ইসলামে অর্থনৈতিক সুবিচার

F32

ইসলামি অর্থনীতি প্রচলিত অর্থনীতির তুলনায় অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। প্রচলিত অর্থব্যবস্থা কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রণীত। কিন্তু ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের বস্তুগত কল্যাণ এবং একই সাথে তার সামগ্রিক আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সার্বিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ইসলামের মৌলিক নীতি হচ্ছে আল্লাহর একত্ব, সার্বভৌমত্ব ও মানুষের খেলাফত। মহান আল্লাহ সব কিছুর মালিক। তিনি এ জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও বস্তু সম্পদের নিয়ন্ত্রক। ইসলামি অর্থনীতির মৌল দর্শন তাই এই বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ দিক থেকে ইসলামি অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো প্রচলিত অর্থনৈতিক মৌলনীতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো সার্বজনীন খোদায়ি আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। নিচে ইসলামি অর্থনীতির এসব বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো :
ক. অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা : ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক জুলুম এবং বল্পাহীন মুনাফা বা একচেটিয়া দখলদারি নীতির পথ বন্ধ করা। কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের কল্যাণ নয়, বরং গোটা সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করাই ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য। অর্থকে সবার মধ্যে সঞ্চারিত করা, তা পুঞ্জীভূত করে না রাখা, অর্থপূজা ত্যাগ করে আল্লাহর নির্ধারিত পথে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। অর্থ আল্লাহ নির্ধারিত পন্থায় সঠিকভাবে ব্যয় না করা হলে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আল কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ১. আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও (সূরা তাওবা, আয়াত : ৩৪)।
২. অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না (সূরা আল-আনআম, আয়াত : ১৪১)। ৩. আল্লাহর পথে ব্যয় করো, আর নিজেদের হাতেই নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ো না। মানুষের প্রতি অনুগ্রহ-ইহসান করো। আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫)। খ. উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা : সম্পদ বা অর্থ আল্লাহর নির্ধারিত পথে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষের ভেতর উন্নত নৈতিক গুণাবলি সৃষ্টি করা ইসলামি অর্থনীতির আরেকটি উদ্দেশ্য। ইসলামের মতে, অর্থ বা সম্পদ নিয়ে কেউ কার্পণ্য করবে না। মানুষ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখবে না। মানুষ স্বেচ্ছায় তার সম্পদ থেকে দান করবে এবং সে অন্যের ব্যাপারে অনুগ্রহের হাত প্রসারিত করবে। এতে সমাজে সৃষ্টি হবে পারস্পরিক প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন। আল্লাহ তায়ালা এভাবে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও অভাবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করেছেন। দান, অনুগ্রহ, জাকাত প্রভৃতি খাতকে উৎসাহিত করে এবং কৃপণতা, বৈরাগ্য, অপব্যয়, বাহুল্য খরচ ও বিলাসিতাকে নিরুৎসাহিত করে আল্লাহ তায়ালা মানুষের মধ্যে উন্নত নৈতিক গুণাবলি তৈরির সুযোগ করে দিয়েছেন। আল-কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে ১. আত্মীয়স্বজনকে তার হক দেবে এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরও এবং অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান স্বীয় রবের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬ ও ২৭)। ২. সম্পদের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও অর্থসম্পদ ব্যয় করবে আত্মীয়দের জন্য, এতিমের জন্য, মিসকিন ও পথিকের জন্য, সাহায্যপ্রার্থীর জন্য এবং মানুষকে গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্ত করার জন্য (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৭৭)। ৩. আপনি তাদের অর্থসম্পদ থেকে সাদাকা গ্রহণ করুন, যাতে তা দিয়ে আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশুদ্ধ করবেন, আর আপনি তাদের জন্য দোয়া করুন। নিশ্চয়ই আপনার দোয়া তাদের জন্য চিত্তস্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ (সূরা আত-তওবা, আয়াত : ১০৩)। গ. সামাজিক সাম্য ও স্থিতি সংরক্ষণ : ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো, মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা এবং সামাজিক সাম্য ও স্থিতি সংরক্ষণ। এর ফলে সমাজে সবার অধিকার নিশ্চিত হবে। কেউ অভাবে থাকবে না, না থাকবে ুধার্ত। রাষ্ট্র আল্লাহ তায়ালার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে এবং নাগরিকদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। এর মাধ্যমে সমাজে গড়ে উঠবে সাহায্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ। ফলে সামাজিক পরিবেশ হয়ে উঠবে স্থিতিশীল। মানুষের প্রয়োজন বা জীবিকা সম্পর্কে আল কুরআনের বাণী হচ্ছে ১. ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার জীবিকার ব্যবস্থা (আল্লাহ) করেননি (সূরা হুদ, আয়াত : ৬)।
২. আমি তাদের মাঝে জীবিকা বণ্টন করে দিয়েছি। আর তাদের কিছু লোককে অপর কিছু লোকের ওপর মর্যাদা দিয়েছি। এটা এ জন্য করেছি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে (সূরা জুখরুফ, আয়াত : ৩২)। ঘ. একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানা ও জাতীয় মালিকানার বিলোপ : ইসলাম একচেটিয়া ব্যক্তিমালিকানা কিংবা জাতীয় মালিকানার কোনোটাই স্বীকার করে না। ইসলামে ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহিত করা হলেও ব্যক্তির সম্পদে অপরের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইসলামি মূলনীতিতে সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তাই আল্লাহর সম্পদে সবার সমান অধিকার রয়েছে। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যক্তিমালিকানা এবং ইসলামের ব্যক্তিমালিকানার মধ্যে ফারাক আছে। অন্য দিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও ইসলামি অর্থনীতি সমাজের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। দুনিয়ার সব সম্পদের মালিক যে মহান আল্লাহ তা তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সবই আল্লাহর। তোমাদের মনে যা কিছু আছে তা প্রকাশ করো অথবা গোপন রাখো, আল্লাহ তার হিসাব তোমাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করবেন (সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৮৪)।= সমাপ্ত=

Related Post