যাচ্ছে। তাদের পুঁজি করে অনেকেই পৃথিবীতে ফায়দা লুটে যাচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের অধিকার পাচ্ছে না। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত শ্রেণী হলো শ্রমিকরা। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিদের হাতে চরমভাবে নিষ্পেতিত হচ্ছে আজকের শ্রমজীবী মানুষরাই। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের সব সমস্যার সার্বিক ও ন্যায়সম্মত সমাধানের দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
কোরআনের আলোকে
১. শক্তিমান ও বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিই শ্রমিক হিসেবে উত্তম
‘মেয়ে দুটোর একজন তার পিতাকে বলল, আব্বাজান! এ লোকটিকে চাকরিতে নিয়োগ করুন। সবচেয়ে ভালো লোক যাকে আপনি কর্মচারী হিসেবে রাখতে পারেন; সে এমনই হওয়া উচিত, যে সবল ও আমানতদার।’ (সূরা কস্ফাসাস : ২৬)
২. বিশ্বাস ভঙ্গকারী শ্রমিককে আল্লাহ ভালোবাসেন না
‘হে রাসুল) যারা নিজের সঙ্গেই প্রতারণা করে তাদের পক্ষে আপনি তর্ক করবেন না। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদের পছন্দ করেন না, যারা খিয়ানতকারী ও পাপী।’ (সূরা নিসা : ১০৭
৩. প্রত্যেক কাজ সম্পর্কেই আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন
‘আল্লাহর যদি এটাই ইচ্ছে হতো (যে তোমাদের মধ্যে কোনো রকম মতভেদ না হোক) তাহলে তোমাদের তিনি একই উম্মত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু যাকে ইচ্ছা তিনি গোমরাহ করেন, আর যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দেন। আর অবশ্যই তোমাদের সব আমল সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ (সূরা নাহল : ৯৩)
৪. শ্রমিকের ওপর কঠোরতা আরোপ না করা
‘তার পিতা (মুসাকে) বলল, আমার এ দু’মেয়ের একজনকে তোমার কাছে বিয়ে দিতে চাই এ শর্তে যে, তোমাকে আমার এখানে আট বছর চাকরি করতে হবে। আর যদি দশ বছর পুরা কর, তাহলে তা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমার সঙ্গে কড়াকড়ি করতে চাই না। ইনশাআল্লাহ, তুমি আমাকে সত্ লোক হিসেবেই পাবে।’ (সূরা কাসাস : ২৭)
শ্রমিক মালিক সম্পর্ক
শ্রমিকদের শোষণ ও নিপীড়নের ইতিহাস বেশ পুরনো। ইসলাম আবির্ভাবের আগে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ ছিল উপেক্ষিত ও অবহেলিত। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) শ্রমিকদের সামাজিকভাবে মর্যাদা দিয়ে এবং নিজে শ্রম দান করে কৃত্রিম আভিজাত্যবোধ ও সামাজিক বৈষম্যের ওপর চরম আঘাত হেনেছেন। অধিকারবঞ্চিত শ্রমিকরা মহানবীর (সা.) কারণেই নিজেদের সামাজিক মর্যাদা লাভ করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কোনো কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা বিন্দুমাত্র লজ্জার ব্যাপার নয়। নবীজি (সা.) বেকার ও ভিক্ষুকদের পছন্দ করতেন না। ভিক্ষালব্ধ খাদ্যকে অগ্নিদগ্ধ পাথর বলে অভিহিত করেছেন তিনি। শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যারা তোমাদের কাজ করছে, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন মাত্র।’
ইসলাম একজন শ্রমিককে যে মর্যাদা দিয়েছে, অন্য কোনো ধর্ম বা অর্থনীতিতে তা দেয়া হয়নি। কিন্তু বর্তমান গোটা বিশ্বে স্বার্থান্ধতার কারণে মালিক ও শ্রমিক শ্রেণী আজ পরস্পরবিরোধী দুটি শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। শ্রমিক ও মালিক যদি ইসলামী বিধান মেনে চলে তাহলে শ্রমবিরোধ বা অন্য কোনো সমস্যা উভয়ের মাঝে সৃষ্টি হতে পারে না। শ্রমিক-মালিকে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে ইসলামী রীতি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। পুঁজি এবং শ্রম কোনোটারই গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, পুঁজিবাদী বহুতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুঁজির জোগানদার শুধু নিজেকে উত্পাদন প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মনে করে। শ্রমিকের অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ ও মানবিক দিক তারা বিবেচনায় নিতে রাজি নন। পুঁজির পাহাড় স্ফীত করাটাই ওদের নেশা। শ্রমিকের বাঁচা-মরা তাদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো শ্রমিকের মুজরি এমন নির্ধারিত হওয়া উচিত যেন শ্রমিক তার পরিজন নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে। কিন্তু মুসলমানপ্রধান বাংলাদেশেও এর বিপরীত চিত্রই অধিক। মালিকপক্ষ বেশি বেশি শ্রম আদায়ে যত্নবান হলেও শ্রমিকের অধিকার, প্রাপ্য সম্পর্কে কেমন যেন উদাস। মহানবী (সা.) শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরি পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই এর বিপরীত চিত্র। মজুরি পরিশোধ নিয়ে অনেক সময়ই মালিক-শ্রমিকে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। মালিক যেমন শ্রমিকের প্রতি দায়িত্বশীল ও দয়াবান থাকবেন, তেমনি শ্রমিকও মালিকের প্রতি অনুগত থাকবেন—এটাই কাম্য। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা। খলিফা হিসেবে মানুষ যাতে যথার্থ মর্যাদার সঙ্গে পৃথিবীতে দিনাতিপাত করতে পারে, সেজন্য মানুষকে হেদায়েতনামা দেয়া হয়েছে। এ হেদায়েতের লক্ষ্য ছিল মানবজীবনকে সমৃদ্ধিশালী ও মর্যাদাশীল করে গড়ে তোলা; দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর এবং ক্লেশপূর্ণ লাঞ্ছিত জীবন ইসলামের কাম্য নয়। মহানবী (সা.) মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন এবং তাদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের অবসানের লক্ষ্য নিয়েই মদিনা রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন। এ রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছিল যাবতীয় মৌলিক চাহিদা পূরণ করে মানুষের সব দুঃখ-কষ্টের অপসারণ এবং মানব জীবনের গুণগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধন করা। বস্তুত এ উদ্দেশ্যে গৃহীত যে কোনো কর্মপ্রচেষ্টাকে মহানবী (সা.) সওয়াবের কাজ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই ব্যবস্থার ফলে বস্তুগত সম্পদের পূর্ণ ও দক্ষ ব্যবহার সম্ভব হয়েছিল। একই সঙ্গে মানব সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার ও যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানও সম্ভব হয়েছিল।
মহানবী (সা.) মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুবিচারের জন্য যে আদর্শ প্রচার করেছিলেন তার মূল কথা হচ্ছে—রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগিরক তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী অর্থোপার্জনের জন্য কাজ করবে। প্রত্যেক নাগরিকেরই কমবেশি কর্মদক্ষতা রয়েছে, আছে শ্রম নিয়োজিত করে পণ্য উত্পাদনের ক্ষমতা। ফসল উত্পাদনের জন্মগত যোগ্যতা ও প্রতিভা। এ ক্ষমতা ও যোগ্যতা আল্লাহরই দান। কাজেই আল্লাহর এ মহাদানকে অকর্মণ্য, নিষ্ক্রিয় ও অকেজো করে রাখার অধিকার কারও নেই। মহানবী (সা.) স্বীয় কর্মক্ষমতাকে পুরো মাত্রায় প্রয়োগ করে মানুষকে উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। বস্তুত মানুষের কর্মক্ষমতার প্রতি এ হলো ইনসাফের দাবি। মহানবী (সা.) কর্তৃক ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগেও ভিক্ষাবৃত্তি ছিল, তিনি তার অবসান ঘটিয়েছিলেন।
যারা পরের উত্পাদন প্রতিষ্ঠানে বা জমিতে শ্রম দেবে তারাও মানুষ। মানুষ হিসেবে উত্পাদন প্রতিষ্ঠান ও জমির মালিককে এবং সেখানকার শ্রমিক-মজুরের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কাজেই শ্রমিক-মজুরকে কোনোরূপ ঘৃণা করা, তাদের হীন জ্ঞান করা বা তাদের মানুষের মর্যাদা না দেয়া মনুষ্যত্বেরই চরম অবমাননা। একজন মানুষ শ্রমিক হতে পারে, তাই বলে তাকে নিছক যন্ত্র মনে করা, তাদের প্রতি ঠিক সেরূপ আচরণ করা, যেমন আচরণ করা হয় ইস্পাতনির্মিত যন্ত্রপাতি ও কলকব্জার সঙ্গে। মানুষের প্রতি তার চেয়ে বড় জুলুম ও বেইনসাফি আর কিছু হতে পারে না। এই বেইনসাফির অবসান ঘটিয়ে মহানবী (সা.) শ্রমিকদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মহানবী (সা.) হজরত মুসা (আ.) এবং অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কিরামের (আ.) জীবনযাত্রার কথা বলতে গিয়ে বলেন : হজরত দাউদ (আ.) কর্মকার ছিলেন, হজরত আদম (আ.) কৃষক ছিলেন, হজরত নূহ (আ.) সুতার, হজরত ইদ্রিস (আ.) দরজি আর হজরত মুসা (আ.) বকরি চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। (মুসতাদরাক হাকে) ইসলাম দাস-শ্রমিকদেরও মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকর প্রেরণা দিয়েছে।তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে। দাস-শ্রমিক বলতে প্রাক-ইসলাম যুগে যা বোঝাত, ইসলাম তার অর্থ বদলে দিয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ দাস-শ্রমিককে দাস বলে ডাকতে পারবে না। কারণ তোমরা সবাই গোলাম, একমাত্র আল্লাহই সবার রব বা প্রতিপালক। (আবু দাউদ)
উপসংহারের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, ইসলাম শ্রমিকদের যে অধিকার প্রদান করেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মই তা প্রদান করতে পারেনি। কেবল ইসলামই শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করেছে। সুতরাং আমাদের উচিত ইসলামের এই শ্রমবিধি সমাজে প্রতিষ্ঠা করে শান্তি বয়ে আনা।
(সমাপ্ত)