তওয়াফে কাবা হজ ও উমরাহর প্রধান কার্যাবলির একটি। ফকিহগণেরঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতীয়মান হয় যে, তওয়াফ ছাড়া হজ বা উমরাহ আদায় হয় না। মহানআল্লাহ কাবা শরিফ তওয়াফের নির্দেশ দিয়ে বলেন,‘তারা যেন বায়তুল আতিক তওয়াফ করে।’ (সূরা হাজ: ২৯) তওয়াফকারীর মর্যাদা ও তওয়াফের গুরুত্বের কারণে হজরত ইব্রাহীম ওইসমাঈল আ: বায়তুল্লাহ পবিত্র রাখতে আদিষ্ট হয়েছিলেন: ‘আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকেআদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফ, ইতিকাফ ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্ররাখ।’ (সূরা বাকারাহ: ১২৫)
হজের মধ্যে কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময়ে তওয়াফ আদায়করতে না পারলে কাজা আদায় করতে হয়। তওয়াফের প্রকারভেদ: ইসলামী ফিকাহরগ্রন্থাবলিতে ছয় ধরনের তওয়াফের বর্ণনা পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিন ধরনের তওয়াফহজের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন- ১) মক্কা তথা মসজিদে হারামে প্রবেশের সাথে সাথে তওয়াফকরা। এ তওয়াফকে বিভিন্ন নামে বিশেষায়িত করা হয়: তওয়াফে কুদুম, আওয়ালুল আহদ, তওয়াফে দুখুল, তওয়াফে লিকা, তওয়াফে উরুদ, তওয়াফে ওয়ারিদ, তওয়াফে কাদেম, তওয়াফে তাহিয়্যাহ ইত্যাদি। তবে এটি ‘তওয়াফে কুদুম’নামে সমধিক পরিচিত। ২) হজেরমূল তওয়াফ। একে তওয়াফে ইফাদাহ, তওয়াফে জিয়ারাত, তওয়াফে রুকন, ফরজ তওয়াফ, তওয়াফে সদর ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়। ৩) হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মক্কা থেকেবিদায় নেয়ার সময় আদায়কৃত তওয়াফ। যাকে ‘তওয়াফে বিদা’ (বিদায়ী তওয়াফ), আখিরুলআহদ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। উপরিউক্ত তিন প্রকার তওয়াফ হজের সাথে সংশ্লিষ্ট।বাকি তিন প্রকার তওয়াফ হলো৪) কাজা তওয়াফ। ৫) মানতের তওয়াফ। ৬) নফল বামুস্তাহাব তওয়াফ। তওয়াফের নিয়ম: জমহুর আলেমরা একমত যে, তওয়াফ ফরজ হোক আর নফলহোক হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু করতে হবে। সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে হবেসম্ভব না হলে ডান হাত দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে হাতে চুমু খেতে হবে, তাওসম্ভব না হলে হাত দিয়ে এর দিকে ইশারা করতে হবে। এরপর কাবাকে বাম দিকে রেখে ডানেঘুরতে থাকবে এবং সাত চক্কর দিতে হবে। এই ডানে ঘোরাকে বলা হয় তায়ামুন। সাত চক্করেরপ্রথম তিন চক্করে রমল (দ্রুত গতিতে দুলে দুলে হাঁটা) করতে হবে এবং বাকি চার চক্করস্বাভাবিক হাঁটার মতো চলতে হবে। এই নিয়ম হজ-উমরাহকারী ও নফল তওয়াফকারী সবার জন্য।কাবা শরীফের বরাবর সোজা ওপরে সপ্তম আসমানে (কেউ কেউ বলেন চতুর্থ আসমানে, আবার কেউকেউ বলেন সব আসমানেই) অবস্থানকারীদের তওয়াফ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ইবাদতেরনির্ধারিত একটি স্থান রয়েছে যার নাম ‘বায়তুল মামুর’।
হাদিসের বর্ণনা মতে প্রতিণেসত্তর হাজার ফেরেশতা ঘরটি প্রদণি করতে থাকে এবং কোনো অবস্থাতেই তা তওয়াফ থেকে খালিথাকে না। আলিম বলেন, বায়তুল মামুরও একই নিয়মে তওয়াফ করা হয়। তায়ামুন বা ডানদিকে ঘোরার ফিকহি বিধান: তওয়াফের সময় কাবা শরিফকে বামে রেখে ডানে ঘোরা তওয়াফেরএকটি রুকন, যদি কেউ এর উল্টো দিকে প্রদণি করে তবে তার তওয়াফ বাতিল হিসেবেপ্রতিপন্ন হয়। যারা এ মত ব্যক্ত করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম মালিক (৯৩-১৭৯হি.), শাফিঈ (১৫০-২০৪ হি.), আহমদ (১৬৪-২৪১ হি.), আবু সাওর (খৃ. ২৪৬), দাউদ জাহিরী (২০০-২৭০ হি.) [রহ.] প্রমুখ।
তারা বলেন, যেহেতু রাসূলুল্লাহ সা. তওয়াফ করার সময়কাবাকে বামে রেখে ডানে ঘুরেছেন সেহেতু উম্মতের জন্য এটিই আবশ্যক। কেননা তিনিবলেছেন: ‘তোমরা আমার থেকে হজের নিয়ম গ্রহণ কর।’ইমাম আবু হানিফা (৮০-১৫০ হি.) [রহ.] বলেন: তওয়াফের মধ্যে ডানে ঘোরা ওয়াজিব। এর উল্টো দিকে ঘুরলে তা মাকরুহতাহরিমি হিসেবে গণ্য হবে এবং ওই ব্যক্তি মক্কার সীমানায় থাকলে তার ওপর আবার তওয়াফআদায় ওয়াজিব হবে। আর যদি সে মক্কা ছেড়ে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করে থাকে তবে আবারতওয়াফ করতে হবে না, তবে তার ওপর দম (ভুল সংশোধনের জন্য পশু কোরবানি) ওয়াজিব হবে।ডান দিকে ঘোরার হিকমত : ওলামায়ে কেরাম কাবাকে বামে রেখে ডানে প্রদণি করার বিভিন্নহিকমত বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-১) তওয়াফকারীর জন্য কাবাইমামস্বরূপ। আর ইমামের সাথে একজন মুক্তাদি হলে তাকে ইমামের ডানেই দাঁড়িয়ে ইমামকেবামে রাখতে হয়। ২) বলা হয়ে থাকে মানুষের হৃদপিণ্ড (কলব) তার শরীরের বাম পাশেঅবস্থিত। তাই অন্তরের সাথে কাবার গভীর যোগসূত্র স্থাপনের জন্য এ বিধান করা হয়েছে।কাবা প্রান্তরে নিজ পরিবারকে রেখে যাওয়ার সময় ইব্রাহীম আ: যে দোয়া করেছিলেন, সেদোয়া থেকে এ যুক্তির সমর্থন পাওয়া যায়। ইব্রাহীম আ: দোয়া করেছিলেন:‘……… অতঃপর আপনি মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন…।’ (সূরা ইব্রাহীম: ৩৭) ৩)মানুষের রূহ বা প্রাণশক্তি দেহের বাম পাশে অবস্থান করে। এ কারণে এখান থেকে মহাধমনীসব শরীরে নির্গত হয়। একই কারণে আমরা আমাদের প্রাণের স্পন্দন বাম পাশেই অনুভব করি।তা ছাড়া মানবজীবনের সবচেয়ে সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার রূহ। তাই বাম পাশটিকাবার দিকে ফিরিয়ে তওয়াফ আদায় করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী: কাবাকেবামে রেখে ডানে তওয়াফ করার মধ্যে লুকায়িত রয়েছে এক নিগুঢ় রহস্য, যা আধুনিকবিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়েছে। বাম থেকে ডানে চক্কর দেয়াকে‘ঘড়ির কাঁটার উল্টো’প্রদণি বলা হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের সুবাদে জানাযায়, মহাবিশ্বের গ্রহ-উপগ্রহ, নত্র সবকিছু বাম থেকে ডানে ঘুরছে। বিদ্যুতিকআপন কপথে ঘোরে, এরপর অণুর মৌলের চারপাশে ঘোরে; চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্রকরে ঘুরছে; পৃথিবী নিজ কপথে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরছে (আহ্নিকগতি), একইভাবে ৩৬৫দিন বা এক বছরে সূর্যের চারপাশে একবার ঘোরে (বার্ষিক গতি); সৌর জগতের প্রতিটিগ্রহ-নত্র আপন ছায়াপথে ঘোরে; ছায়াপথ নিজ গতিপথের মিলনস্থলকে কেন্দ্র করে ঘোরে; গতিপথের মিলনস্থল মহাবিশ্বের কোনো একটি কিছুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে যা আল্লাহ ছাড়াকেউ জানে না। আর এ প্রতিটি প্রদণি বাম থেকে ডানে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে। সব কিছুমহাশুন্যে বাম থেকে ডানে চলছে।