ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা। এ দ্বীনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবজাতির ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। এ শান্তি ও মুক্তির পথ লাভ করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি কিছু দায়দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। আর সে দায়দায়িত্বই হচ্ছে ইবদাত তথা আল্লাহর দাসত্ব। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মহান আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বজগতের মহান সৃষ্টা এবং প্রভু। তিনিই সমগ্র বিশ্বজাহানের নিয়ন্তা ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তিনি একক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো অংশীদার নেই এবং তাঁর জাতের সমকক্ষ কোনো সত্তাও নেই। তিনি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। আর এ বিশ্বজগতের মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে জিন জাতি ও মানব সম্প্রদায়। এ দু’টি সম্প্রদায়ের সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন : ‘আমি জিন ও মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা আজ জারিয়াহ : ৫৬)। এ উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাঁরা উভয় জাতিকে আল্লাহর ইবাদত করার কথা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক জাতির কাছে একজন পয়গম্বর পাঠিয়েছি। তাঁরা মানুষের কাছে এ পয়গাম পৌঁছিয়েছে যে, হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে (আল্লাহবিরোধী শক্তি) পরিহার করো। (সূরা আন নাহল : ৩৬)। যুগে যুগে আগত নবী-রাসূলগণও তাঁদের আগমনের উদ্দেশ্য স্মরণ রেখে স্বজাতির প্রতি এ আহ্বান করেছেন যে, অর্থা হে আমার জাতি আল্লাহর বন্দেগি করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই। (সূরা আ’রাফ : ৫৯)। শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:-কেও সে বার্তার কথা স্মরণ করে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : হে নবী! আপনার আগে আমি যেসব নবী-রাসূলগণকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছি, তাদের প্রতি আমি এ ওহিই নাজিল করেছিলাম যে, ‘আমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। অতএব তোমরা আমার ইবাদত করো।’ (সূরা আম্বিয়া : ২৫)। উল্লিখিত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর ইবাদত করাই মানুষ ও জিন জাতির কর্তব্য। বিশেষ করে মানব সম্প্রদায়ের জন্য গুরুদায়িত্ব। কেননা হেদায়াত ও মুক্তির পথ দেখানোর জন্য আল্লাহর প্রেরিত যেসব নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছিলেন, তাদের প্রত্যেকেই মানুষকে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহ্বান করেছেন। সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:ও এর ব্যতিক্রম করেননি বরং তিনি এ আহ্বানের পূর্ণতা দিয়েছেন। তাই আল্লাহর ইবাদত করা সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেণীর মানুষের অপরিহার্য দায়িত্ব। যেহেতু আল্লাহর দাসত্ব করাই মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য, তাই এ উদ্দেশ্য পূরণ করাই আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করার উপায়। একজন মানুষ মর্যাদার উচ্চশিখরে পৌঁছার অর্থই হলো, তিনি তার কাজকর্ম দ্বারা ইবাদাতের উচ্চস্তরে পৌঁছেছেন। তাই কুরআনে পাকে দেখতে পাওয়া যায়, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যখন তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ স্নেহ মমতা ও মানমর্যাদার সাথে স্মরণ করতে চান, তখন তিনি এ স্মরণের সময় ‘আবদুন’ (বান্দাহ) শব্দের বিশেষণ দ্বারা তাদের স্মরণ করে থাকেন।
যেমন আল্লাহর বাণী : তিনি কত মহান! যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন, যাতে করে তিনি (বান্দা) বিশ্বজগতের জন্য সতর্কবাণী হতে পারে। (সূরা ফুরকান : ০১)। এখানে নবী করিম সা:-কে আল্লাহ তায়ালা স্নেহ ও মর্যাদার সাথে ‘আব্দ’ তথা বান্দাহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এতে প্রতীয়মান হয় উবুদিয়াত তথা দাসত্বের গুণ অর্জনের মাধ্যমে মানুষ সম্মানিত হয়। তাই মানুষ আল্লাহর প্রয়োজনে নয়, বরং নিজের প্রয়োজনে আল্লাহর ইবাদত করে। কারণ মহামহিম আল্লাহ কারো ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। ইবাদত করলে আল্লাহর প্রভুত্ব অুণœ থাকবে, অন্যথায় থাকবে না তা নয়। বরং জন্মগত স্বভাবে আল্লাহর সব সৃষ্টি তাঁর ইবাদতে মশগুল থাকে। আল্লাহর বাণী : তারা কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে আনুগত্যের বিধান অšে¦ষণ করে? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর সবাই ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক তাঁরই নির্দেশের অধীনে অনুগত হয়ে আছে।’ (সূরা আলে ইমরান : ৮৩)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে : ‘এমন কোনো বস্তু নেই, যা আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করছে না। কিন্তু তোমরা সেই প্রশংসা বুঝতে পারো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৪৪)। অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে : ‘আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই তাঁর। যে সব ফেরিশতা) তাঁর দরবারে আছে, তারা কখনো ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। আর তাতে তারা অবহেলাও প্রদর্শন করে না। (সূরা আম্বিয়া : ১৯-২০)।
এসব বর্ণনা থেকে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হচ্ছে, মানুষ আল্লাহর বান্দা হিসেবে তাঁর ইবাদত থেকে বিরত থাকা কিংবা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিরলসভাবে আরাধনা চালিয়ে যাওয়াই মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রভূত সাফল্য। ইবাদত সহিহ বা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য ইখলাস তথা নিষ্ঠা অপরিহার্য। ইখলাস ব্যতীত কোনো আমল সহিহ হয় না। এটাই ইবাদতের সৌন্দর্য। এটার প্রভাবে ইবাদতের মধ্যে প্রদর্শন ইচ্ছা ও পার্থিব কোনো প্রতিদান পাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে না। এটা এমন একটি স্তর বা পর্যায়, যেখানে পৌঁছে আল্লাহর সামনে উপস্থিত থাকার চেতনা জাগ্রত থাকে এবং মন অন্যসব দিক থেকে মুক্ত থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালাকে নিজের সামনে উপস্থিত জেনে তাঁর মহত্ত্ব ও মর্যাদার কথা স্মরণ করে তাঁর ভয় ও প্রেম অন্তরে জাগ্রত রেখে বিনয় ও নম্রতা সহকারে প্রশান্ত মনে তাঁর ইবাদত করাই ইহসান। হাদিস শরিফে নবী করিম সা: ইহসান সম্পর্কে বলেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তাঁকে দেখছ। আর তা যদি মনে করতে না পারো, তাহলে মনে করো তিনি তোমাকে দেখছেন।’ (বোখারি-মুসলিম)(সমাপ্ত)